মুরাদুল ইসলাম » গল্প » সাই ফাইঃ বিষাক্ত দ্বীপ

সাই ফাইঃ বিষাক্ত দ্বীপ

 

          এই সাই ফাই গল্পটি লিখেছিলাম অক্টোবর ২০১৩ তে। তখন ভূমিকম্পে পাকিস্তানে একটা দ্বীপ দেখা দিয়েছিল।

 

                                                                               বিষাক্ত দ্বীপ

বিষাক্ত দ্বীপ

প্রথমদিনেই এত গুরুত্বপূর্ন সভা। তাকেও বেশ গুরুত্ব দিয়ে আনা হয়েছে। তাই রিকি ভিতরে ভিতরে কিছুটা উত্তেজনা অনুভব করছিল।

টেবিলের অন্যপ্রান্তে বসে আছেন ডক্টর জনসন। তার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। কপালে চোখে পড়ার মত ভাঁজ। মাথায় একরাশ ধবধবে সাদা চুল। অত্যাধুনিক যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে বার্ধক্য লুকানো যায় ডক্টর জনসন সেগুলো ব্যবহার করেন নি। তাই বুঝাই যাচ্ছে তিনি বৃদ্ধ লোক।
উপস্থিত আছে আরো কয়েকজন। জোসেফ, আর্থার এবং এলিনা। এদের সাথে আজই পরিচয় রিকির। এরা সবাই বিজ্ঞানী। রিকি নিজে বিজ্ঞানী কী না বুঝতে পারছে না। ভুমিকম্প নিয়ে তার সামান্য একটি পেপার পাবলিশ হয়েছিল বছর দুয়েক আগে। সেটাও আহামরী কিছু ছিল না। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে সেই পেপারের জন্যই তাকে বিজ্ঞান একাডেমির এই গুরুত্বপূর্ন সভায় ডাকা হয়েছে।

ডক্টর জনসন চোখের চশমাটা খোলে বললেন, “এ পর্যন্ত যা জানা গেছে তাতে আমাদের আগের ধারনাই ঠিক মনে হচ্ছে। আপনাদের কারো কিছু বলার আছে?”

ডক্টর জনসন রিকি বাদে অন্য সবার মুখের দিকে তাকালেন। তারা কেউ কোন কথা বলল না। তারপর তিনি রিকির দিকে ফিরে বললেন, “মিস্টার রিকি, আপনি আজ নতুন এসেছেন। তাই হয়ত আমাদের কথা বুঝতে পারছেন না। আপনি নিশ্চয়ই জানেন উত্তরপ্রদেশে গত ১৬ সেপ্টেম্বরের ভুমিকম্পে কৃত্রিম দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে?”

এ ব্যাপারটা ভালোমত রিকির জানা ছিল না। সে নিয়মিত পত্রিকা বা টিভি দেখে না। শুধুমাত্র কার মুখে যেন একবার শুনেছিল দ্বীপ গঁজিয়েছে। কিন্তু কোন আগ্রহ অনুভব করে নি। সাধারণত এখন সে  আর কোন বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ অনুভব করে না। তবুও ডক্টর জনসনের কথায় মাথা নাড়ল।

ডক্টর জনসন একটু বিমর্ষ মুখে বলতে লাগলেন, “আপনি নিশ্চয়ই জানেন এরকম ক্ষুদ্র দ্বীপ সৃষ্টি হওয়া বিস্ময়কর কিছু না। এরকম দ্বীপ সাধারনত সৃষ্টি হলে কয়েকমাসের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়। দ্বীপের মধ্য দিয়ে বিষাক্ত গ্যাস বের হচ্ছে। আমাদের বিজ্ঞানী টিম গ্যাসটার নাম দিয়েছেন স্যারিন এস টু।  অবশ্য এখনো খুব অল্প পরিমানে গ্যাস বের হচ্ছে।”

রিকি পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। এই নামের কোন গ্যাসের নাম সে আগে কখনো শুনে নি। কিন্তু তার অজ্ঞানতা প্রকাশ না করে মুখে কৃত্রিম দুশ্চিন্তা আর আগ্রহ ফুটিয়ে তুলল।

ডক্টর জনসন একটু ঝুঁকে এসে বললেন, “আমরা হিসাব করে দেখেছি এই দ্বীপের নিচে প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত গ্যাসের অস্তিত্ব আছে। যেকোন সময় এগুলো হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়তে পারে। এর পরিমাণ এতই বেশি যে কয়েকদিনের মধ্যে পুরো দেশের মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়বে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হল, যদি গ্যাস বের হওয়া শুরু হয় কয়েকমাসের মধ্যেই মারা পড়বে পৃথিবীর সব জীবজন্তু।”

“বিজ্ঞান একাডেমি তাই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদের নিয়ে টিম গঠন করেছে। এর মাঝে আপনাকেও রাখা হয়েছে। কারণ ভুমিকম্প নিয়ে আপনার পেপারে কিছু মারাত্বক গুরুত্বপূর্ন মৌলিক চিন্তা ভাবনা আছে যেগুলো এখনো পর্যন্ত কেউ চিন্তাও করেনি।”

এই কথা শুনে রিকি প্রায় আকাশ থেকে পড়ল। দু বছর আগে পেপারটা সে কোন মৌলিক চিন্তাভাবনা থেকে করেনি। একাডেমিক প্রোফাইলের ওয়েট বাড়াতে করেছিল। স্কুলের শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতির জন্য একটা পেপার পাবলিশ করতে হয়। সেজন্যই মূলত পুরনো টেকটোনিক প্লেট থিওরী নিয়েই হাবিজাবি একটা পেপার কোনমতে করে দিয়েছিল। এর ঠিক কোন জায়গাটায় মৌলিক চিন্তাভাবনা ছিল সেটা ভেবে পেল না রিকি। সে রীতিমত মৌলিক একটা দ্বন্দ্বে পড়ে গেল।

ডক্টর জনসন বললেন,  “স্পেশাল টিমকে ওই দ্বীপে যেতে হবে। দ্বীপ এখনো বিষাক্ত হয়ে উঠে নি। সামান্য গ্যাসের বিষক্রিয়ায় আশপাশের জলজ প্রাণীরা একটু অন্যরকম আচরণ করছে। মোটামোটি ক্যালকুলেশন করে এবং উপগ্রহের ছবি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে দ্বীপের নিচে গ্যাসের বিস্ফোরন হতে কয়েক সপ্তাহ লাগতে পারে।”

 

আর খুব বেশি কথা হল না। ডক্টর জনসনের ভাবগম্ভীর কথার মধ্য দিয়েই মিটিং শেষ হল।

 


মিটিং শেষে পাশের একটা রুমে রিকিকে নিয়ে গেল সাহায্যকারী রোবট। জানিয়ে দেয়া হল এখন মানসিক প্রস্তুতি এবং বিশ্রামের সময়। এরপর একটা ছোট টিম মিটিং করে তারা রওনা দিবে দ্বীপের উদ্দেশ্যে। দ্বীপের বিষাক্ত গ্যাস বিস্ফোরন ঠেকিয়ে মানবজাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব তাদের কাঁধে।

রিকি আপন মনে হেসে উঠল। এ কী সত্যি নাকী! সে গ্রামের এক সাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের নিম্নমানের ছাত্র ছিল। তার গ্রেড এতই কম ছিল যে সে কোন সরকারী বিজ্ঞানভিত্তিক চাকরি নিতে পারে নি। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হয়েছে। বয়স হবার পর কোনদিন ভাবেও নি বিজ্ঞান একাডেমির আশপাশ দিয়ে যাবে। কারণ বিজ্ঞান একাডেমি যে শহরে সে শহরে বিজ্ঞানী ছাড়া কেউ ঢুকতেই পারে না।

অবশ্য খুব ছোটকালে যখন টিভি সিরিয়ালে দেখা বিভিন্ন সুপারহিরো তার প্রিয় ছিল, তখন সে মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখত একদিন সেও হয়ত পৃথিবীকে বাঁচানোর যুদ্ধে নামবে। কিন্তু সেগুলো ছিল একান্তই অবাস্তব কল্পনা। মানুষের মস্তিষ্ক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিভিশনের মত। তাই মানুষ অবাস্তব বা অসম্ভব কিছু কল্পনা করে মগজের ফ্ল্যাট স্ক্রিনে নিজেকে দেখে  মাঝে মাঝে মজা পায়। কিন্তু এই মজা পাওয়া স্বপ্নেরা কোন এক দূর্ঘটনায় যদি সত্যি হয়ে পড়ে তাহলে হয়ে যায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রিকির অবস্থা ঠিক সেরকমই হয়ে পড়ল।

বিশ্রামের রুমটা অসাধারণ ভাবে সাজানো। অসংখ্য আধুনিক যন্ত্রপাতি। অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা। রিকির মনে হল, গ্রামের সাধারণ লোকেরা এসব জীবনে হয়ত চোখেও দেখেনি। সেও দেখত না।

এই ধরনের চিন্তা করা তিনশো তিন ধারার অপরাধ। বিজ্ঞাণ সংস্থা পৃথিবীর মূল কর্তৃত্বে আসার পর থেকে এই আইন কার্যকর আছে। তিনশো তিন ধারার অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এই অপরাধকে গুরুতর করে দেখার কারণ হিশেবে বলা হয় এতে সমাজের নিম্নশ্রেণী বিভ্রান্ত হয়ে ধ্বংশাত্বক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে। পুরনো পৃথিবীতে এ ধরনের অনেক তত্ত্ব, ফিলোসফি ছিল। সেগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাধারণ নিম্নশ্রেণীর মানুষেরা উচ্চ শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত।

কিন্তু সেই ফিলোসফিগুলো ধ্বংশ করে ফেলা হয়েছে।

তবুও সমাজের শ্রেণীবিভেদের তত্ত্বগুলো পুরোপুরি মুছে যায় নি। এখনো কেউ কেউ এগুলো নিয়ে চর্চা করেন। পুরনো বইগুলো তারা পাথরে বা গাছের বাকলে বিভিন্ন উপায়ে লিখে সংরক্ষণ করেছেন। যেকোন ধরনের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে লিখলে বিজ্ঞান একাডেমির হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। বিজ্ঞান একাডেমির নেটওয়ার্ক খুব শক্ত। সবখানে তাদের সারভেইলেন্স বিদ্যমান।

মাঝে মাঝে ইউনিভার্সিটির যুবক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুড়ো শিক্ষক ইত্যাদি এমন অনেক লোক ধরা পড়েন। তারা কীজন্য ধরা পড়েছেন তা মিডিয়াকে না বলা হলেও তাদের মৃত্যুদন্ড হয়। বিজ্ঞান একাডেমি থেকে জানানো হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারণে তাদের মৃত্যুদন্ড হয়েছে।

 


বিশ্রাম পর্ব শেষ। টিম মিটিং এ এসেছে সবাই। এবার ডক্টর জনসন এখানে নেই। জোসেফ ছেলেটার বয়স বেশি হবে না। পঁচিশ ছাব্বিশ হবে। আর্থার বুড়ো লোক। তার চুল ধবধবে সাদা। এলিনা মেয়েটার বয়স ঠিক আন্দাজ করা যাচ্ছে না। পঁচিশও হতে পারে আবার পয়ত্রিশও হতে পারে। অথবা হতে পারে মেয়েটি রোবট। কিছুই অসম্ভব নয়।

তবে মেয়েটা সুন্দর। রিকির মনে হচ্ছে মেয়েটার চোখ অজগরের চোখের মত। অজগর যেমন চোখ দিয়ে সম্মোহীত করে ফেলে এই মেয়েরও সেই ক্ষমতা আছে। চোখের দিকে তাকালে চারপাশের কোন কিছুই আর মাথায় ঢুকে না। রিকি তাই মেয়েটার চোখ এড়িয়ে তাকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। অন্যমনস্কভাবে তার চোখ বার বার চলে যাচ্ছে মেয়েটির মায়াবী চোখের দিকে।

বিজ্ঞানী আর্থার বললেন, “মিস্টার রিকি, আমরা নিজেরা অনেকসময় নিয়ে আলোচনা করেছি আগে, এখন আপনার মত কী আপনি বলতে পারেন?”

রিকি কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “কোন বিষয়ে?”

আর্থার, জোসেফ এবং এলিনা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এলিনা কিছুটা কঠিন হাসি মুখে বলল, “দ্বীপটার বিষয়ে। আমরা দ্বীপে যাওয়ার ঠিক পূর্বের টিম মিটিং এ আছি এখন।”

রিকি বলল, ” ও হ্যা। সরি। আমি বুঝতে পারি নি। দ্বীপটার ব্যাপারে আসলে আমাদের প্রথমে……”

এলিনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি কি জানেন দ্বীপটা কোথায়?”

রিকি ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে, মাথার পিছনের দিকটা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “না মানে ইয়ে……”

এলিনা বলল, “বুঝেছি। আমি আপনাকে বলছি। দ্বীপটা উত্তরপ্রদেশে। ব্লু সী এর উপরে। ঠিক আমাদের ব্লু সী টাউনের পাশে। এখন এর নিচে আছে বিষাক্ত গ্যাস স্যারিন এস টু। স্যারিন গোত্রের সবগুলো গ্যাসই ভয়ংকর। তবে এস টু এদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চমাত্রার বিষাক্ত। আমাদের কাজ হল দ্বীপের নিচের গ্যাস বিস্ফোরন থেকে মানুষকে বাঁচানো। এর জন্য আমরা তিনভাবে কাজ করতে পারিঃ
১। গ্যাসের বিষাক্ততা দূর করার কোন উপায় বের করা
২। গ্যাস বিস্ফোরন কমপক্ষে তিনমাস ঠেকিয়ে রাখা। কারণ এরপর তা সমুদ্রে ডুবে যাবে। তখন আর কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
৩। অন্য কোন উপায় বের করা

রিকি এবার কিছুটা বুঝতে পারল। সে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কাজটা আমরা কীভাবে শুরু করতে পারি?”

বিজ্ঞানী আর্থার বলল, “বিজ্ঞান একাডেমী এ ব্যাপারে এখনো কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারে নি। বিষয়টা যেহেতু খুব স্পর্শকাতর। আমরা দ্বীপে গিয়ে কিছু স্যাম্পল সংগ্রহ করার চেষ্টা করব এবং কয়েকটি বিষয় ক্যালকুলেশন করে বিজ্ঞান একাডেমীতে রেজাল্ট পাঠাব। মনে হচ্ছে তার পরেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।”

 


টিম মিটিং শেষ হল। রোবট চালিত রাইডারের সাহায্যে মাত্র সাত মিনিটের মধ্যে তারা অর্থাৎ স্পেশাল টিম উত্তরপ্রেদেশে ব্লু সীর পাশে পৌছে গেল। রিকি হিসেব করে দেখল সাধারণ বিমানে এতটুকু আসতে প্রায় আটঘন্টা লাগত। দ্বীপ নিয়ে অবাক হওয়ার চাইতে বিজ্ঞান একাডেমির অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দেখে সে বেশি অবাক হচ্ছে।
রিকি এবং তার পুরো টিম একটু পরে দ্বীপটাতে ল্যান্ড করল। একেবারে সাদামাটা নিরীহ চেহারার দ্বীপ। এটি যে খুব ভয়ংকর কিছু রিকির তা মনেই হল না।
সুপার কম্পিউটারে আর্থার তাদের দেখাল দ্বীপের নিচে বিশাল গ্যাসের স্তুপ।

যে যে জায়গা দিয়ে গ্যাস বের হচ্ছে তাতে বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণ খুব অল্প।  আর প্রচুর বাতাস মিশে যাওয়ায় এর ঘনত্ব এতই কমে গেছে যে কোন ধরনের পরীক্ষাও করা যাচ্ছে না। এখন পরীক্ষা করতে হলে কিছু টাটকা বিষাক্ত গ্যাস দরকার।

তাও আবার বের করে আনা বিপদজনক। কারণ এতেই বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে।

জোসেফ, আর্থার এবং এলিনা গ্যাসের বিভিন্ন গতিপথ, সময় ইত্যাদি ক্যালকুলেশন করে রেজাল্ট পাঠিয়ে দিল বিজ্ঞান একাডেমিতে।

এরপর বিজ্ঞান একাডেমি থেকে নির্দেশ এল অত্যাধুনিক তেলাপোকা সাইজের রোবট কোকরাচ৩২ কে নিচে পাঠানো হোক । কারণ ক্যালকুলেশন করে দেখা গেছে এই রোবট প্রবেশ করলে যে পরিমাণ ফাঁক সৃষ্টি হবে তা একেবারেই সামান্য। তাতে বিস্ফোরনের কোন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

জোসেফ, আর্থার এবং এলিনা যখন জটিল সব কাজ করে যাচ্ছে দ্রুত তখন রিকি প্রায় অকর্মার মত বসে ছিল। কী করবে সে বুঝতে পারছিল না। হাবভাবে সে বুঝতে পারছিল তাকে দলে রাখা হয়েছে বলে আর্থার , জোসেফ এবং এলিনা বেশ বিরক্ত। কারণ সে কোন কিছুই করতে পারছে না। ঠিকমত কিছু শুনছেও না, দেখছেও না। এলিনা বেশ অস্বস্থিতে আছে। কারণ রিকি তার চোখের দিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকে। এলিনা তার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে সিগনাল পেয়ে যাচ্ছে রিকি তাকে নিয়ে কীসব ভাবছে। এই ছেলে এরকম গুরুত্বপূর্ন একটা কাজে এসে এসব চিন্তা কীভাবে করে সে ভেবেই পাচ্ছে না। তাই মাথা থেকে স্বয়ংক্রিয় সিগনাল আসছে ছেলেটাকে এড়িয়ে চলো।  আসলে পুরো দলই এড়িয়ে চলছিল রিকিকে।

দল যখন কোকরাচ ৩২ এর গতিপথ নিয়ে জটিল ক্যালকুলেশনে ব্যস্ত তখন রিকি ঘুরে বেড়াচ্ছে দ্বীপে। আগ্রহউদ্দীপক কিছু দেখা যায় কি না এই চেষ্টায়।

তবে যখন আর্থার, এলিনা ও জোসেফ রোবট রেখে ঠিক কোন জায়গাটা দিয়ে রোবটটাকে পাঠানো হবে তা খুঁজে বের করছিল তখন রিকির দখলে ছিল ক্ষুদ্র রোবটটি।

 

বিষাক্ত গ্যাসের স্যাম্পল সংগ্রহের জন্য কোকরাচ৩২ কে পাঠানো হল। প্রায় দশমিনিট সব কিছু ভালোই চলল। কিন্তু এর পরেই শুরু হল গোলমাল। দ্বীপের যে অংশে রোবটটাকে পাঠানো হয়েছিল তা বারবার মৃদুভাবে কেঁপে উঠতে লাগল।

ভীত মুখে এলিনা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? দ্বীপ কাঁপছে কেন?”

শান্ত মাথার বিজ্ঞানী আর্থার বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করল এভাবে,  বিজ্ঞান একাডেমির হিসাবে কিছু ভুল ছিল হয়ত। ছোট ছোট অসংখ্য ফাটল ছিল দ্বীপে। যেগুলো উপগ্রহের ছবিতে আসে নি। দ্বীপের মাটিও বেশ আলগা আলগা। আর ভেতরে রয়েছে গ্যাসের প্রচন্ড চাপ। সুতরাং রোবট চলতে শুরু করলে ফাটলে কিছুটা চাপ পড়ল। আস্তে আস্তে ফাটল গুলো বড় থেকে বড়তর হতে লাগল।

বেরিয়ে আসতে শুরু করল বিষাক্ত সব গ্যাস।

এই প্রথম রিকি আগ্রহ অনুভব করল। কারণ তার বাঁচতে হবে। সে টিমের সবাইকে বলল, “বিজ্ঞান একাডেমির বাহনে উঠার চেষ্টা করা হবে ভুল। কারণ গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে। এ থেকে বিজ্ঞাণ একাডেমির লোকেরাও বাঁচবে না। উপরন্ত তারা ফিরে গেলে তাদের মৃত্যুদন্ড হতে পারে। কারণ বিজ্ঞান একাডেমি বিশ্বাস করবে না কখনোই তাদের ক্যালকুলেশনে ভুল ছিল।”

বিজ্ঞানী আর্থার বলল, “তাহলে তুমি আমাদের কি করতে বলো?”

রিকি বলল, “আপনারা আমার গ্রামে চলুন। সেখানে গ্যাসের হাত থেকে বাঁচার এক উপায় আমার জানা আছে। প্রাচীন কিছু গুহায় লুকিয়ে থাকা যাবে। সে সব গুহায় ভারী গ্যাসগুলো জমা হয়ে আছে। এই গ্যাসগুলো তাই ঢুকতে পারবে না। অক্সিজেন নিয়ে গেলে অনায়াসে থাকা যাবে।”

ঠিক এসময়ই গর্জে উঠল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। জোসেফ রিকির মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। সে বিজ্ঞানী, শ্যুটার নয়, তাই লক্ষ্যভ্রস্ট হল ভাগ্যক্রমে। গুলির পর পরই রিকি প্রায় লাফিয়ে সরে গেল এবং পকেটের পিস্তল বের করে বিজ্ঞানী আর্থারের মাথায় ঠেকিয়ে অন্যদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করল। এলিনা মেয়েটার হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। তবে মেয়েদের বিশ্বাস নেই। রিকি মেয়েটাকে বলল, “দুই হাত সামনে রেখে হামাগুড়ি দিয়ে বসো।”

বিজ্ঞানী আর্থার উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “কী , হচ্ছে কি এসব?”

জোসেফ চিৎকার করে বেশ উত্তেজিত কন্ঠেই জানাল, “একটু আগে আমি লক্ষ করলাম আমাদের পাঠানো রোবটের ডিজাইন চেঞ্জ করে দিয়েছে এই রিকি। যে রোবট আমরা ঠিক করে রেখেছিলাম তাতে হাবিজাবি জিনিস যোগ করে কোকরাচ৮২ এর সাইজ করে ফেলেছিল। তাই এই বিস্ফোরণ ঘটছে।”

বিজ্ঞানী আর্থার বলল, “ও মাই গড!”

তবে তার গডটা শোনা গেল না গুলির শব্দে। রিকি জোসেফের মাথা বরাবর গুলি করেছে। একটা ধাতব শব্দ হল। গুলি ঠিক কপাল দিয়ে ঢুকে পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ধপাস করে পড়ে গেল তরুণ বিজ্ঞানী জোসেফের দেহ। রিকি উচ্চারণ করল, “যাহ শালা! পুঁজিবাদের দালাল।”

পুঁজিবাদ শব্দ শোনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল এলিনা। বিজ্ঞানী আর্থারও নড়ে উঠল।

এলিনা আমতা আমতা করে বলল, “তাহলে তুমি বিদ্রোহী?”

রিকি এলিনার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন চুপ হয়ে থাকল। তারপর বলল,  “হ্যা। আমি গ্রামে বড় হয়েছি। গ্রামের লোক কীভাবে জীবন যাপন করে আমি দেখেছি। আর দেখলাম বিজ্ঞান একাডেমির লোকেদের বিলাসী জীবন যাপন। এটা আগেই আমার জানা ছিল। এই ব্যবধানের গল্প। সাধারণ মানুষকে বিজ্ঞান একাডেমির শোষন থেকে মুক্ত করতে চাইতাম আমি। কিন্তু কখনো কারো কাছে সেকথা প্রকাশ করিনি। কখনো সুযোগ পাবো ভাবিনি। আজ প্রকৃতি যখন আমাকে এ সুযোগ দিয়েছে তাই আর নষ্ট করলাম না। তবে জোসেফ যা বলেছে আমি তা করিনি। কারণ একটা রোবট নিয়ে নাড়াচাড়া করার মত জ্ঞান আমার নেই। থাকলে নিশ্চয়ই তোমাদের মত বিজ্ঞান একাডেমির দালাল হতাম।

বিজ্ঞানী আর্থার রিকিকে ঠেলে ফেলে দিয়ে গলা চেপে ধরল। সে হালকা পাতলা  হলেও তার গায়ে জোর অনেক। রিকি অনেক কষ্টে নিচে থেকেই হাতের রিভলভারের ট্রিগার চেপে ধরল।

আরেকটি ধাতব শব্দ হল।

এলিনা প্রায় নিশ্চুপ হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল। রিকি মাটিতে বসা থেকেই বলল, “তুমিও কী লড়বে? লড়তে আসলে কিন্তু আমাকেও গুলি করতে হবে। একজন সত্যিকার বিপ্লবী তার প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনে কোন বাঁধাকেই মানে না। প্রেম কেও না। আমার নিজেকে আজ সত্যিকার বিপ্লবীদের মত মনে হচ্ছে।”

এলিনা হাটু গেড়ে বসে পড়ল। তার চোখে ছিল জল। রিকি সে চোখ দুটিতে তাকিয়ে তার প্রতিবিম্ব দেখল। কাঁপা কাঁপা প্রতিবিম্ব। এরপর সে যেন সম্মোহিতের মত তাকিয়ে রইল। এই সময়ই প্রথমবারের মত রিকি লক্ষ করল, এই চোখদুটো গাঢ় নীল। মানুষের চোখ এত নীল হয় না।

 


বিজ্ঞান একাডেমির বিশাল স্ক্রিনের টিভির সামনে বসে আছেন ক্ষমতাবানরা। তাদের প্রায় সবার মুখেই হাসি। দ্বীপটা আস্তে আস্তে ডুবতে শুরু করেছে। কয়েকমিনিটের মধ্যেই পুরোটা ডুবে গেল।

বিজ্ঞান একাডেমির প্রধান নিরবতা ভঙ্গ করে বললেন, “কেমন লাগল মান্যবরেরা? বিদ্রোহী ছেলেটার মৃত্যুদন্ড কেমন হল? যারা বলেছিলেন মানুষ কী ভাবছে তা বুঝে নেয়ার যন্ত্র থট রিডার বাস্তবে কাজ করবে না তারা এখন কী বলবেন? ছেলেটার নিজের মুখেই তো শুনলেন আপনারা তার বিদ্রোহী ভাবনার কথা।”

এই যন্ত্রের একজন প্রধান সমালোচন সমালোচক গণিতবিদ জন লেকটার বললেন, ” মানছি ভুল বলেছিলাম। আর আপনি আপনার কথা প্রমাণের জন্য যে কাহিনী সাজিয়েছেন তা একেবারে অসাধারন হয়েছে।

বয়স্ক এক বিজ্ঞানী ভদ্রলোক বললেন, “কিন্তু আমাদের তিনটি রোবট গেল। আর শেষেরটার প্রোগ্রামে মনে হয় গন্ডগোল লেগে গিয়েছিল। নাহলে তার আবার চোখে জল আসবে কেনো? রোবটদের আবেগ টাবেগ একটু কম দিবেন।”

ঠিক তাই, সবাই সায় দিলেন। তারা বললেন, “এর পরের বার আরেকটু সচেতন ভাবে প্রোগ্রামিং করতে হবে। এছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছেলে পেলেরা যাতে বিদ্রোহী না হতে পারে এজন্য ভাবনা বুঝে নেয়ার যন্ত্র থট রিডারের স্টেশন বসানোও জরুরী।”

 

 

***
ছবিঃ
পাকিস্তানে ভুমিকম্পে সৃষ্টি হওয়া দ্বীপ।
ছবি ক্রেডিট: নাসা

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং