মুরাদুল ইসলাম » ফিল্ম » হানেকের “হিডেন” রহস্য এবং নতুন ধরনের রহস্য নির্মান

হানেকের “হিডেন” রহস্য এবং নতুন ধরনের রহস্য নির্মান

মিখায়েল হানেকে
মিখায়েল হানেকে

 

সাধারণত রহস্য গল্পের ক্ষেত্রে রহস্য একটা থাকে। কাহিনী যতই বাড়তে থাকে ততই রহস্যের পর রহস্য আসতে থাকে। তা প্রধান রহস্যকে কেন্দ্র করে হতে পারে। অথবা আলাদা আলাদাও হতে পারে। গল্পের প্রধান চরিত্র বা চরিত্ররা সেসব রহস্য উদঘাটন করে যান। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা নিজের বুদ্ধি কাজে লাগান। কোন কোন ক্ষেত্রে তা বিভিন্ন ঘটনার সাপেক্ষে সমাধান হয়। অর্থাৎ রহস্য সমাধানে সূত্র এবং তাকে নিয়ে চিন্তার সুযোগ থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। কাহিনী শেষ, সব জট খুলে গেল।

কিন্তু রহস্য গল্পে যদি এমন হয় যে একটা রহস্য পূর্ন ঘটনা ঘটল। গল্পের কাহিনী বাড়ার সাথে সাথে লেখক কে এই রহস্যের সাথে জড়িত হতে পারে এমন কয়েকটা চরিত্র আনলেন। সবাই যার যার অবস্থান থেকে জড়িত থাকার সম্ভাবনা আছে। যদি রহস্যটা একটা খুন হয় তাহলে সে খুন করতে পারে এমন সম্ভাবনার কয়েকজন চরিত্র থাকলো। এদের যে কেউ কাজটি করতে পারে। কিন্তু লেখক নিজে থেকে বলে দিলেন না কে খুনটা করেছে। মূল রহস্যটা সমাধান না করে ভেতরের বাকী সব রহস্যের সমাধান করা হল। অর্থাৎ রহস্য গল্পের যে স্বাদের জন্য পাঠক পড়া শুরু করেছিলেন তার সরবরাহও করা হল। কিন্তু প্রধান রহস্যটি একেবারে সরাসরি সমাধান করা হল না।

এই অবস্থায় কাহিনী শেষ হয়ে গেল।

এতে স্বাভাবিকভাবেই যারা রহস্য গল্পের নিয়মিত পাঠক এদের হতাশ হবার একটা সম্ভাবনা থাকে। যেহেতু জট পুরোপুরি খুলে নাই। তারা তখন ক্ষুব্ধও হতে পারেন।

তবে এখানে পাঠকেরও ঘটনায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে। পড়া শেষ হবার অনেক পরেও পাঠক তার নিজের মত করে ভাবতে পারেন। আবার বিভিন্ন সম্ভাবনার জন্য তার মনে এক ধরনের নিশ্চিত না হতে পারার অনুভূতি কাজ করে। এ ধরনের কাহিনীতে ফেলু মিত্তিরের মস্তিষ্কপুষ্টির সাথে সাথে পাঠকেরও মস্তিষ্কপুষ্টির যথেষ্ট সুযোগ থাকবে।

গল্পে রহস্যটাকে উপলক্ষ্য মাত্র হিসেবে নিয়ে নানা সামাজিক, রাজনৈতিক ইস্যু উঠে আসতে পারে জায়গায় জায়গায়। ফলে পাঠকের সরাসরি সেসব ইস্যুতে যুক্ত হবারও একটা সুযোগ থাকে। আর যেহেতু রহস্যটার পুরো মীমাংসা করা হয় নি, যে মূল দোষী তাকে বের করা হয় নি সুতরাং জাজমেন্টাল কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে না লেখককে। এটা লেখক পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিতে পারবেন। পাঠকের উপর চাপিয়ে দেবার কিছু থাকল না।

রহস্য খোলা রেখে দিলে প্রাথমিকভাবে পাঠক হয়ত তা ধরতে পারবে না, কিংবা জট খুলে নি দেখে হতাশ হবে। কিন্তু পরবর্তীতে তার মাথার ভিতরে গল্প নিজেই কাজ করা শুরু করে দেবে। এবং একেকজন পাঠকের মধ্যে একেকরকম ভাবে ক্রিয়া করবে। একেকজন একেকরম ভাবে শেষটা ভেবে নিতে পারবেন। একই গল্পের ভিন্ন ভিন্ন ভার্সন থাকবে ভিন্ন পাঠকের মস্তিষ্কে।

এই ধরনের গল্পের একটা চমৎকার নিদর্শন ধরা যায় মিখায়েল হানেকের ফিল্ম Caché (Hidden)। ছবিটি বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছে। এটাকে হানেকের একটা মাস্টারপিস হিসেবে ধরা যায়। ২০০৫ সালের ছবি।

Caché (Hidden) Film Poster
Caché (Hidden) ফিল্ম পোস্টার

 

[স্পয়লার এলার্টঃ এখন হিডেন এর কাহিনী নিয়ে কিছু বলা হবে।]

 

 

হিডেন মুভিটা শুরু হয় একটা ভিডিওর মাধ্যমে। দেখা যায় একটা রাস্তা, তার পাশে বাড়ি। কয়েকটা গাড়ি সামনে। মানুষজন স্বাভাবিকভাবেই যাওয়া আসা করছে। বাড়িটা থেকে একটা মহিলাকে এবং তারপর একটা লোককে বের হতে দেখা যায়। দুই মিনিটের বেশি সময় স্থির ভিডিওর পর দুজনের কথোপকথন শোনা যায় এবং বুঝা যায় যে আমরা যা দেখছিলাম তা একটি ভিডিও যেটা কেউ একজন এই ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলার ঘরের দরজার সামনে ফেলে গেছে।

এটাই প্রথম দৃশ্য।
এটাই প্রথম দৃশ্য।

ভিডিও নিয়ে ভদ্রমহিলা যার নাম এনি লরেন্ট এবং তার জামাই ভদ্রলোকের নাম জর্জস লরেন্ট দুজনই চিন্তিত হয়ে পড়েন। কেউ তাদের উপর চোখ রাখছে বা তাদের গোপন ব্যাপার জেনে ফেলছে এই ভয়টা সবচেয়ে বড় ভয় হয়ে দেখা দেয়। যেটা আরেকভাবে দেখা যায় ডেভিড লিঞ্চের অসাধারণ ফিল্ম লস্ট হাইওয়েতে। লস্ট হাইওয়েতে একটা ইনসেন লোক কীভাবে অনুভব করে তা দেখানোর এক চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে একটা চরিত্র ছিল মিস্ট্রি ম্যান। সেই মিস্ট্রি ম্যানের সাথে প্রথম যখন লস্ট হাইওয়ের প্রোটাগোনিস্টের আলাপ হয় এবং যখন সে বুঝতে পারে মিস্ট্রি ম্যান অদ্ভুত ক্ষমতাবলে তার বাসার ভেতরে প্রবেশ করতে পারে তখন এক ভয় এবং বিস্ময়ের অনুভূতি দেখা যায় তার চোখে।

Mystery Man
রহস্য মানব

লস্ট হাইওয়েতে মিস্ট্রি ম্যানের ডায়লগ “উই হ্যাভ মেট বিফোর, হ্যাভন’ট উই?” আসলে একটা থ্রেট। সাধারণ মানুষরা তার প্রাইভেসি নষ্ট হলে এবং যদি সে হঠাৎ জানতে পারে তার সমস্ত কিছু আরেকজন লোক জেনে গেছে তখনই বেশি ভয় পায়। এই ভয়ের তুলনা নেই। এই ভয়ের গভীরতা অনেক। মিস্ট্রি ম্যান তার অদ্ভুত হাসির সাথে এই কথার মাধ্যমে “আমি তোমার ভেতরের খবর জানি” বলে একটা হুমকি দেয় আসলে। যে হুমকিতে যেকোন মানুষই কেঁপে উঠতে বাধ্য।

(এই দৃশ্যটি সমগ্র ফিল্ম জগতের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ও অসাধারন দৃশ্য।)

হানেকের হিডেন ফিল্মে একইভাবে যখন এনি ও জর্জস বুঝতে পারেন তাদের উপর কেউ চোখ রাখছে তখন তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে জর্জস একজন ইন্টেলেকচুয়াল সেলিব্রেটি। যে টিভিতে বই নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করে টকশোর মত। লেখক কবিরা সেখানে গিয়ে আলোচনা করেন। এনি লরেন্ট একজন পাবলিশার। তাদের বাড়িতে দেখা যায় বই আর বই। বইয়ের বড় বড় তাক। কিচেনেও দেখা যায় বই।

তাদের বন্ধু বান্ধবরাও ইন্টেলেকচুয়াল। মাঝে মাঝে আসেন বাসায়। তারা আড্ডা দেন।

নিরোপদ্রব জীবন তাদের। কিন্তু সামান্য ভিডিও কীভাবে তা বিশৃঙ্খল করে দিতে পারে তা ফিল্ম শুরুর অল্পক্ষণের মাঝেই বুঝতে পারা যায়। আরো বুঝতে পারা যায় যখন ভিডিওটিতে দৃশ্যপট পরিবর্তন হয় এবং সেই গ্রামের খামার বাড়ির চিত্র উঠে আসে যেখানে ছোটবেলায় ছিল জর্জস লরেন্ট।

ভিডিওগুলোর সাথে আসতে থাকে বাচ্চাদের হাতে আঁকা একটি কার্টুন মুখ এবং তার মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে এরকম ছবি।

জর্জসের মধ্যে চলে আসে তীব্র একটি ভয়ের অনুভূতি। সে তার ছোটবেলার খামার বাড়িতে যায়। তার অসুস্থ ও বৃদ্ধ মায়ের সাথে কথা বলে। এই কথোপকথনে দেখা যায় স্নেহশীল এক বৃদ্ধ ও একাকী মাকে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার ছেলের কোন সমস্যা হয়েছে। তিনি বার বার এবিষয়ে প্রশ্ন করেন এবং বারবার এড়িয়ে যায় তার পুত্র।

তাদের কথোপকথনে উঠে আসে অল্পক্ষণের জন্য একটা ছেলের কথা। যার নাম মাজিদ। আলজেরিয়ান মুসলমান।

জর্জস এবং এনি আরেকটি ভিডিও পায়। সেখানে একটা রাস্তা দেখানো হয়েছে। এবং একটা বিল্ডিং এর ০৪৭ নাম্বার রুমটা পর্যন্ত দেখানো হয়েছে।

জর্জস যখন বলে যে সে ধারণা করতে পারছে কে ভিডিও পাঠাচ্ছে কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে বলতে পারছে না তখন এনির সাথে তার বাকবিতন্ডা হতে দেখা যায়। এই বাক বিতন্ডার ভেতর দিয়ে বুঝতে পারা যায় জর্জস লরেন্টের কোন একটা গোপন বিষয় আছে। আছে গোপন কোন অপরাধবোধ। সে অপরাধবোধে তাকে বিব্রত দেখা যায়।

জর্জস সেই রাস্তা ধরে একা একাই গাড়ি নিয়ে যায়। গিয়ে বিল্ডিংটার ভেতরে ঢোকে এবং একটি নির্দিষ্ট রুমে কড়া নাড়ে। রুম খোলে দাঁড়ায় এক মধ্যবয়স্ক লোক। জর্জস তাকে ভালো করেই চেনে। দীর্ঘকাল আগে তাদের শেষ দেখা হয়েছিল। এই সেই মাজিদ।

জর্জস লরেন্ট তাকে অভিযুক্ত করতে থাকে ভিডিও পাঠিয়ে ভয় দেখানোর জন্য। কিন্তু মাজিদ ভিডিও পাঠানোর ব্যাপার অস্বীকার করে। সে বলে এসবের কিছুই সে জানে না। জে লরেন্ট মাজিদকে হুমকি ধামকি দেয়। পরবর্তীতে সে যখন বাসায় ফিরে যায় তখন দেখা যায় মাজিদের সাথে তার এই কথোপকথনের ভিডিও চলে এসেছে। জর্জস এবং এনি বসে তা দেখে এবং দেখা যায় হুমকি ধামকি দিয়ে চলে আসার পর মাজিদ হাপুস নয়নে কাঁদে।

ফিল্মে মাজিদের কান্না একটা টাচিং দৃশ্য। কিন্তু দেখা যায় এই কান্না এনি এবং দর্শককে টাচ করলেও জর্জসকে স্পর্শ করে না। এনির প্রশ্নের উত্তরে জর্জস বলে মাজিদের সাথে তার পরিচয়ের কথা। সেখানেই উঠে আসে ফ্রান্সের এক কালো ইতিহাসের গল্প। ১৯৬১ সালের ১৭ অক্টোবর ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল পুলিশ আলজেরিয়ান মুসলিমদের উপর গণহত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। জর্জস জানায় এই গণহত্যায় মারা যায় মাজিদের বাবা মা। মাজিদের বাবা মা তাদের বাসায় কাজ করত। সুতরাং তার বাবা মা মাজিদকে দত্তক হিসেবে নেন।

সে বলে সে মাজিদকে পছন্দ করত না। এবং মাজিদের ব্যাপারে তার মা বাবাকে মিথ্যে বলেছিল। কিন্তু কী মিথ্যা তা জানা যায় না।

নতুন প্রাপ্ত ভিডিওটির পর জর্জসকে একজন ডিরেক্টরের সাথে কথা বলতে দেখা যায়। যিনি একটা নিউ শো এর ব্যাপারে কথা বলেন এবং তারপর বলেন যে কেউ একজন একটা ভিডিও ক্যাসেট তার কাছে পাঠিয়েছিল। সেখানে মাজিদ ও জর্জস এর কথাবার্তা তিনি দেখেছেন। এ ব্যাপারে তিনি জিজ্ঞেস করেন।

এই কথাবার্তা দর্শকের মনে সন্দেহ আসতে পারে এই লোকই কী ভিডিওগুলোর পেছনে।

একসময় দেখা যায় জর্জস ও এনির টিনেজার ছেলেকে পাওয়া যায় না। জর্জসের সন্দেহ হয় মাজিদের উপর। সে পুলিশ দিয়ে মাজিদ ও মাজিদের ছেলেকে ধরিয়ে দেয়। পরদিন দেখা যায় অন্য জায়গা থেকে ঠিকই ফিরে আসে তাদের ছেলে।

দেখা যায় তাদের টিনেজ ছেলের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো না। কোন একটা কারণে ছেলে তাদের অপছন্দ করে এবং এড়িয়ে চলে। ছেলে এনিকে যেভাবে অপছন্দ করে তা একেবারে অস্বাভাবিক। এই অপছন্দের পেছনের কারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে দর্শকের মনে? কী এমন কারণ?

দেখা যায় জর্জস এবং এনির লাইফ এতো কিছুর মধ্যেও চলছে। জর্জস লরেন্টকে টিভি শো তে লেখকদের নিয়ে করা টকশো এডিটে বিভিন্ন নির্দেশ দিতে দেখা যায়। এরপরই একটা ফোন আসে। জর্জস চলে যায় সেই ০৪৭ নাম্বার রুমে। সেখানে মাজিদ দরজা খোলে তাকে আসার জন্য ধন্যবাদ জানায়।

জর্জস ভেতরে প্রবেশ করে। মাজিদ বলে যে সে ভিডিওগুলোর ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। এবং এরপর ক্ষুর দিয়ে গলার রগ কেটে সুইসাইড করে জর্জসের সামনেই। এটা একটা ভায়োলেন্ট দৃশ্য। দেখার জন্য খুব সুখকর দৃশ্য না অবশ্যই।

দেখা যায় মাজিদ মাটিতে পড়ে আছে। তার গলা দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। কিন্তু জর্জস তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায় না। সে একধরনের ভয় নিয়ে তাকে দেখে এবং সাবধানে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

সে তার বাড়িতে যায়। তার বউ এনিকে বিষয়টা বলে। এটাও বলে যে মাজিদ ভিডিওগুলো পাঠিয়ে প্রথম ভয় দেখিয়েছে তারপর গলার রগ কেটে নিজেকে খুন করল। অর্থাৎ মাজিদের শেষ কথা সে বিশ্বাস করে নি। মাজিদ নিজেকে হত্যা করেও জর্জসের কাছে নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারল না।

এনি জানতে চায় ছোটবেলায় জর্জস আসলে সত্যি সত্যি কী করেছিল মাজিদের সাথে।

জর্জস বলে সে মিথ্যে বলেছিল মাজিদের মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়। তার বাবা মা বিশ্বাস করেন নি। ডাক্তার দিয়ে চেক করান। কিন্তু কোন অসুখ পাওয়া যায় নি। তারপর জর্জস (তখন তার বয়স ছয় বছর) মাজিদকে বলে তার বাবা বলেছেন মাজিদ যেন তাদের মোরগটাকে মেরে ফেলে। মাজিদ মোরগটাকে মারে। তার গায়ে রক্ত লেগে যায়। তখন জর্জস তার বাবা মাকে গিয়ে বলে মাজিদ তাকে ভয় দেখাতেই এ কাজ করেছে। এরপর জর্জসের বাবা মা মাজিদকে আর তাদের সাথে রাখেন নি।

জর্জস লরেন্টের এই গল্পের সত্যতার ব্যাপারে দর্শকের মনে সন্দেহ আসতে পারে। কারণ মাত্র কয়েক দৃশ্য আগে দেখা যায় জর্জস একটা কারণে তার স্ত্রীকে মিথ্যা বলতে বলছে। সে যে মিথ্যা বলায় পারদর্শী সেটা বুঝা যায়। সুতরাং, তার গল্পের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে? সে এর চেয়ে বেশি কিছু কী ছোট মাজিদের সাথে করেছিল?

তা না হলে কেন সে বিশ্বাস করবে মাজিদ তার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়? এই ছোট ঘটনার ফলে দীর্ঘদীন পর প্রতিশোধ নেয়ার যৌক্তকতা কম।

একেবারে শেষের দিকে দেখা যায় মাজিদের ছেলে আসে জর্জসের সাথে দেখা করতে তার অফিসে। জর্জস দেখা করতে চায় না। একসময় বাধ্য হয়। তাদের কথোপকথনে জর্জস মাজিদের ছেলেকে অভিযুক্ত করতে থাকে ভিডিও টেপগুলো পাঠানোর জন্য। কিন্তু মাজিদের ছেলেও অস্বীকার করে। সে বলে, একজন মানুষের মৃত্যু আপনার বিবেকে কেমন অনুভূত হয় সেটাই দেখতে এসেছিলাম।

এরপরের দৃশ্যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শান্তিতে নিদ্রা যেতে দেখা যায় জর্জেস কে।

cache16
এটা শেষ দৃশ্য।

একেবারে শেষ দৃশ্যে জর্জেসের ছেলের স্কুলের সামনে অনেক লোক দেখা যায়। অনেকে অনেকের সাথে কথাবার্তা বলছে। এসব কথার শব্দ শোনা যাচ্ছে না। একসময় দেখা যায় জর্জেসের টিনেজ ছেলে এবং মাজিদের ছেলে কথা বলছে। তাদের কথাবার্তার শব্দও শোনা যায় না। কথা শেষে মাজিদের ছেলে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। তাদের কথাবার্তায় বুঝা যায় তারা একে অপরের পরিচিত।

ছবি শেষ হয়। কিন্তু মূল রহস্য ‘ভিডিও টেপগুলো কে পাঠালো’ তার মীমাংসা হয় না।

এটা কী মাজিদ? মাজিদের ছেলে? জর্জেসের ছেলে পীরেট? না সেই ডিরেক্টর? না জর্জেসের মা। না অন্য কেউ।

ফিল্মের একটা দৃশ্যের ব্যাপারে অভিনেতা অভিনেত্রীদের নির্দেশনা দিচ্ছে হানেকে। বুড়ো দাড়িওয়ালা লোকটাই তিনি।
ফিল্মের একটা দৃশ্যের ব্যাপারে অভিনেতা অভিনেত্রীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন হানেকে।

 

মিখায়েল হানেকে কে প্রশ্নটা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, আমি কাউকে এর উত্তর দেব না। যদি আপনি মনে করেন মাজিদ, পিরেট, জর্জেস, ঈর্ষাপরায়ণ ডিরেক্টর, স্বয়ং ঈশ্বর, মানুষের বিবেক – এই সব উত্তরই ঠিক। কিন্তু আপনি যদি এই প্রশ্নে চলে আসেন কে টেপগুলো পাঠিয়েছিল তাহলে আসলে আপনি ছবিটা বুঝেন নি। এই প্রশ্ন করা হল ছবিটি যে মূল প্রশ্ন তুলে আনে তাকে এড়িয়ে যাওয়া। সেটা এরকম যে, কীভাবে আমরা আমাদের বিবেক এবং অপরাধবোধকে ট্রিট করি এবং জীবন যাপনের অন্যান্য কার্যাবলীর সাথে কীভাবে এর খাপ খাওয়াই?

মানুষজন জিজ্ঞেস করছে শুধু, ‘কে ভিডিও পাঠালো?’ কারণ আমি দোষারুপ ও বিবেকের ইস্যুগুলো নিয়ে আসতে এই ধারা বেঁচে নিয়েছি, একটা থ্রিলারের গঠন। এই ধরনের গঠন সব সময় একটা উত্তর চায়। কিন্তু আমার ছবিটি থ্রিলার নয়। তারা তাদের অপরাধবোধে ভুগতে থাকা বিবেক নিয়ে কীভাবে আচরণ করবে তা নিয়ে অন্যকে উত্তর দেয়ার মত সাহস করার আমি কে।

এই ছবির গল্পের প্রধান চরিত্র, ইন্টেকচুয়াল সেলিব্রেটি লোক জর্জস লরেন্ট কীভাবে অন্যকে মিথ্যা অভিযোগ করে, কীভাবে তার ঘরে শত শত বই সাজানো থাকলেও অন্য ক্লাসের লোকের জীবন-মৃত্যু তাকে কোন স্পর্শই করে না দেখা যায়। জর্জস বার বার স্ত্রীর কাছে তার ছোটবেলার কাহিনী বলতে তার বয়স তখন ছয় ছিল বলে উল্লেখ করেছে। এই উল্লেখের মাধ্যমে সে তার তখনকার অপরাধকে ছোট ছেলের ভুল হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। কিন্তু পুরো ফিল্মে দেখা যায় মধ্যবয়েসী ইন্টেলেকচুয়াল সেলিব্রটি টিভি প্রেজেন্টার জর্জস কীভাবে সেই ছয় বছর বয়েসী বালকের মতোই মনোভাব নিজের ভেতরে পুষে রেখেছে।

অন্যদিকে তার প্রকাশক স্ত্রী এনি যেভাবে স্বামী তার কাছে কিছু একটা লুকিয়েছিল বলে বাক বিতন্ডায় লেগেছিল তেমন ভাবে প্রতিবাদ করেনি মাজিদের প্রতি তার স্বামীর কৃতকাজের ব্যাপারে। মাজিদের কান্না দেখে তার খারাপ লেগেছে। সে বিশ্বাস করে নি মাজিদ টেপগুলো পাঠিয়েছে। কিন্তু তবুও মাজিদের জীবন যেন তাকেও তেমন স্পর্শ করে না।

জর্জস এবং এনি একটা ক্লাসের লোক। মাজিদ ভিন্ন ক্লাসের। জর্জসের কথাতেই জানা যায় সে মিথ্যা বলে একটা অপরাধ করেছিল মাজিদের সাথে। যা মাজিদের জীবনকে খারাপভাবে বদলে দিয়েছে।

কিন্তু সে এজন্য ভিডিও টেপগুলোর ব্যাপারে মাজিদকে অভিযুক্ত করেছে। এর জন্যই মাজিদের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।

ঘটনা হল, মাজিদ টেপ পাঠায় নি কিন্তু তবুও তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কেন করা হয়েছে? কারণ সে ছোটবেলায় জর্জসের করা অপরাধের স্বীকার হয়েছিল।

জর্জস তার অপরাধ স্বীকার করা তো দূরের কথা উলটো সে অপরাধের জন্য মাজিদকে আরেকটি ব্যাপার নিয়ে দোষারুপ করে এবং মৃত্যুর দিকে টেলে দেয়।

জর্জস মাজিদের ছেলেকে এক পর্যায়ে বলে, আমার এবং আমার ফ্যামিলিকে ভয় দেখালে পস্তাতে হবে। অর্থাৎ মাজিদের মৃত্যুর পরও জর্জস তার অপরাধ স্বীকার করে নি। নিচের ক্লাসের এই লোকদের দোষারূপ করা এবং থ্রেট দেয়াই যেন তার কাজ। যেকোন কিছুই ঘটুক না কেন।

আপাতত দেখা যায়, ভিডিওর ব্যাপারটা নির্বিষ ছিল। তাতে কারো কোন ক্ষতি হচ্ছিল না। এখন ধারণা করা যাক, আবার ভিডিও পেল জর্জস এবং এনি, তাহলে কী হবে?

ফিল্ম দেখে যা মনে হল তাতে মনে হচ্ছে অবশ্যই জর্জস মাজিদের ছেলেকে দোষারূপ করবে।

যতই বইয়ের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকুক, যতই ইন্টেলেকচুয়াল হোক – জর্জস এবং এনির ক্লাস মাজিদের ক্লাসকে দোষারুপ, সন্দেহ এবং ঘৃণা করেই যাবে। মাজিদদের জীবন-মৃত্যু তাদের কাছে তুচ্ছ।

এই ফিল্মের গল্পে যেভাবে রহস্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেভাবে একটু একটু করে সন্দেহ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং বিভিন্ন জনের দিকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা দেখার মত। জট না খোলা রহস্য গল্প হিসেবেই এর গুরুত্ব। জট যদি খুলে যেত অর্থাৎ যদি জানা যেত কে আসলে ভিডিও টেপগুলো পাঠিয়েছে তাহলে সাধারণ এক রহস্য থ্রিলার হয়েই থাকত হিডেন। কিন্তু জট না খুলে, বিভিন্ন সম্ভাবনাকে তুলে ধরে অতুলনীয় এক সৌন্দর্যের মুখোমুখি করেছেন হানেকে। তাকে ধন্যবাদ। এই ধরনের চর্চা আরো হওয়া দরকার।

 

“I try to construct stories so that several explanations are possible, to give the viewers the freedom to interpret. I do it by everything I don’t show, and through all the questions I raise and don’t answer. That way, the audience doesn’t finish with the film as quickly as if I’d answered everything.”

— Michael Haneke 

3 thoughts on “হানেকের “হিডেন” রহস্য এবং নতুন ধরনের রহস্য নির্মান”

  1. Pingback: বাংলা নতুন থ্রিলার বা থৃলার সাহিত্য | মুরাদুল ইসলামের ব্লগ

  2. Pingback: এলভিন স্ট্রেইটের তীর্থযাত্রা | মুরাদুল ইসলামের ব্লগ

  3. Pingback: কীভাবে বই পড়তে হয়? | @ মুরাদুল ইসলামের ব্লগ

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং