প্রায় সব মা বাবাই চায় তার সন্তান যেন ভালো হয়। ভালো বলতে দয়া মায়া আছে এমন, অন্যের প্রতি মমতা আছে, সৎ ইত্যাদি। প্রায় ৫০ টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের মা বাবাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তারা তাদের সন্তানকে কীরকম দেখতে চান। এর উত্তরে সফল বা বেশী অর্জনকারী প্রথমে ছিল না, প্রথম উত্তর ছিল তারা তাদের সন্তানকে দেখতে চান কেয়ারিং হিসেবে। অর্থাৎ অন্যের প্রতি দয়া মায়া আছে এমন, মমতাহীন কেবল অর্জনকারী সন্তান বাবা মা’রা চান না। [১]
কিন্তু সন্তানরে এইভাবে গড়ে তোলা সহজ না। ইজরাইলে ৬০০ পরিবারে এমন একটি গবেষণা চালানো হয়। তাদের বাবা মা’রা ছিলেন অন্যের প্রতি কেয়ারিং কিন্তু সন্তানদের সেইভাবে গড়ে তুলতে পারেন নাই, রিসার্চে দেখা যায়। [২]
ওয়ার্টন স্কুলের সাইকোলজি অধ্যাপক এডাম গ্র্যান্ট দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মানুষের অন্যরে সাহায্য করা নিয়ে। নিঃস্বার্থ সাহায্য। এটি করতে গিয়ে তিনি ভাবলেন শিশুদের মধ্যে এই প্রবণতা কিভাবে গড়ে তোলা যায়। এই লেখাটি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তার একটি লেখার উপর ভিত্তি করে। ঐ লেখাটি পড়ে আমার খুবই গুরুত্বপূর্ন মনে হয়েছে।
একটি স্টাডিতে দেখা গেছে মানুষের কেয়ারিং এবং অন্যরে সাহায্য করার প্রবণতার চার ভাগের এক ভাগ [৩] থেকে প্রায় অর্ধেকের বেশী [৪] সে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে।
তাই কীভাবে শিশুরে লালন পালন করা হলো তা খুবই গুরুত্বপূর্ন তার ভেতরে কেয়ারিং এবং অন্যকে সাহায্য করার প্রবণতা জন্মানোর জন্য।
২ বছরের মধ্যে শিশুরে নৈতিক বোধ লাভ করতে শুরু করে। ভালো মন্দ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে থাকে। রিসার্চে দেখা গেছে, এই সময়ে প্রশংসা পুরস্কারের চাইতে বেশী কাজ করে শিশুকে বেশী কেয়ারিং হিসেবে গড়ে তুলতে। [৫] অর্থাৎ ভালো কাজ করলে পুরস্কার না দিয়ে প্রশংসা করাটা ভালো।
পুরস্কার দিলে শিশুদের মনে এই ধারণা জন্মে যে কোন বস্তুগত লাভ হলেই ভালো কাজ করতে হয়। এই ধারণা খারাপ।
এখন প্রশংসা করতে হলে কী ধরণের প্রশংসা করবেন বাবা মা? কাজটির প্রশংসা করবেন, যেমন, দারুণ কাজ করেছ? না মানুষটির প্রশংসা করবেন, তুমি একজন হেল্পফুল পারসন, ভালো মানুষ ইত্যাদি?
এ নিয়ে রিসার্চাররা পরীক্ষা [৬] করে দেখেছে কোনটা ভালো কাজ করে। তারা দেখেছেন যে ব্যক্তিকে (শিশুটিকে) প্রশংসা করলে সে পরবর্তীতে আরো ভালো কাজ করতে থাকে।
যখন শিশুটির চরিত্রকে প্রশংসা করা হয়, তাকে একজন সৎ সাহসী দয়ামায়া সম্পন্ন মানুষ ইত্যাদি বলা হয় তখন ঐ বিষয়টি তার পরিচয়ের সাথে যুক্ত সে মনে করে। ফলে পরবর্তীতে সে এইরকম আচরণ করার তাগিদ অনুভব করে।
কিন্তু কাজের প্রশংসা করলে, ‘যেমন খুব ভালো কাজ করেছ’ এমন হয় না।
দেখা গেছে ৩ থেকে ৬ বছর বয়েসীদের “সাহায্য করো” এর চাইতে “সাহায্যকারী হও” বললে শিশুরা বেশী সাহায্য করে থাকে। [৭]
“দুই নম্বরী করবে না” না বলে “একজন বাটপার হইও না” বললে শিশুদের অসদ উপায় অবলম্বনের হার অর্ধেক কমে যায়।[৮]
এই ব্যক্তিকে প্রশংসার উপকারীতা পাঁচ বছরের আগে শুরু হয় না। আবার দশ বছরের পরে এর কোন আলাদা বেশী প্রভাব থাকে না। বিশেষত আট বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে, যখন তার আত্মপরিচয় তৈরী হতে শুরু করে তখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রশংসা খুব ভালো কাজ করে।
আবার শিশুরা যখন কোন খারাপ কাজ করে তখন তাদের দুইটা অনুভূতি হয়। এক অপরাধবোধ আর দুই লজ্জা। রিসার্চে দেখা গেছে এই দুই ধরণের অনুভূতি ভিন্ন।[৯] অপরাধবোধ আত্মসমালোচনা এবং যে লোকটির প্রতি সে খারাপ কাজ করেছে তার প্রতি সমব্যথী করে তোলে। তার ঐ ভুল সংশোধন করার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। ভুল সংশোধনের সুযোগ থাকলে সে তাতে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু লজ্জা শিশুটির মনে এই ধারণা দেয় যে সে একজন খারাপ মানুষ। এটি তাই ক্ষতিকর। নিজেকে সে ক্ষুদ্র ও নগণ্য ভাবে, এর প্রতিক্রিয়ায় আরো ভায়োলেন্ট হয়ে উঠে, বা সমস্ত ব্যাপারটি এড়িয়ে যায়। [১০]
এটি এক গুরুত্বপূর্ন মেসেজ। শিশুদের লজ্জা দেয়া থেকে বিরত থাকা তাই জরুরী।
লজ্জা দেয়া হতে পারে যখন বাবা মা শিশুটির প্রতি রাগান্বিত হয়ে উঠেন, শাস্তি দেন, কথা বলেন না ইত্যাদি। এইসময়ে শিশুর ধারণা জন্মাতে পারে সে খারাপ লোক। [১১] এর ভয়ে অনেক পিতামাতা আবার কিছুই করেন না।[১২] তখন শিশুর অন্যদিকে ক্ষতি নয়, সে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হতে পারে না।[১৩]
সবচেয়ে ভালো পন্থা হলো বাবা মা নিজেদের হতাশা প্রকাশ করবেন। শিশুটিকে বুঝিয়ে দিবেন কেন ঐ আচরন খারাপ। কীভাবে এই খারাপ আচরণ অন্যদের উপর বাজে প্রভাব ফেলবে। এবং বুঝিয়ে দিবেন কীভাবে তারা সংশোধন করতে পারে। [১৪] [১৫]
এটি করলে শিশুরা আরো বেশী সহমর্মী হতে শেখে। অন্যের প্রতি তার দায়িত্ব সম্পর্কে শেখে ও নিজের কাজকে বিচার করতে শেখে। তাকে এক নৈতিক আত্মপরিচয় দিবে,[১৬] এবং অন্যের প্রতি হেল্পফুল করে তুলবে। [১৭]
সাইকোলজির আরেকটি ক্লাসিক পরীক্ষায় [১৮] দেখা গেছে শিশুরা দেখে শিখে। বাবা মা’রা অন্যের প্রতি হেল্পফুল হলে শিশুরা তা দেখে শিখবে। কিন্তু তারা যদি হেল্পফুল না হন, কিন্তু শিশুদের হেল্পফুল হতে উপদেশ দেন, তাহলে সাইকোলজির রিসার্চ মতে সে উপদেশ কাজ করবে না।
সুতরাং এই পোস্টের মূল কথা হলোঃ
১। শিশুদের হেল্পফুল কাইন্ড কেয়ারিং হিসেবে গড়ে তোলা যায়।
২। কোন কাজের প্রশংসার চাইতে ব্যক্তির প্রশংসা ভালো, বিশেষত ৫ থেকে ৮ বছরের বয়েসীদের জন্য।
৩। কোনভাবেই শিশুদের লজ্জা দেয়া যাবে না। তাদের মধ্যে অপরাধবোধ জাগ্রত করতে হতাশা প্রকাশ করতে হবে তারা কোন খারাপ কাজ করলে। বুঝিয়ে দিতে হবে কেন তা খারাপ এবং কীভাবে তা সংশোধন করা যায়।
৪। নিজে ভালো ও হেল্পফুল আচরণ করে শিশুর সামনে দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করতে হবে।
সাইকোলজিস্ট এডাম গ্র্যান্টের কাজের উপর ভিত্তি করে আরেকটি, লেখা আপনি গিভার না টেইকার?
very informative & helpful. I liked it.
Brilliant writing and should be applied. I appreciate it