মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » প্রশ্ন ও চিন্তা বিষয়ে বিস্তারিত

প্রশ্ন ও চিন্তা বিষয়ে বিস্তারিত

প্রশ্ন

অনেক ভালো সাইন্টিফিক রিসার্চে দেখা গেছে এপস বা উল্লুকেরা প্রশ্ন করতে সক্ষম। তাদের প্রশ্ন করার মত ভোকাবোলারি তথা শব্দভাণ্ডার অর্জন করার ক্ষমতা থাকে। সাইন ল্যাংগুয়েজ শিখতে পারে।

কিন্তু এগুলি থাকা স্বত্তেও তারা কখনো প্রশ্ন করে না।

মানুষ ও প্রাইমেটের কথোপকথনে প্রশ্ন মানুষই করে শুধু।

এপসরা মনে করে তারা যা জানেনা, তা অন্যে জানতে পারে না। ফলে প্রশ্নের বোধ তাদের আসে না।

বিখ্যাত বিজ্ঞানী জ্যান গোডেল শিম্পাঞ্জির সাথে, সূত্রঃ Cosmosmagazine.com

বিজ্ঞানীদের কথায়, প্রশ্ন করা ভাষাগত সক্ষমতার ব্যাপার না, চিন্তাগত এক সক্ষমতার ব্যাপার।

মানুষের বাচ্চা কথা শুরু করলেই প্রশ্ন করে। এই প্রশ্নই তারে জ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়। সে অন্যের কাছ থেকে শিখতে শেখে।

তবে অনেক মানুষই বড় হতে হতে বদ্ধমূল বা ফিক্সড মেন্টালিটির হয়। এপসদের মতই তারা ভাবতে থাকে তারা যা জানেনা তা অন্যে জানবে না। অন্যের জানাকে তারা ছোট করে দেখে। এবং তারা নিজেদের কম জানাজনিত হীনম্মন্যতার কারণে যারা জানে তাদের কাছ থেকে শিখতে পারে না।

প্রাইমেট কগনিশনের সাইন্টিফিক কাজের রেফারেন্স।

 

প্রশ্ন করা

কীভাবে প্রশ্ন করা হচ্ছে ও কী প্রশ্ন করা হচ্ছে তা গুরুত্বপূর্ন। যেকোন ধরণের প্রশ্ন মানেই ভালো এমন নয়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে গারবেজ ইন গারবেজ আউট। অর্থাৎ, আপনি যদি গার্বেজ বা আবর্জনা নেন তাহলে আবর্জনা হবেন। আবর্জনা পড়েন তাহলে আপনার চিন্তাও হবে আবর্জনা।

এখন মানুষের প্রশ্ন উত্তর দেয়ার জন্য বসে আছে গুগল। আপনি প্রশ্ন করলেই সে রাশি রাশি উত্তর হাজির করছে।

কিন্তু এখানেও এক বড় সমস্যা আছে, গারবেজ ইন গারবেজ আউট। আপনি গর্দভের মতো প্রশ্ন করলে সেইসব কীওয়ার্ড বা শব্দাবলীর উপর ভিত্তি করে গুগল গারবেজ হাজির করবে।

ধরা যাক আপনি জানতে চাচ্ছেন, এক্স ভালো কি না।

এখানে আপনার পূর্বধারণা আছে এক্স এর পক্ষে। আপনি মনে করেন এক্স ভালো। যদি গুগলে প্রশ্ন করেন, “ইজ এক্স গুড?” গুগল আপনাকে এক্স এ কতোভাবে গুড তার রেজাল্ট হাজির করবে।

কিন্তু প্রশ্ন যদি করতেন “ইজ এক্স গুড অর ব্যাড” তাহলে মোটামোটি মিক্সড এক রেজাল্ট হাজির করতো।

ভালোভাবে প্রশ্ন করাটা কেন জরুরী?

কারণ আপনি আসলে উত্তর চান, সঠিক জানতে চান। এজন্য ঠিকঠাক আপনাকে প্রশ্ন করতে হবে গুগলকেও। ভুলভাবে জিজ্ঞেস করলে ভুল উত্তর পাবেন। বেশী পড়ে যাবেন ফিল্টার বাবলে

 

সক্রেটিস হবেন যেভাবে

সক্রেটিস প্রাচীন গ্রীসের একজন দার্শনিক। বলা যায় পশ্চিমা দর্শন তার উপর ভিত্তি করেই শুরু করেছে। জর্মন দার্শনিক জি ডব্লিউ এফ হেগেল তাকে বলেছিলেন মেন্টাল টার্নিং পয়েন্ট। কারণ তিনি বাইরের জগতে থেকে চিন্তার কেন্দ্র সরিয়ে ব্যক্তির ভেতরে নিয়ে আসেন।

এই সক্রেটিস নিজে কিছু লিখে যান নি। তিনি প্রশ্ন করতেন লোকদের। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমেই তার চিন্তামূলক কার্যক্রম চলতো। সক্রেটিসের মা ছিলেন ধাত্রী। সক্রেটিস নিজেকে মনে করতেন চিন্তামূলক কাজে এরকম একজন ধাত্রী। যিনি অন্যের ভেতরের চিন্তাকে প্রশ্নের মাধ্যমে বাইরে বের করে আনতে সাহায্য করেন। যেমন ধাত্রীরা মায়ের ভেতর থেকে সন্তানকে বাইরে আনতে সাহায্য করতেন।

শিল্পী কন্সটানটাইন ব্রানকুজির সক্রেটিস স্ট্যাচু; Licensed by Scala/Art Resource, NY
©2005 Artists Rights Society (ARS),
New York/ADAGP

সক্রেটিসের প্রশ্নের পদ্বতিকে বলা হয় সক্রেটিক মেথড বা সক্রেটিসের পদ্বতি।

সক্রেটিক পদ্বতির প্রশ্ন হলো নিয়মতান্ত্রিক এক প্রশ্ন পদ্বতি যা বিভিন্ন দিক থেকে ও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রয়োগ হতে পারে। উদ্দেশ্যগুলি হতে পারেঃ

১। জটিল আইডিয়া বা চিন্তাকে এক্সপ্লোর (বিশ্লেষণ) করা।

২। কোন কিছুর সত্যে পৌছানো।

৩। কোন নতুন ইস্যু বা সমস্যাকে সামনে আনা।

৪। বিভিন্ন অনুমানকে সামনে আনা।

৫। কনসেপ্টকে বিশ্লেষণ করা।

৬। আমরা কী জানি ও কী জানি না তা আলাদা করা।

৭। চিন্তার যৌক্তিকতা অনুসরন করা।

৮। কথোপকথনটিকে নিয়ন্ত্রন করা।

ইত্যাদি।

অন্য ধরণের প্রশ্নদের থেকে সক্রেটিক মেথডের প্রশ্ন আলাদা কারণ সক্রেটিক প্রশ্নগুলি নিয়মতান্ত্রিক এবং সাধারণত মৌলিক চিন্তা, কনসেপ্ট, নীতি, তত্ত্ব, সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে হয়ে থাকে।

[পরবর্তীতে এরিস্টটল বিভিন্নভাবে প্রশ্নের ফ্রেম বা কাঠামো পরিবর্তন করে উত্তর দেবার চেষ্টা করতেন, এটাকেও সক্রেটিক পদ্বতি বলা যায়। এরিস্টটল অবশ্য নিজের কথা বলার জন্য প্রশ্নটিকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখার জন্য নানা ফ্রেমে নিতেন ও ভিন্ন ভিন্ন উত্তর আসতো।]

সাধারণভাবে বলতে গেলে সক্রেটিক প্রশ্ন পদ্বতি হলো কোন সমস্যা নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে চিন্তা করার এক উপায়।

দুইজন মানুষ যখন পরস্পরের মতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কথোপকথনে লিপ্ত হন, এবং একে অন্যের যুক্তির ভুল ধরিয়ে দিতে দিতে তারা অগ্রসর হন, তখন ক্রিটিক্যাল থিংকিং এর সুযোগ তৈরী হয়। তবে সে কথোপকথনটি সুস্থ হতে হবে। সুস্থ বলতে আমি বুঝাচ্ছি তারা বাস্তবিক অর্থেই ভালো যুক্তি দিয়ে নিজেদের অবস্থানের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, কোন ইচ্ছাকৃত ফ্যালাসিতে আক্রান্ত হচ্ছে না তাদের কথাবার্তা।

এখানে বুঝা গেল সক্রেটিক কথাবার্তার জন্য, প্রশ্ন উত্তরের জন্য দুইজন ব্যক্তি লাগে। কিন্তু একজন দিয়ে কী হয়? একা সক্রেটিস?

হয়। চার্লি মাঙ্গার এটা করে থাকেন। কারণ সব সময় আপনি ঐ উপযুক্ত ব্যক্তি পাবেন না সক্রেটিক কথোপকথন চালানোর জন্য। এজন্য নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে হবে। নিজেকে দুইজন ব্যক্তি করে খেলতে হবে। যেরকম দাবা খেলোয়াড়রা কখনো একা একা দাবা খেলে থাকেন।

চার্লি মাঙ্গার ওয়েসকো কর্পোরেশনের বার্ষিক শেয়ারহোল্ডার মিটিং এইরকম একা সক্রেটিসিও কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন। তিনি প্রথমে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতেন, এরপর একে একে উত্তর দিয়ে যেতেন।

দর্শকেরা তার প্রশ্ন ও উত্তরের প্রশস্ততা ও গভীরতা দেখতেন বসে।

এই সক্রেটিসিও একা চর্চা পদ্বতিটি চাইলে আপনিও ব্যবহার করতে পারেন। নিজেকে ভাবুন সক্রেটিস যিনি প্রশ্ন করছেন, আবার উত্তর দেবার সময়ও আরেকজন সক্রেটিস যিনি উত্তর দিচ্ছেন। সক্রেটিস না ভাবতে চাইলে নিজেকেই ভাবুন দুইদিকে। এভাবে এক আত্ম অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

 

সাহায্যকারী বা মেন্টর

নিজে নিজে চিন্তা করে, বই পড়ে বা গুগলিং করে সব বুঝা সম্ভব না, কারণ অনেক জিনিসই জটিল। এইজন্য আপনার একজন সাহায্যকারী দরকার। যিনি একজন মানুষ। হয়ত আপনার চাইতে এই চিন্তা প্রক্রিয়ায় এগিয়ে বা তার জানাশোনা বেশী।

বামে প্লেটো ও ডানে তার শিষ্য এরিস্টটল। এই ছবিতে তাদের ভিন্নমত প্রকাশিত, একে বলা যায় তাদের কথাবার্তার প্রতীক, যাই মূলত আকার দিয়েছে সমস্ত ওয়েস্টার্ন দর্শন।

আপনি তাদের প্রশ্ন করতে পারেন ও তারা আপনার উত্তর দিতে পারেন।

কিন্তু এখানে কয়েকটা বিষয় লক্ষণীয়। এইসমস্ত লোকদের অফুরন্ত সময় নেই। এদের কাছ থেকে প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে এমন প্রশ্ন করতে হবে যা তার কাছে মনে হয় উত্তর দানের যোগ্য। এবং তিনি যেন বুঝতে পারেন আপনি ঠিকমতো পড়ালেখা করেই প্রশ্নটা করেছেন।

 

বাজে প্রশ্ন, ভালো প্রশ্ন

আপনার প্রশ্ন দেখেই এরা বুঝে নিতে পারবেন আপনি এর পেছনে পর্যাপ্ত সময় দিয়েছেন কি না।

বাজে প্রশ্ন কী কী রকম হতে পারে?

যেমন এমনভাবে প্রশ্ন যে আপনার শুনলেই মনে হবে প্রশ্নকর্তা সহজে আপনার কাছ থেকে জেনে নেবার জন্যই প্রশ্নটা করেছে। সে বই খুলে বা লেকচার দেখে উত্তর খুঁজবে এইসময় তার নেই। তাই আপনাকে প্রশ্ন করলো সহজে জানার জন্য। আপনি উত্তর দিবেন আর সে সহজে গিলে নিবে।

একজন বুদ্ধিমান লোকের উচিত না কখনো এমন প্রশ্নের উত্তর দেয়া। কারণ প্রশ্নকর্তা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে অসৎ, তার পরিশ্রমের ইচ্ছাই নেই এজন্য। বরং এখানে সময় নষ্ট না করে উচিত সত্যিকার আগ্রহী কারো প্রশ্নের উত্তরের জন্য সে সময় বরাদ্দ রাখা।

আরেক ধরণের প্রশ্ন হলো, যা বাজে বা ভ্রান্ত অনুমানের উপর ভিত্তি করে। অনুমানে প্রশ্নকর্তার ভুল হতে পারে, কিন্তু যদি সে বদ্ধ মস্তিস্ক হয়ে এ অনুমান থেকে নড়বে না এমন পন করে প্রশ্ন করে থাকে, তাহলে তার প্রশ্নের উত্তর দেয়া বৃথা।

আর সবচাইতে বাজে ও কুৎসিত প্রশ্ন হলো যখন প্রশ্নকর্তার জানার ইচ্ছা থাকে না, সে কতটুকু জানে সেটা দেখানো অভিপ্রায় থাকে। এগুলি আসলে প্রশ্নই নয়। প্রশ্নের আদলে বক্তা চায় অন্যদের ইমপ্রেস করতে।

আর ভালো প্রশ্ন?

ভালো প্রশ্নে প্রশ্নকর্তার জানার আগ্রহ প্রকাশ পায় এবং সমস্যাটি সমাধানে অংশ তিনি নিয়ে থাকেন।

একটি ভালো প্রশ্ন আরো অনেক প্রশ্নের তৈরী করে, বা ঐসব প্রশ্নের দিকে নিয়ে যায়। ভালো প্রশ্নের যে উত্তর থাকতেই হবে এমন নয়। না থাকতে পারে।

কিন্তু স্পষ্ট বুঝা যায় প্রশ্নকর্তা সমাধান বের করতে অংশ নিতে আগ্রহী। এখানে প্রশ্নকর্তা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তার সতর্ক, চিন্তাপূর্ণ সংযোজন প্রশ্নের উত্তর নির্মানে ব্যবহৃত হয়। তখন প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতার মধ্যে কথোপকথনের মাধ্যমে যৌথভাবে একটা সমাধান বা উত্তরের দিকে যায় প্রশ্নটি। নির্দিষ্ট উত্তর বের হতে পারে আবার নাও পারে। সেটা কোন সমস্যা নয়।

এখন আচমকা ধুম করে কেউ ভালো প্রশ্ন করা শিখে যাবেন এমন আমি বলি না। বাজে প্রশ্ন করতে করতেই লোকে ভালো প্রশ্ন করা শিখে। অন্য সব কাজেও যেমন ভুল করতে করতে সঠিকটা শেখা হয়।

তাই, আপনি যদি বাজে প্রশ্ন করে থাকেন অতীতে, বা এখনো করতে থাকেন; তাতে এই নয় যে আপনি কখনো ভালো প্রশ্ন করতে পারবেন না। নিয়মিত চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবেন।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং