মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » কথাবার্তাঃ জর্ডান পিটারসন বিষয়ে

কথাবার্তাঃ জর্ডান পিটারসন বিষয়ে

জর্ডান পিটারসন বিষয়ে আপনি একটি লেখা লিখেছেন এই ব্লগে দেখলাম, তার সম্পর্কে কিছু বলেন?

কানাডিয়ান একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তিনি। ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টোর অধ্যাপক। আর আমার লেখাটি পিটারসন নিয়ে ছিল না তেমন, লজিক্যাল ফ্যালাসি নিয়ে ছিল। যে ফ্যালাসি তর্কে অনেক লোকই করে থাকেন।

পিটারসন সম্পর্কে কবে জানতে পারলেন?

বেশ কিছুদিন আগে তার একটা ইউটিউব ভিডিও দেখেছিলাম। কিন্তু ব্যক্তি কে তা জানার ইচ্ছা হয় নি বেশী। পরে সম্প্রতি বিবিসির সাথে ইন্টারভিউ ভাইরাল হবার পর তিনি বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠলেন তখন জানলাম।

এই সাক্ষাৎকারটা ইন্টারেস্টিং ছিল।

তা ছিলো। ভদ্রমহিলার বাজে তর্কের কারণেই তিনি নায়ক বনে গেছেন সাক্ষাৎকারে।

আপনি কি তার মত সমর্থন করেন?

তিনি সাক্ষাৎকারে নারীবাদের সমালোচনা করতে মাল্টিভ্যারিয়েট স্টাডির উদাহরণ দিয়েছেন। মাল্টিভ্যারিয়েট স্টাডিতে বিভিন্ন ভ্যারিয়েবল নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়। তার উল্লেখ করা স্টাডি আমি পড়ি নি তাই বলতে পারছি না। নারীদের প্রায় সব ক্ষেত্রেই অনেক বাঁধার মুখে পড়তে হয়। বিশেষত আমাদের সমাজে। তাদের দাবি ভুল নয়।

আর অন্যান্য মত, তার বই নিয়ে কিছু কী বলবেন?

বইটা আমি দেখেছি। ১২ রুলস অব লাইফ। তার ১ ঘন্টা ৩০ মিনিটের একটি লেকচার শুনেছি বইটি বিষয়ে। কথা শুনতে খারাপ লাগে নি। কিন্তু বইতে তিনি যা লিখেছেন তার বেশীরভাগই কমন সেন্স।

দ্বিতীয়ত সমাজের হায়ারার্কি নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি লবস্টারের উদাহরণ দেন। যেসব লবস্টার বুক চিতিয়ে হাঁটে তাদের শরীরে সেরোটোনিন নামে এক ধরণের হরমোন থাকে বেশী। এরাই সমুদ্রতলে বেশী দখল নিতে পারে। আর অন্য লবস্টার যারা বুক চিতিয়ে হাঁটে না এরা পরাজিত হয়ে থাকে, এবং এদের শরীরে অক্টোপামিন না কি যেন হরমোন বেশী থাকে। এই উদাহরণ দিয়ে তিনি মানুষের হায়ারার্কিও ব্যাখ্যা করতে চান। তিনি বলেন সমাজের হায়ারার্কিতে যারা উপরে থাকে তারা এই বুক চিতিয়ে থাকা লবস্টারের মতো। ফলে যুবকদের তিনি বুক চিতিয়ে হাঁটার পরামর্শ দেন।

সোশ্যাল ডারউনিজিম নাকী?

হ্যা, তিনি সরাসরি প্রতিযোগীতাকে গুরুত্ব দেন। তার কথামতে লাইফ হলো প্রতিযোগীতা। অবশ্য ওয়েস্টের ক্যাপিটালিজমী সমাজে এই বয়ান উহ্য থাকে। তিনি কেবল সরাসরি বলছেন। কিন্তু তার লবস্টার ব্যাখ্যা খুব যৌক্তিক কিছু নয়।

জাকোবিন এবং গার্ডিয়ান পত্রিকা তার বেশ ভালো সমালোচনা করেছে। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?

হ্যা, এর আগে তিনি কেবল ছিলে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, অধ্যাপক। যিনি ইউটিউবে ভিডিও বানান, তার কথায় “ইয়াং ম্যান”দের জন্য। সেই ইয়াং ম্যানদের কাছে তার জনপ্রিয়তা ছিল। অনেকটা কাল্টের মতোই।

কিন্তু বিবিসির সাংবাদিকের সাথে তার সাক্ষাৎকার ভাইরাল হয়ে যাবার পর তিনি ইন্টেলেকচুয়াল দুনিয়ায় অনেকের নজরে এসেছেন। কোন কোন পত্রিকা বলছে মার্শাল ম্যাকলুহানের পর তিনিই আরেকজন কানাডিয়ান বুদ্ধিজীবী যে এত গুরুত্বপূর্ন হলেন।

গার্ডিয়ানের লেখকের সমালোচনা আমার ভালো লাগে নি, পয়েন্টলেস আক্রমণ মনে হয়েছে, কিন্তু জাকোবিন এর প্রবন্ধটি ভালো হয়েছে। তারা কিছু পয়েন্ট ধরে পিটারসনের সমালোচনা করতে পেরেছে। যেমন, পিটারসনের মার্ক্সিজম এর সমালোচনা হচ্ছে নীৎসে প্রভাবিত, ইত্যাদি।

পিটারসন সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন?

আমি তার বেশী কিছু পড়ি নি বা বেশী ভিডিও দেখি নি। তবে তাকে আমার ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। যেমন, যে ভিডিও লেকচার তার শুনলাম তাতে বিরক্তি লাগে নি। কথা ভালো বলেন।

কিছুটা পশ্চিম বা হোয়াইট আভিজাত্যবাদী। এবং নৃতত্ত্ব ও পোস্ট মডার্ন অনেক স্টাডির বিরুদ্ধে তার অবস্থান হাস্যকর। তবে এসবই তাকে হতাশ হোয়াইট ইয়াং ম্যানদের কাছে কাল্টের নেতার মতো ফিগার বানিয়েছে।

হোয়াইট আভিজাত্যবাদী মানসিকতা একজনের থাকতে পারে না যখন সে জ্যারেড ডায়মন্ড বা এরকম সিরিয়াস গবেষকদের লেখা পড়ে। কিন্তু এগুলিকে ভ্রান্ত বলে উড়িয়ে দিলে তো হবে না।

পশ্চিমা পুঁজিবাদী সমাজ অনেক হতাশা তৈরী করে। এমিল ডুর্খেইম যা বলেছিলেন, পুঁজিবাদ বিশ্বাস করায় সব সম্ভব, আপনি বিশাল ধনী হতে পারবেন। কিন্তু যখন লোকে এসব করতে গিয়ে পারে না তখন তারা হতাশ হয়, ব্যর্থ অপটিমিস্টিকেরা।

পিটারসন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট হিসেবে এই হতাশ ইয়াং ম্যানদের ভিডিওর মাধ্যমে সাহায্য করছেন। এটা ভালো। মার্ক্সবাদ নারীবাদ ইত্যাদির অযৌক্তিক কিছু বিরোধীতা ছাড়া তার বাকী কথাগুলো সেলফ-হেল্প জাতীয়।

যেমন, অন্যের সফলতার সাথে নিজেকে তুলনা করবেন না। অন্যের সাথে নিজের তুলনা করবেন না। গতকালকে আপনি যা ছিলেন, তার সাথে আজকের আপনার তুলনা করুন। প্রতিদিন একটু একটু করে বেটার হতে থাকেন।

এছাড়া তিনি তার ইয়াং ম্যানদের দায়িত্ব নিতে বলেন। এসব ভালো কথাই।

 

তার সাইকোলজিকে জাকোবিন পপ সাইকোলজি বলেছে, এ ব্যাপারে কী বলবেন?

তিনি ফ্রয়েড, গুস্তাব জাং প্রভাবিত। এছাড়া সোলঝেনিৎসিন প্রভাবিত। তার পড়ালেখা ভালো।

পপ সাইকোলজি বলা যায় যখন গুস্তাব জাং এর তত্ত্বগুলিকে এই ক্যাটাগরিতে ফেলা হবে।

 

স্টোয়িসজমের সাথে তার চিন্তার মিল আছে এ নিয়ে বিতর্ক দেখেছিলাম এক স্টোয়িক গ্রুপে। এ নিয়ে আপনার মত কি?

মিল বলতে কিছু স্টোয়িক আচরনের মিল আছে আর কি। দর্শনের মিল নেই। স্টোয়িসিজম হচ্ছে ম্যানলি ফিলোসফি, একইভাবে জর্ডানের প্রচারও মাসকুলিন। তাই মিল আছে মনে হয়। কিন্তু আসলে বৃহত্তর অর্থে মিল নেই। তিনি স্টোয়িকদের রেফারেন্স দিয়েছেন এমন শুনি নি। তবে তার অনেক চিন্তা স্টোয়িক প্রভাবিত হতে পারে।

 

মাসকুলিনিটির একটা ক্রাইসিস তৈরী হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে, এজন্যই কি জর্ডানের চিন্তা জনপ্রিয়তা পেল?

হতে পারে, এই ক্রাইসিসের উপস্থাপন আমরা ফাইটক্লাব ফিল্মে দেখেছিলাম। নায়ক এডওয়ার্ড নর্টনের অন্য স্বত্তা হচ্ছে তার মাসকুলিনিটির নিরন্তর অপমৃত্যু হতে হতে হঠাৎ জেগে উঠা এক ভায়োলেন্ট স্বত্তা। যেটা পরবর্তীতে বিধ্বংসী আকারে বের হয়। যেমন, ওয়েস্টে আমরা প্রায়ই শুনি অস্ত্র হাতে স্কুলের ছাত্র স্কুলে গিয়ে গুলি করছে। এইরকম ভয়ংকর প্রকাশ হয়। মনে হয় এই মাসকুলিনিটির ক্রাইসিসে জর্ডান তাদের সাহায্য করতে পারছেন।

 

উদারপন্থীরা তাকে কনজারভেটিভ বলে যে আক্রমণ করছেন এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?

তিনি নিজেকে বলেন ব্রিটিশ লিবারেল। উদারপন্থীরা তাকে রক্ষণশীল বলছেন কারণ তার কিছু চিন্তা রক্ষণশীলদের পক্ষে যায়। তিনি আবার পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের বিপক্ষে, ফ্রি স্পিচের পক্ষে সরব।

 

তবে কাল্ট ফিগারটি মনে হয় খারাপ?

তা খারাপ। এসব ক্ষেত্রে ভয়ংকর ব্যাপারটা হলো কাল্টের নেতা নিজের ভুল বুঝতে পারলেও মত পরিবর্তন করেন না ফলোয়ারদের ভয়ে। এমন বাস্তবে হয়েছে যে কন্সপিরেসী থিওরিস্ট নেতা তার মত পরিবর্তন করায় ফলোয়ারদের আক্রমণে তার জীবন বিপন্ন হয়েছে, অন্য নাম পরিচয় নিয়ে, অন্য আরেক জায়গায় গিয়ে তার বাস করতে হয়েছে। কয়েকদিন আগে একটা পডকাস্টে তা শুনেছিলাম।

 

জর্ডানের দুয়েকটা ভালো আইডিয়ার কথা বলবেন কী?

আমার একটা জিনিস পছন্দ হয়েছে, তিনি যেভাবে ইতিহাসের খারাপ ঘটনা পড়তে বলেন। আমার মনে হয়েছে এটি আমাদের এক মারাত্মক বায়াস দূর করতে কাজ করতে পারে। যখন আমরা ইতিহাসে পড়ি নাৎসীরা নিরীহ ইহুদিদের মারছে, পাকিস্তানি আর্মি নিরীহ বাঙালী মারছে ইত্যাদি, তখন আমরা নিজেদের নায়কের ভূমিকায় স্থাপন করি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়লে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা ভাবি, যিনি বাঁচাচ্ছেন সবাইকে। দেশের হয়ে লড়ছেন। কিন্তু কখনোই রাজাকার ভাবি না।

কিন্তু এখানে উলটা ভাবাটা দরকারী। উলটা ভাবলে আমরা বুঝতে পারবো যে আমাদের ভিতরেও দানব আছে, এবং ঐ পরিস্থিতিতে সে জাগ্রত হতে পারে। নিজের ভেতরের দানব সম্পর্কে সচেতন থাকা তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রথম ধাপ বলা যায়।

তাই এভাবে ইতিহাস পড়লে আমরা নিজের সম্পর্কে, নিজেদের ভালোমানুষী ও নায়কত্ব নিয়ে অহমিকা বা ভ্রান্তিতে থাকবো না। এর ফলে যদি কখনো এমন পরিস্থিতিতে আমরা পড়ি, যেখানে নিরীহরা নির্যাতীত হবে আমাদের দ্বারা, তখন আমরা বিরত থাকতে পারব। কারণ নিজেদের ভেতরের দানব সম্পর্কে আমরা আগেই সচেতন ছিলাম।

অন্যথায় এমন হতে পারে যে, ভালোমানুষী করছি ভেবে করে ফেলতে পারি ভয়ানক কাজ।

আরেকটি আইডিয়া পেয়েছি তার কোরা উত্তর থেকে। সেটা হলো স্মল টকের গুরুত্ব। এটা ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাজে লাগবে মনে হচ্ছে। কারণ সাধারণত আমি স্মল টক অর্থাৎ কেমন আছেন ভালো আছি টাইপের কথাবার্তা থেকে দূরে থাকি। পিটারসনের কথা হলো, স্মল টক আপনি না করলে অন্যরা আপনাকে কিছুটা নার্সিস্টিক ও আত্মকেন্দ্রিক ভাববে। এবং স্মল টকের মাধ্যমেই আপনি অন্য আরেকজনের ব্যাপারে জানা শুরু করতে পারেন। যদিও বিরক্তিকর এক জিনিস, তথাপি মনে হলো এর গুরুত্ব হয়ত আসলেই আছে।

 

আমাদের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, স্যার।

আমার সাথে কথা বলার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ, স্যার।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং