মুরাদুল ইসলাম » অবশ্যপাঠ্য » আধুনিক সমাজে একো এবং নার্সিসাস

আধুনিক সমাজে একো এবং নার্সিসাস

                  Myths are made for the imagination to breathe life into them.

Albert Camus

 

অলিম্পিয়ানদের রাজা দেবতা জিউসের স্ত্রী ছিলেন দেবী হেরা। জিউস যখন অন্য নিম্ফদের সাথে মিলিত হতেন তখন হেরাকে গল্প বলে ব্যস্ত রাখত একো নামের আরেক নিম্ফ। একসময় এই চালাকি দেবী হেরা ধরতে পারেন। তিনি একোর সুন্দর কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নেন। সে তখন কথা বলার ক্ষমতা হারায়। শুধু মাত্র অন্যের বলা শেষ কথার প্রতিধ্বনি করতে পারত সে। (এজন্য একো শব্দের অর্থ এখন প্রতিধ্বনি।)

আরেক নিম্ফ থেস্পিয়ার লেইরিওপের সাথে রিভার গড সেফিসাসের এক সন্তান ছিল। যার নাম নার্সিসাস। নার্সিসাস ছোট বেলা থেকেই দেখতে সুন্দর। অনেকেই থাকে পছন্দ করত এবং তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল। কিন্তু সে এতে আগ্রহী ছিল না।

একদিন বনে শিকারে গিয়েছিল যুবক নার্সিসাস। তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে যায় নিম্ফ একো। সে নার্সিসাসকে প্রেম নিবেদন করল এবং তার প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করল। কিন্তু নার্সিসাস থাকেও পাত্তা দিল না।

ছবিঃ নার্সিসা ও ইকো। জন উইলিয়াম ওয়াটারহাউজ এঁকেছেন।
ছবিঃ নার্সিসাস ও একো। জন উইলিয়াম ওয়াটারহাউজ এঁকেছেন।

দুঃখে একো আফ্রোদিতির কাছে প্রার্থনা করে এবং আফ্রোদিতি তাকে অদৃশ্য করে দেন। নার্সিসাস একটা পানির ধারার কাছে যায় পানি পানের জন্য। কিন্তু সেখানে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। এমন সৌন্দর্য সে আগে দেখে নি। সে এই ছবি দেখতে থাকে, দেখতেই থাকে। নিজের প্রেমে পড়ে যায় নার্সিসাস। তার শরীর সেখান থেকে চলে যায়। রয়ে যায় নার্সিসাস ফুলের গাছ।

গ্রীক মিথোলজির এই গল্পের বিভিন্ন রূপে আছে। একটা মানসিক ডিজওর্ডার আছে নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজওর্ডার নামে। তবে সেটার মানসিক সমস্যার দিক নিয়ে কথা বলা এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয়।

আধুনিক যুগে মানুষেরা অধিকতর নার্সিসিস্টিক হয়ে যাচ্ছে এমন কথা শোনা যায়। অনেকেই বলে থাকেন, পত্রিকাতেও আসে। কিন্তু মানুষেরা নার্সিসিস্টিক হচ্ছে না একোইস্টিক হচ্ছে সেটা বুঝা দরকার।

একোইস্টিক বলতে কোন ইংরেজি শব্দ নাই মনে হয়। একোইজম বলে আছে তবে সেটার অর্থ আমার এই লেখা কিংবা একোইস্টিক শব্দের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন নয়। একোইস্টিক শব্দটি নার্সিসিস্টিক এর সাথে মিল রেখে বলা।

নার্সিসিস্টিক একটা লোক কী করে? সে নিজের প্রেমে মগ্ন। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তার নিজের নিজস্ব ইগো থাকে। সে কোথাও তার স্বীকৃতি বা বৈধতা খুঁজে না। যেন সে গায় হাসন রাজার গান –

“আমা হইতে আসমান জমিন আমি হইতেই সব। আমি হইতে ত্রিজগত্, আমি হইতে সব ।”

কিংবা রবীন্দ্রনাথ  থেকে-

“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,

                          চুনি উঠল রাঙা হয়ে।

                      আমি চোখ মেললুম আকাশে,

                          জ্বলে উঠল আলো

                               পুবে পশ্চিমে।

                   গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম “সুন্দর’,

                               সুন্দর হল সে।”

এক্ষেত্রে সৃজিত মুখার্জির নির্বাক ফিল্মের প্রথম গল্পটার কথা স্মরণ করা যায়। যেখানে নার্সিসিস্টিক চরিত্রে অভিনয় করেন অঞ্জত দত্ত।

ফিল্মে দেখা যায় অঞ্জন দত্ত নিজেই নিজেকে আয়নাতে দেখেন। শেভ টেভ করে, পারফিউম সহ যাবতীয় মাঞ্জা মেরে ঘর থেকে বের হন। তখন তার এক প্রতিবেশীর সাথে তার দেখা হয়। প্রতিবেশী তার সাথে কথা বলেন। কিন্তু নার্সিসিস্টিক চরিত্র অঞ্জন দত্ত তাকে তেমন পাত্তা দেন না। তিনি তাকে কেমন লাগছে, ভালো লাগছে কী না খারাপ লাগছে, সেটা জানতে কোনরূপ আগ্রহ বোধ করেন নি। কারণ তিনি জানেন এবং বিশ্বাস করেন তাকে ভালো লাগছে। তিনি সেরা। এই বিশ্বাসের ফলেই তিনি নার্সিসিস্টিক। তার এই নার্সিসিস্টিক ইগো এক গুরুত্বপূর্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

ছবিঃ নির্বাক ফিল্মের একটি দৃশ্য।
ছবিঃ নির্বাক ফিল্মের একটি দৃশ্য।

আবার আরেক জায়গায় দেখা যায় তিনি সুস্মিতা সেনের সাথে গিয়ে বসেন পার্কে। একটা সুন্দরী মেয়ের সামনেও তিনি সামান্য নরম হন নি। আগের মতই নিজের দম্ভ নিয়ে বাদাম খান। সুস্মিতা সেন আগ্রহী হয়ে তার সাথে কথা বলেন।

একটা দারুণ নার্সিসিস্টিক ক্যারেক্টার।

কিন্তু এই জায়গায় একো হলে কী করত? একো তার সৌন্দর্যের স্বীকৃতি চাইত।

একো তার সৌন্দর্যের স্বীকৃতি চায় নার্সিসাসের কাছে। নিবেদিত প্রেম নার্সিসাস যদি গ্রহণ করত সেটাই হত একোর সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি। এখানে নার্সিসাসের পরিবর্তে অন্য কোন তরুণ হলে সুন্দরী নিম্ফ একোকে তার সৌন্দর্যের স্বীকৃতি দিয়ে দিত ধরা যাক। তাহলে আমরা সেই তরুণ এবং নিম্ফ একোর একটা মিলন দৃশ্য প্রত্যাশা করতে পারতাম এবং সেটা খুব স্বাভাবিক।

এই ধরনের হাজার হাজার একো আছে আমাদের চারপাশে। যারা সৌন্দর্যের স্বীকৃতি চায়। সেই স্বীকৃতির জন্য সৌন্দর্য বাড়ানোর চেষ্টা চলে, চেষ্টা চলে মর্মান্তিক ডায়েট কন্ট্রোলের। মানুষের ভেতরের এই ‘একোর মনোভাব’ ব্যবহার করেই রঙ ফর্সাকারী ক্রিমসহ প্রসাধনী শিল্পের অধিকাংশ বিজ্ঞাপন নির্মান করা হয়।

আধুনিক বিশ্বে একো অনেক অনেক মানুষের কাছে তার সৌন্দর্যের স্বীকৃতি চায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের ছবিতে সে অনেক অনেক লাইক চায়। একেকটা লাইক তার এক একটা ডিজিটাল স্বীকৃতি। তবে সব স্বীকৃতির ক্ষেত্রেই মিথলোজিক্যাল মিলন দৃশ্য সম্ভব না। তবে সেটা স্বীকৃতি দানকারীর ফ্যান্টাসী কিংবা একোর ফ্যান্টাসীতে থাকতেও পারে। সেটা বিবেচ্য নয়, বিবেচ্য হল একোর স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা, স্বীকৃতি পাবার আকাঙ্খা।

সেটা অবশ্যই নার্সিসাসের চেয়ে ভয়ংকর। নার্সিসাস দুনিয়াকে পুছে না। কেউ তাকে ভালো বলে, খারাপ বলে কিংবা যদি অসুন্দর বলে তাতে তার আগ্রহ নেই। নিজের প্রতিই তার আগ্রহ।

আর একোর আছে স্বীকৃতি পাবার আকাঙ্খার ভয়ানক দিক। এজন্য যদি তার ওয়েট একটু বেশি হয় তাহলে সে নিজেকে ইনফিরিয়র মনে করে, তার গায়ের রঙ কালো হলে সে নিজেকে ইনফিরিয়র ভাবে। কারণ সে এগুলোকে মনে করে স্বীকৃতি পাবার পেছনে বাঁধা বা অন্তরায়।

নার্সিসাসদের চাইতে অনেক অনেক বেশি সংখ্যায় একো বিদ্যমান আধুনিক সমাজে। আধুনিক সমাজে নার্সিসাসদের সমস্যাযুক্ত হিসেবে দেখা হয়। সে অনুপাতে একোদের ধরা হয় স্বাভাবিক। এর পিছনের কারণটা অর্থনৈতিক। একোদের স্বীকৃতি পাবার চেষ্টা, সৌন্দর্য বর্ধনের চেষ্টার উপর যেহেতু ক্যাপিটালিস্ট সমাজের অনেক বড় অংশ নির্ভর করে নিজেদের ব্যবসাপাতির জন্য তাই একোদের স্বীকৃত প্রাপ্তির আকাঙ্খাকে নিয়মিত উশকে দেয়া হয়।

ছবিঃ ফেয়ার এন্ড লাভলীর এড। একোদের জন্য আরো আছে ফটোশপ।
ছবিঃ ফেয়ার এন্ড লাভলীর এড। একোদের জন্য আরো আছে ফটোশপ।

স্বীকৃতি পাবার চেষ্টায় একো যদি কোন ভাল কাজ করে সেটা খারাপ না। তার স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া ইত্যাদিতে কোন আপত্তি থাকার কথা না কারো। কিন্তু যখন তার এই স্বীকৃতির আকাঙ্খা ভয়ানক পর্যায়ে উন্নিত হয় তখন স্বীকৃতির অপ্রাপ্তি তাকে মারাত্মক মানসিক যাতনার সম্মুখীন করে দেবে। যেরকম যাতনা মিথোলজির নিম্ফ একো নার্সিসাস দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে অনুভব করেছিল।

মিথে দেখা যায় নার্সিসিজম এবং একোইজম দুটাই আত্মবিধ্বংশী। কিন্তু নার্সিসাসের ধ্বংশ নিজের আনন্দে এবং একোর ধ্বংশ নিজের বেদনায়। এটা যেন একটি আনন্দ বেদনার কাব্য।

মনে হয় নার্সিসিজম কিংবা একোইজম থেকে দূরে থাকার উপায় হতে পারে মহাবিশ্বের বিশালতার সাপেক্ষে নিজের ক্ষুদ্রতাকে বুঝতে পারা (অথবা ডায়োজিনিসের সিনিসিজম)। তবে এতে আবার কীকেগার্ডের মডার্ন আয়রনী তথা নায়ালিজমের উত্থানের সুযোগ থাকে।


এই লেখাটি অনন্যায় প্রকাশিত হয় পরে। সাহিত্যিক মোজাফফর আহমেদ লেখাটি এখান থেকে নিয়ে ওখানে ছাপান। তার গল্পের বই নিয়ে এই ব্লগে একটি আলোচনা আছে। পড়ে দেখা যেতে পারেঃ মোজাফফর হোসেনের পাঁচটি গল্পঃ ক্রিটিক্যাল পাঠ

নির্বাক ফিল্ম

1 thought on “আধুনিক সমাজে একো এবং নার্সিসাস”

  1. Pingback: শাদাবাজিঃ আসুন, বসুন, শাদা হোন | @ মুরাদুল ইসলামের ব্লগ

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং