শৈশবস্মৃতি

আমরা বিকালে ক্রিকেট খেলতাম। বাড়িতে, উঠানে। সব উঠানে খেলা যাইত না। ক্রিকেটের জন্য যেহেতু একটু বড় এবং নির্ঝঞ্ঝাট জায়গা লাগে। আমরা মানে চাচাত, মামাত ভাই, চাচা, মামা এরা সবাই মিলে। ক্রিকেট আমাদের এইখানে জাতীয় খেলার মত তা জন্ম থেকে দেখে আসতেছি। জগন্নাথপুর এসোসিয়েশন কাপ ক্রিকেট সেই তখন থেকে এখনো নিয়মিত হয়। এই লীগের জন্যই মনে হয় জগন্নাথপুরে ক্রিকেট ছড়াইয়া ছিল। আর তখন তো মোবাইল ফেইসবুকের চল ছিল না। মানুষ খেলাতেই মগ্ন থাকতো।

যে সময়ের কথা বলতেছি তখন প্রাইমারি স্কুলের মাঠে গিয়া খেলার বয়স আমার হয় নাই।

ছিক্কা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়
ছিক্কা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, এর ডানদিকে সুন্দর একটি মাঠ ছিল। যে টিনের চালার বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে এটাও এখন আর নেই। এই টিনের চালে স্কুলে আমি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করি।

তখন হাসপাতালেও একটা সুন্দর বড় মাঠ ছিল। একপাশে উঁচা উঁচা গাছ। সেইসব গাছে বিকালে শত শত চড়াই পাখি আইসা ভীড় করত। আর খেলা হইত ঘাস আচ্ছাদিত সবুজ মাঠে। এখন সেখানে হাসপাতালের বিল্ডিং ইত্যাদি হইছে, মাঠ নাই।

জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
যে বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে এটা আগে ছিল না, এখানে বড় মাঠ ছিল।

আমরা বাড়ির উঠানে খেলতাম।

আমার নানা ও এক বয়স্ক মামা মাঝে মাঝে আমাদের খেলা পন্ড কইরা দিতেন।

আমরা খেলা ভাইঙ্গা বাড়ির পিছনে যাইতাম। তখন আমাদের সবার বাড়ির পিছনে জায়গা ছিল। এখনো বোধহয় আছে, কিন্তু আমরা নাই বা আমাদের অবাধ যাতায়াত নাই। খেলা ভাঙ্গার ফোলে, আমরা তখন নতুন কী খেলা যায় তা ঠিক করতাম। মাঝে মাঝে সেটা হইত নানাবাড়ির গোছলায় গিয়া নৌকা চড়া।

গোছলা বলতে বুঝায় যেখানে গরুদের রাখা হয়। গরুদের সেখানে বাইন্ধা রাইখা খড় ইত্যাদি দেয়া হইত। খড়ের ঘর ছিল তিনটার মতো। উপরে চালা দেয়া একটা জায়গায় গরুদের রাখা হইত। আর একদিকে ছিল ঘাটের মতো।

বর্ষায় এইখানে পানি থাকত। আর গরমকালে শুকাইয়া যাইত। শুকাইয়া গেলে যেসব গর্ত থাকতো পুকুরের মতো, সেইগুলা মেশিন দিয়া সেঁচা হইত। এবং তারপর কাদায় নাইমা মাছ ধরা হইত। এইভাবে মাছ ধরলে নাকী মৎস উৎপাদন কমে যায়। কিন্তু এইরকমই হয়ে আসতেছে।

সেই ঘাটের কথায় আসি। সেখানে কয়েকখানা নৌকা বাঁধা থাকত। একখান ছিল ছোট, পাতলা টাইপের নৌকা। আমরা তাতে চইড়া বসতাম এবং সেই দীঘিতে যাইতাম ঘুরতে। যে মামার কথা বলছিলাম আগে,  তার পোলারে হুংকার দিয়া ঘরে নিয়া গেছিলেন,  সেও পিছনের দরজা দিয়া নৌকায় আসত এবং আমাদের লিডার হইয়া যাইত।

আমার এক বড় চাচাত ভাই ছিল, সে মুরগী, শালিক ইত্যাদি পাখি পুষত খালি। পাখির জন্য কাচা হরিং তথা ঘাস ফড়িং ধরতে মাঝে মাঝে বড় নৌকা নিয়া যাইত সে দীঘিতে। আমি একদিন বা দুইদিন গেছিলাম মনে পড়ে তাদের সাথে। ঘাসফড়িং ধরে প্লাস্টিকের বোতলে ভইরা আনত। বোতলে ছিদ্র কইরা রাখতো যাতে বাতাস ঢুকে।  তারপর ঠ্যাং ফেলে তার পাখিরে খাইতে দিত। তার কোন পাখি তেমন বাঁচে নাই।

আমরা যখন সাতার শিখে ফেললাম তখন পুকুরে পইড়া থাকতাম। নামলে দুই ঘন্টার কমে উঠা নাই। সমস্ত পুকুর একরমক তোলপাড় করা হইত সবাই মিলে। তখন ডব্লিউডব্লিউই রেসলিং বেশ ফেমাস ছিল। আমরা পানিতে রেসলিং খেলতাম। পুকুরে বসার জায়গা ছিল, কাপড় ধোঁয়ার জায়গা ছিল পাকা এবং উঁচা। আমরা তার উপর থেকে অন্যের উপর লাফাইয়া পড়তাম। যেমন রেসলিং এ লাফাইয়া পড়ে। বিপদজনক ব্যাপার, কিন্তু কখনো কোন বড় বিপদ আমাদের হয় নাই। মাঝে মাঝে পুকুর পাড়ের নারকেল গাছের পাতায় ভর করে শুন্যে ভেসে, সাময়িক সময়ের জন্য টারজান অনুভূতি নিয়া আমরা পানিতে লাফাইয়া পড়তাম।

পানিতে আরেক বিখ্যাত খেলা ছিল লাই। শাহ আব্দুল করিমের একটা গানে আছে কোন সাগরে খেলতেছ লাই করতেছি তাই ভাবনা। লাই খেলাটা হচ্ছে একজন পানিতে সাঁতরে বা ডুব দিয়া চলে যাবে, তারে গিয়া ছুঁইতে হবে। অথবা অনেকে মিলে এভাবেও খেলা হইত, একটা জায়গা ঠিক করা হইত। একটা সিড়ি, একজন এর পাহাড়ায় থাকবেন। অন্যেরা দূরে যাবে তারপর আইসা এই সিড়ি ছুঁইতে পারলে তারা জিতছে। আবার পাহাড়াদারীর দায়িত্বে যিনি বা যারা তারা অন্য পার্টিরে ছুঁইলে তারা মরা, মানে হারতেন।

লাই দৌড়াইয়াও খেলা যাইত উঠানে। বড় মামা চাচাদের সাথে খেলার সাথে আমরা ফুপু, আপাদের সাথেও খেলতাম কখনো কখনো, আরো ছোট থাকতে। তারা মাটিতে ঘর ঘর বানাইয়া একরকম খেলা খেলতেন তাতে পা দিয়া চারকোনা মাটির হাড়ির অংশকে ঠেলে নিতে হইত এক ঘর থেকে আরেক ঘরে। গোল্লাছুট খেলাও হইত।

মাঝে মাঝে শীতের সময় এক খেলা জনপ্রিয় হইত। সেটা হচ্ছে চারকোনা স্টিল বা  মাটির হাড়ির অংশ দিয়া। দুজন বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে খেলা যাইত। একটা ছোট চারকোনা ঘর করা হইত। এখানে দাঁড়াইয়া একজন তার “সিক” ছুঁড়ে মারতেন। তারপর তিনি মাপ ঠিক কইরা দিতেন। চার আঙ্গুল, দুই আঙ্গুল ইত্যাদি। চার আঙ্গুল দিলে প্রতিপক্ষকে তার ছুঁড়ে দেয়া “সিক” এর চার আঙ্গুলের মধ্যে “সিক” ফেলতে হবে। প্রতিপক্ষ ছোঁড়ার আগে তিনি ম্যাচের বাক্সের কিছু কাগজ এক হাতে নিয়া ধরতেন। প্রতিপক্ষ যদি চার আঙ্গুলের কাছাকাছি ফেলতে পারে তাহলে এই বাক্সের কাগজগুলো তিনি তাকে দিয়ে দিবেন। অন্যথায় প্রতিপক্ষ তাকে সম পরিমাণ কাগজ দিবে।

ম্যাচের বক্সের কাগজ বলতে বাক্সের দুই পাশ। এক বাক্স থেকে দুইটা কাগজ পাওয়া যাইত। কোন কোন বাক্সের কাগজের দাম ছিল বেশি। এদের বলা হইত “চেক”। যেমন, বাঘের ছবিওয়ালা বাক্সের কাগজের দাম বেশি ছিল। এসবরে খুব দামী মনে হইত তখন। আমার ছোট মামার ছোট এক বস্তার মতো এরকম কাগজ ছিল। তার সেই অর্জিত সম্পদ অবশ্য এখন ধুলায় মিশে গেছে।

আমাদের মক্তবের বড় হুজুর এই খেলা পছন্দ করতেন না। আর পছন্দ করতেন না মার্বেল খেলা। এই দুই খেলা কেউ খেলছে শুনলে তারে পিটাইতেন। আমরা হুজুররে ভয় পাইতাম। শোনতাম একসময় তার কাছে যাদুর সব কিতাব ছিল। পরে জ্বীনেরা আইসা তার ক্ষতি করতে থাকে। তাই একসময় উনি এইগুলা ছাইড়া দেন।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং