মুরাদুল ইসলাম » সাহিত্য » টলস্টয় বিষয়ে প্রশ্নোত্তরে প্রখ্যাত রাশান সাহিত্য সমালোচক পাভেল বাসিনস্কি

টলস্টয় বিষয়ে প্রশ্নোত্তরে প্রখ্যাত রাশান সাহিত্য সমালোচক পাভেল বাসিনস্কি

 

 

(রাশিয়া বিয়ন্ড দ্য হেডলাইনস- পত্রিকার পাঠকদের টলস্টয় বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দেন রাশার বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক পাভেল বাসিনস্কি। বাংলায় এর রূপান্তর করা হল। এখান থেকে লেখকদের জন্য টিপস-১ এবং টিপস-২ এর মত কেউ কেউ উপকৃত হতে পারেন। )

 

পাভেল বাসিনস্কি

 

ডাগ লরেন্সঃ অনেক রাশান বন্ধুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় স্কুলে তারা টলস্টয় পড়তে বাধ্য হয়, এজন্য স্কুল শেষ করার পর আর টলস্টয় পড়েই না। আন্না কারেন্নিনা বা ওয়ার এন্ড পিস পড়ার জন্য আসলে কি কোন সঠিক বয়স আছে?

 

পাভেল বাসিনস্কিঃ কেউ টলস্টয় পড়ে বিরক্ত হলে, এটা তার সমস্যা। ওয়ার এন্ড পিস এবং আন্না কারেন্নিনা পড়ার সঠিক কোন বয়স আছে কি না আমি জানি না। ১৯ শতকে গ্রামার স্কুলের সব সিরিয়াস ছাত্ররা ওয়ার এন্ড পিস পড়ত। এটা ঠিক, সময় অনেক বদলে গেছে। কিন্তু এখনো আমি মনে করি এই দুই উপন্যাস না পড়ে আপনি নিজেকে শিক্ষিত বলতে বা শিক্ষিত রাশান দাবী করতে পারবেন না।

 

 

ভন আপফেলস্ট্রুডেলঃ তিনটি টুইটের মাধ্যমে আপনি কীভাবে ওয়ার এন্ড পিস কে সামারাইজ করবেন?

 

পাভেল বাসিনস্কিঃ ১। সাধারণভাবে বললে, একটি যুদ্ধবিষয়ক বই ২। একটি বই যা ঘোষনা দেয় ভালোবাসা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে  ৩। একটি বই যা দেখায়, কীভাবে খারাপ লোকেরা সহজে একত্রিত হতে পারে, এবং ভালো মানুষদের জন্য একত্র হওয়া কত কষ্টকর। এটি একটি খারাপ ব্যাপার।

 

লুইস হুইটঅর্থঃ টলস্টয় কেন শেষ জীবনে এসে ওয়ার এন্ড পিস কে অস্বীকার করেছিলেন, এমনকী তিনি এই উপন্যাসের জন্য লজ্জিত হয়েছিলেন? যদিও এটি তার একটি সেরা কাজ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন এবং রাশান সাহিত্যেরও শ্রেষ্ট একটি উপন্যাস ছিল।

 

পাভেল বাসিনস্কিঃ হ্যা। টলস্টয় ওয়ার এন্ড পিস এবং আন্না কারেন্নিনা লেখার জন্য লজ্জিত হয়ে উঠেছিলেন। এটি ছিল তার স্পিরিচুয়াল কিছু পরিবর্তনের জন্য, যখন তিনি তার পূর্বের সমস্ত কাজ নতুন ধর্ম বিশ্বাসের কারণে অস্বীকার করেছিলেন। একই ব্যাপার ঘটেছিল গগল এর ক্ষেত্রেও। গগল তার জীবনের শেষদিকে ডেড সউল, দি গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টর অস্বীকার করেন। টলস্টয়ের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা ঘটেছিল অনেক আগে, যখন তিনি পঞ্চাশ বছরে পৌছেছেন। তিনি মানসিকভাবেও সুস্থ ছিলেন। একে রাশান ভাগ্য বলা যায়, রাশানরা হঠাৎ করে নিজের করা পুর্বের সবকিছু ত্যাগ করার ব্যাপারে খ্যাত। আমাদের ইতিহাসের দিকে দেখুন, প্রথমে ১৯১৭ তে, তারপর আবার ১৯৯১। সমাজের জন্য এটি খারাপ জিনিস। কিন্তু কারো জীবনের ক্ষেত্রে যখন ঘটে তখন বেশ আগ্রহ উদ্দীপক।

 

Tolostoy
বিশ বছর বয়েসে টলস্টয়

 

 

নাটালিয়া এন্টোনোভা ,ডেপুটি এডিটর ইন চিফ, মস্কো নিউজঃ চার্চের সাথে এখন অনেক মানুষের বিরোধ হচ্ছে, সুতরাং চার্চের সাথে টলস্টয়ের বিরোধ ভেবে দেখার মত বিষয় হতে পারে।

 

পাভেল বাসিনস্কিঃ চার্চের সাথে টলস্টয়ের বিরোধটা ছিল বেশ জটিলতাপূর্ণ। আমি বর্তমানে এ নিয়ে একটি বই লিখছি। সংক্ষিপ্তাকারে বললে দাঁড়ায়, মূল খ্রিস্টান ধর্মের বৃদ্ধি বা যিশুর প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপারে তিনি চার্চকে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি যিশুকে নবী এবং শিক্ষক মনে করতেন। তার কথা ছিল, যিশু মেরী ও তার স্বামী জোসেফের পুত্র। এখানে ঈশ্বরের পুত্র বিষয়টাকে তিনি মানেন নি। মেরীর কুমারীত্ব, চির পবিত্রতার ধারণা, কিংবা কেয়ামত তথা শেষদিবসে পুনরুত্থানের বিষয়ও তিনি মানেন নি। এগুলোই মূলত চার্চের সাথে তার বিরোধের কারণ ছিল। শুধু চার্চের সাথে না, যেহেতু সরকারের রাষ্ট্রধর্ম ছিল অর্থডোস্কি, তাই সরকারের সাথেও তার বিরোধের সৃষ্টি করে।

১৯০৫ সালে রাশান সম্রাটের চিন্তা ও প্রেসের স্বাধীনতা বিষয়ক আইন করার পূর্বে টলস্টয়ের ধর্ম সংক্রান্ত লেখাগুলো রাশায় প্রকাশিত হয় নি। এগুলোকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। রাশান ভাষায় এগুলো যুক্তরাজ্য এবং সুইটজারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এবং বে-আইনিভাবে রাশায় আনা হত। এগুলো প্রচার বা বিক্রি করার সময় কেউ ধরা পড়লে তাকে দেয়া হত সাইবেরিয়ায় নির্বাসন। এক্ষেত্রে টলস্টয়ের সেক্রেটারী নিকোলাই গুসেভ এর নাম করা যায়। কিন্তু টলস্টয়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও প্রভাবের কারণে তার বিরুদ্ধে কিছু করা হয় নি। এই পলিসি করেছিলেন [কন্সটান্টাইন] পবেদোনস্টেভ, যিনি সম্রাটের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান ছিলেন।

বিষয়টা এমন ছিল যে, টলস্টয়ের ধর্মীয় লেখা রাশা থেকে প্রকাশিত হতে পারবে না, যারা এগুলো প্রচারে ধরা পড়বে তারা হবে নির্যাতিত কিন্তু টলস্টয় নিজে যেন শান্তিতে তার ‘ইয়াসনায়া পলায়ানা এস্টেটে’ থাকতে পারেন, গভীর হতাশার ভেতর।

এটাই ছিল চার্চের প্রতি তার বিরক্তির কারণ, যা প্রকাশ পেয়েছিল তার প্রবন্ধ অন ক্লার্গি এবং রেসাক্রেশন উপন্যাসের কয়েক পাতায়, যেখানে তিনি ব্যঙ্গাত্বকভাবে হলি কমিউনিয়ন তথা খ্রিস্টের শেষ ভোজনের বর্ননা দিয়েছিলেন। এই দুটি কাজের পর চার্চের পরিচালকেরা ঘোষনা দেন, টলস্টয় আর অর্থডোক্স বলে বিবেচিত হবেন না।

এটা আসলে সত্যি ছিল। টলস্টয়কে অর্থডোক্স বলা বেশ শক্ত। কিন্তু তখনকার দিনের সেই অফিসিয়ালী গির্জার এই বিবৃতি ঘোষনা করল, টলস্টয়কে অর্থডোক্স রাষ্ট্রে একজন পারসোনা নন গ্রাটা* হিসেবে।

তার বিশ্বাস তাকে বিরত রাখল ইসলাম কিংবা ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করা থেকে এবং তখন রাশায় কেউ অফিসিয়ালি এথিস্ট হতে পারত না। সমাজ দু ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একভাগ, যারা শাসকদের মতকে গ্রহণ করে টলস্টয়কে খ্রিস্টান ধর্ম এবং তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত শত্রু মনে করত। আরেকদল, পুরো ব্যাপারটাকে অস্বীকার করেছিল, এই গ্রুপে কিছু পাদ্রীও ছিলেন। এর ফলে টলস্টয়ের চার্চের সাথে বিরোধ সমাজে বিভক্তির সৃষ্টি করে বিপ্লব ত্বরান্বিত করেছিল। আমি এই বিরোধকে ‘পুসি রায়টের’ ইতিহাসের তুলনা করব না, যদিও অনেকে করেছেন। কিন্তু টলস্টয় ব্লাশফেমির বিরুদ্ধে যে প্রবন্ধগুলো লিখেছিলেন তখন চার্চের বিরুদ্ধে সেগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, বর্তমানেও সমাজ আবারো ভাগ হচ্ছে, যা রাশার জন্য বিপদজনক।

[*নোটঃ পারসোনা নন গ্রাটাঃ রাষ্ট্রে আন ওয়েলকামড পার্সন, যার রাষ্ট্রে আগমন বা বসবাস আইনসিদ্ধ নয়।]

 

ফিল হিটককঃ ২১ শতকের টলস্টয় কে হবেন?

 

পাভেল বাসিনস্কিঃ আমি মনে করি না কেউ তার সাথে তুলনীয়। কখনোই আর কোন টলস্টয় আসবেন না, যেমন আর কোন দস্তয়ভস্কি হবে না। আসলে আমাদের নতুন কোন টলস্টয়ের দরকারও নেই। একজনকেই বুঝতে যথেষ্ট মাথা খাটানোর দরকার পড়বে।

 

 

ম্যাক্স মোনাস্টাইরেভঃ টলস্টয় কীভাবে এই মহাবিশ্বে আমাদের সংঘাতপূর্ন ক্ষুদ্র অবস্থানকে ব্যাখ্যা করেছেন?

 

পাভেল বাসিনস্কিঃ তিনি একটি সমস্যার কথাই বলেছেন – বিশ্বাসের অভাব। যে মানুষ ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখে সে একজন সুখী মানুষ। এক্ষেত্রে জীবন হচ্ছে দুই অনন্ত শূন্যতার মধ্যবর্তী ক্ষুদ্র অবস্থা। এক অনন্ত শূন্যতা জন্মের আগে, আরেক অনন্ত শূন্যতা মৃত্যুর পরে। টলস্টয়ের মতে, মৃত্যু অনন্ত শূন্যতায় জাগরণ।

 

আন্তাসিয়া লীঃ লিও টলস্টয়ের প্রিয় বই ছিল কোনটি?

 

পাভেল বাসিনস্কিঃ যতদুর আমি জানি, তার কোন প্রিয় বই ছিল না। তিনি নিউ টেস্টামেন্ট বার বার পড়তেন। তিনি প্যাসকেলের প্রসংশা করেছেন। রাশান লেখকদের মধ্যে তিনি পুশকিন এবং গগল কে পছন্দ করতেন। বিদেশী লেখকদের মধ্যে স্টেন্ডাল এবং ডিকেন্স ছিলেন তার প্রিয় লেখকদের মধ্যে।

 

ভসেবলড পুলিয়াঃ “ফ্লাইট ফ্রম দি প্যারাডাইস” বইয়ের নাম কেন হল? এর পিছনের কাহিনী কি?

 

পাভেল বাসিনস্কিঃ এখানে প্যারাডাইস একটি রূপক, যা ইয়াসনায়া পলায়ানা এস্টেট এবং টলস্টয়ের পরিবারের অর্থে। এই রূপক আসলে বিদ্রুপাত্বক হয়ে গিয়েছিল, যখন শেষজীবনে টলস্টয় লিখেছেন – “এই বাড়িতে আমি নরকের মত সিদ্ধ হচ্ছি”। যদিও, তার সেরা সময়গুলো কেটেছে এই বাড়িতে। এখানেই তিনি তার শ্রেষ্ট লেখাগুলো লিখেছেন। আসলে আমিও জানতে আগ্রহী, তিনি কেন সেই স্বর্গ থেকে পলায়ন করেছিলেন।

 

 

ইভান শট্রেফঃ এটা কি সত্যি টলস্টয়ের অনেক বিবাহ বহির্ভূত সন্তানাদি ছিল? তাদের মধ্যে কেউ কি লেখক হয়েছে?

 

পাভেল বাসিনস্কিঃ টলস্টয়ের একটি বিবাহ বহির্ভূত সন্তানের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে বলা যায়। আক্সিনিয়া বাজিকিনা নামের এক বিবাহিত কৃষাণী মহিলার গর্ভে এই সন্তানের জন্ম হয়। টলস্টয়ের সোফিয়া আন্দ্রেভনাকে বিয়ের পূর্বে এটি ঘটেছিল। বিয়ের পর তিনি স্ত্রীর কাছে বিশ্বস্ত ছিলেন। ইয়াসনায়া পলায়ানাতে ছেলেটি থাকত এবং টলস্টয়ের ছেলেদের কোচোয়ানের কাজ করত। পরে সে আত্মহত্যা করে। অভিজাতন্ত্রে এটাই ছিল বিবাহ বহির্ভূত সন্তানদের স্বাভাবিক পরিণতি। তারা নিজেদের সুপিরিয়র ভাবতে শুরু করত, যেহেতু তাদের বাবা অভিজাত বংশের। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত দেখতে পেত যেখানেই জন্মেছে সেখানেই রয়ে যাচ্ছে। রাশা তখন অর্থডোক্স রাষ্ট্র ছিল, চার্চে বিয়ের মাধ্যমে, চার্চের নামকরন, এবং বিশেষ বইয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে জন্মের পর শিশুরা আইনি মর্যাদা পেত। তাই টলস্টয় চাইলেও তার বিবাহবহির্ভূত সন্তানকে আইনগত উত্তরাধিকারী করতে পারতেন না। এছাড়া, আক্সিনিয়ার স্বামী ছিল এবং সোফিয়া ছিলেন একজন ভয়ংকর হিংসাকাতর মহিলা।

 

টলস্টয়ের স্ত্রী সোফিয়া এবগ তাদের মেয়ে আলেক্সান্দ্রা, ছবি-উইকিপিডিয়া

 

 

 

 

আন্তোনিও আন্দ্রেওত্তিঃ আমি জানতে চাই, আমার মত আপনিও কি মনে করেন দি ক্রুয়েটজার সোনাটা টলস্টয়ের অন্যতম সেরা কাজ? যদি হ্যা হয়, আপনি কেন তা মনে করেন? যদি না হয়, তাহলে তার কারণ কি?

 

পাভেল বাসিনস্কিঃ দি ক্রুয়েটজার সোনাটা অবশ্যই টলস্টয়ের সেরা একটি মাস্টারপিস। এটি একটি ভিন্নরকম গল্প, একই সাথে ভয়ংকর, ঠিক টলস্টয়ের চরিত্রের সাথে যায় না। টলস্টয় ছিলেন একজন ফ্যামিলি ম্যান। সোফিয়ার সাথে তার ১৩ সন্তানাদি। ক্রুয়েটজার সোনাটাতে সেক্সুয়াল ডিজায়ার থেকে জেলাসি, এবং তা থেকে মার্ডার ইত্যাদি রূপকার্থে বুঝিয়েছেন। আরো দেখিয়েছেন মিউজিক কীভাবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে। টলস্টয় কারণ ছাড়াই কোন কিছু নিয়ে ভীত ছিলেন।

 

*রাশান নামগুলো ঠিকমত লেখার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে।

*প্রথম ছবি-thekompass.rbth.co.uk ; দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ছবি- উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং