মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় ফেইসবুকের অবদান

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় ফেইসবুকের অবদান

ফেইসবুক ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার (বা অন্যকথায় সংখ্যালঘু নির্যাতন) ক্ষেত্রে দোষ দেবার সময় সবাই ফেইসবুকরে পাশ কাটিয়ে যেতে চান দেখা যায়। কিন্তু আপনাদের প্রিয় এই ফেইসবুকের দোষের অংশ আছে উল্লিখিত ঘটনায়, মনে রাখবেন।

মিয়ানমারে রোহিংগাদের উপর যে নির্যাতন করা হলো, সেখানেও বড় ভূমিকা ছিল ফেইসবুকের। অশিন উইরাথু (বা ভিরাথু) নামের যে উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু আছে, তার পাবলিক বক্তৃতা নিষিদ্ধ করে মায়ানমার সরকার। কিন্তু ভিক্ষু তার উগ্রতা ছড়ানোর জন্য ফেইসবুক বেছে নেন। তার অনুসরনকারীরা তার ফেইসবুক একাউন্টে ভীড় জমান। ফেইসবুকের জনপ্রিয়তা মিয়ানমারে বাংলাদেশের মতই, ইন্টারনেট বলতে লোকে ফেইসবুকই বুঝে।

ভিক্ষু ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে তার উগ্রতা ছড়িয়ে যান। নিউ ইয়র্ক টাইমস ফেইসবুককে বলেছে মিয়ানমারে হেইট স্পিচ ও উগ্র পোস্টের ব্রিডিং গ্রাউন্ড। ফেইসবুক এমনভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে, যেসব পোস্ট বেশী লাইক শেয়ার কমেন্ট পায়,  এগুলি নিউজ ফীডের উপরের দিকে দেখায়। ফলে ইউজাররা তাকে গুরুত্বপূর্ন মনে করে। এছাড়া, ফেইসবুক পেইজ থেকে কোন অঞ্চলের লোকদের টার্গেট করে, নির্দিষ্ট মতাদর্শের লোকদের টার্গেট করে ডলার খরচ করে পোস্ট দেয়া যায়। এসব পোস্ট টার্গেট করা লোকদের সামনে যাবে। এছাড়া আছেন বিভিন্ন চেইন মেসেজ, যা মেসেঞ্জারের মাধ্যমে, হোয়াটস আপের মাধ্যমে দ্রুত সঞ্চারিত হয়।

সরকার অশিন উইরাথুর উগ্রতা ও হিংসা ছড়ানো বক্তৃতা বন্ধ করতে চেয়েছিল, ফেইসবুক তাকে এই সুযোগ করে দিয়েছে।

মিয়ানমারে ফেইসবুকের কোন অফিস নেই। কিন্তু তবুও তারা মিয়ানমারে গিয়ে তাদের “নীতিমালা” মিয়ানমারের ভাষায় অনুবাদ করে লোকদের বুঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের নীতিমালা, এবং মিয়ানমারে এই তৎপরতা যথেষ্ট ছিল না।

ব্রিটিশ তদন্তকারীরা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বিরোধী প্রচার প্রচারনা, ফেইক নিউজ ইত্যাদি বিষয়ে ফেইসবুক বা অন্য সোশ্যাল মিডিয়ার কাজকে তদন্তের আওতায় নিয়েছেন। আমেরিকায় আইন প্রণয়নকারীরা ২০১৬ নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে সোশ্যাল মিডিয়ায় রাশান তৎপরতার ব্যাপারে দেখছেন। অর্থাৎ, সোশ্যাল মিডিয়া এখন আর প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। তারা যেহেতু কন্টেন্টের পাবলিশার, এ থেকে বিলিয়ন ডলার কামাচ্ছে, তাই পাবলিশার হিসেবে তারা দায়িত্ব কেমন পালন করছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ছবিঃ কালের কন্ঠ, ১২ নভেঃ ২০১৭।

বাংলাদেশেও ফেইসবুক ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা (বা সংখ্যালঘু নির্যাতন) হতে দেখা যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে ফেইসবুক নিজে কী দায়িত্ব পালন করছে? তারা কি বাংলাদেশে এসেছে ও তাদের নীতিমালা বাংলাতে করে তাদের সম্মানীত ইউজারদের বুঝাচ্ছে যে হেইট স্পিচ, সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়াতে তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যাবে না? বাংলাদেশ সরকার কি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারনেট কেন্দ্র স্থাপন করে লোকদের বুঝাচ্ছে সাইবার ক্রাইম কী, ফেইসবুকে হেইট স্পিচ ও উসকানি ছড়ালে কী শাস্তি হতে পারে?

বা, এটা কি লোকদের বুঝানো হচ্ছে যে ফেইসবুকে ফেইক একাউন্ট খুলে একজন ভিন্ন নামে সাম্প্রদায়িক উসকানি দিতে পারে?

যেহেতু দেশের প্রায় আশিভাগের উপরে লোকের হাতে মোবাইল ফোন আছে, গ্রামে গঞ্জে লোকে ফেইসবুক ব্যবহার করছে, সুতরাং এ বিষয়ে লোকদের সচেতন করা সরকারের দায়িত্ব। যেমন দায়িত্ব ছিল হাগার পরে সাবান বা ছাই দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যাপারে সচেতন করা, সরকার তা ভালোভাবেই করেছিল মীনা কার্টুন সহ নানা কিছুর মাধ্যমে।

এগুলি হচ্ছে বাস্তবিক কিছু কাজ, যা করতেই হবে, যাতে একই ধরনের ফেইসবুক ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার (বা সংখ্যালঘু নির্যাতন) পুনরাবৃত্তি না হয়।

ছবিঃ নাসিরনগর হামলা, বিবিসি বাংলা।

কিন্তু সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার ঘটনায় দেখা যায় গণহারে ইসলাম ও মুসলমানকে দোষ দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের অনলাইন কম্যুনিটিতে। এখানে ধর্ম অবিশ্বাসী এবং ধর্ম পন্থীদের মধ্যে দীর্ঘ ফাইট আছে। যখন কোন ধর্মীয় হাঙ্গামা হয় তখন ধর্ম অবিশ্বাসীরা তাদের ধর্ম পন্থী অপর অংশকে এক হাত দেখে নেন। ধর্ম পন্থীরা তখন পালটা আক্রমণ করেন, ও অনেকে সমগ্র ঘটনাকে ডিফেন্ড করতে যান। শেষতক, ঐ ধর্ম ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক হামলা, এর কারণ, প্রতিকার ইত্যাদি তাদের লক্ষ্য থাকে না, বরং সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাটি তাদের জন্য আক্রমণ প্রতি আক্রমণের একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফেইসবুকে তারা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ভায়োলেন্সের চর্চা করেন নিজেদের মধ্যে, এটা তাদের এক বিনোদন। যেমন, খেলাও নিয়ন্ত্রিত ফর্মের ভায়োলেন্স।

ফলে, মূল ঘটনার ভোক্তভোগী, অসহায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে, তাদের হামলার হাত থেকে বাঁচানোর পক্ষে কথা বলার কেউ থাকে না, থাকলেও অতি অল্প। বাংলাদেশে ফেইসবুক ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক হামলাগুলি দেখলে দেখতে পাবেন নিয়মিত বিরতিতে তা হচ্ছে। অর্থাৎ, একটি ধারাবাহীক ফেইসবুক ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (বা সংখ্যালঘু নির্যাতন) বাংলাদেশে চলছে, এবং তাতে নির্যাতীত হচ্ছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। মিয়ানমারে যেটা হয়েছে দ্রুতভাবে, বাংলাদেশে হচ্ছে ধীরে ধীরে। এটা বলাও হয়ত অযৌক্তিক হবে না যে, বাংলাদেশে যদি ফেইসবুকের পক্ষ থেকে ও সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট শিক্ষা ও ফেইসবুক নীতিমালা শিক্ষা ইত্যাদি অঞ্চলে অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়া না যায়; যদি ফেইসবুক তাদের নীতিমালা ও তার প্রয়োগ আরো কঠোর না করে, তাহলে বাংলাদেশে যে অবস্থা চলছে তাতে ভবিষ্যতে আরো বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা (বা সংখ্যালঘু নির্যাতন) হবে।

 

সংযুক্তিঃ

দাঙ্গা – [বিশেষ্য পদ] কলহ, বিদ্রোহ, মারামারি

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং