মুরাদুল ইসলাম » ফিল্ম » লিওপল্ডের ভূত

লিওপল্ডের ভূত

কিছু ফিল্ম আছে যেগুলো দেখার আগে একজন মানুষ থাকে, দেখার পরে হয়ে যায় অন্য মানুষ। চিন্তা ভাবনায় অনেক পরিবর্তন আসে। অনেক সময় চিন্তা খুব মারাত্মকভাবে পরিবর্তিতও হয়ে যায়। সেরকমই একটা ফিল্ম কিং লিওপল্ড’স গোস্ট। লিওপল্ডের ভূত। ডকুমেন্টারী ফিল্মটি বানানো হয়েছে এডাম হসচাইল্ডের লেখা বইয়ের উপর ভিত্তি করে। পরিচালনা, বর্ননা এবং বলা যায় পুরো মেকিংটাই অসাধারণ। শুধু মেকিং এর দিক থেকেই একটি অন্যতম সেরা ডকুমেন্টারী ফিল্ম।

ghost

মানুষের ইতিহাস হচ্ছে দূর্বলকে নির্যাতনের ইতিহাস। কলোনির ইতিহাস যদি দেখা যায়, যত জায়গায় কলোনি করেছে সবল রাষ্ট্র সব জায়গাতেই নির্যাতন করেছে অকথ্য। এই ফিল্মে আছে বেলজিয়ামের কিং দ্বিতীয় লিওপল্ডের কংগোতে চালানো ভয়ংকর সব নির্যাতনের চিত্র। যা কোনভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিটলারের চেয়ে কম না। অনেকক্ষেত্রে বেশিই। এইসব নির্যাতনের জাস্টিফিকেশন ছিল নিজেকে সুপিরিয়র আর কংগোর লোকদের ইনফিরিয়র ভাবা। লিওপল্ড এদের মানুষই মনে করত না।

এই দ্বিতীয় লিওপল্ডের মনের বাসনা ছিল কলোনি তৈরী করবে। তার কাজিন কুইন ভিক্টোরিয়ার কলোনি এবং আরো বিভিন্ন ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রের কলোনি দেখে তার মনে শান্তি ছিল না। সে এক্সপ্লোরার পাঠাল কংগো বেসিনে।

তার নিযুক্ত এক্সপ্লোরার স্ট্যানলি গেল কংগোতে। গিয়া প্রথমে বান্দর মনে করে কিছু কালো মানুষ মারল। তারপর কালোদের পিঠে চেপে বসল। তখন এইসব অঞ্চল দূর্গম ছিল। তার সাথের কিছু লোক মারা পড়ল রোগে।

লিওপল্ড কংগোরে বলত ম্যাগনিফিসেন্ট কেক, যার এক টুকরাও ছাড়া যাবে না। সে স্ট্যানলিরে নির্দেশ দিল একটা বাহিনী তৈরী করতে। সেই বাহিনীরে অস্ত্র দেয়া হল। স্ট্যানলি নির্দেশ মত কংগোর বিভিন্ন গোত্র প্রধানদের সাথে চুক্তি করতে লাগল। বিভিন্ন জিনিসের বিনিময়ে গোত্রপ্রধানরা স্বাক্ষর দিয়ে দিল। কীসে স্বাক্ষর দিল বুঝতে পারল না কারণ লেখাপড়া তাদের কাছে অজানা ছিল।

এইভাবে লিওপল্ড স্ট্যানলির মাধ্যমে গোটা কংগো লিখে নিল গোত্রপ্রধানদের কাছ থেকে। তারপর শুরু হল কংগোতে হাতিমারা। কারণ হাতির দাঁতের মূল্য অনেক। হাতির দাঁত দিয়ে অনেক বিলাশ দ্রব্য হয়। ইউরোপে অনেক কদর এগুলোর।

হাজার হাজার হাতি নিধন হল। সেগুলো দাঁত খুলে নিয়ে আসা হল বেলজিয়ামে। চলল হাতির দাঁতের ব্যবসা।

লিওপল্ড এইদিকে ঠিক করল যে তার পুরা দেশের মালিক এটা দুনিয়াবাসীকে জানিয়ে প্রাইভেট কলোনি বানাতে হবে কংগোকে। বিভিন্ন পত্রিকায় কংগোতে তার মহানুভবতার কথা প্রকাশ করল সে। এরপর কায়দা কসরত করে তখনকার বিশ্ব নেতাদের কাছে কাগজ টাগজ দেখাইয়া নিজেই মালিক হয়ে বসল কংগোর। মানে কংগো পুরা দেশটার মালিক সে একাই।

Belgian Free State congo ATROCITIES - notice the EUROPEANS behind victims

এরপর শুরু হল তার আসল একশন। স্ট্যানলিরে দিয়া রেললাইন বানানোর কাজ শুরু করাইল। মানুষদের বাধ্য করল পাথর ভেঙে কাজ করতে। যারা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাইত এদের উপর নেমে আসত দূর্ভোগ এবং শেষপর্যন্ত মৃত্যু।

কংগো বেসিনটা সম্পদে পরিপূর্ন। রাবার, ইউরেনিয়াম ইত্যাদি নানা ধরনের সম্পদ। লিওপল্ড রাবার সংগ্রহে বাধ্য করল কংগোর লোকদের। এই কাজটা ঝুঁকিপূর্ন ছিল। কারণ খালি হাতে রাবার সংগ্রহ করতে হত। লোকদের এই কাজে বাধ্য করতে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ধরে নিয়ে যাওয়া হত। যেরকম এই অঞ্চলে করেছিল নীলকররা।

রাবার সংগ্রহে যারা জঙ্গলে যাইত তারা কম রাবার নিয়ে আসলে তাদের হাত কেটে ফেলা হত। শিশু, বৃদ্ধ, নারীসহ অজস্র লোকের হাত কাটা হয়েছে।

এক ভয়ংকর কলোনিয়ালাইজেশনের ইতিহাস। পুরো ফিল্মে দেখানো হয়েছে কংগো কীভাবে নির্যাতীত হয়েছে লিওপল্ডের মাধ্যমে। এবং এখন আরেক লিওপল্ড অথবা লিওপল্ডের ভূত সেখানে শোষন চালাচ্ছেন।

তিনি কে?

আর কেউ নন। ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা। যেই দেশে যাওয়ার জন্য আমাদের দেশের লোকেরা পাগলপ্রায়।

আমেরিকা কেন হাত বাড়ালেন? কারণ কংগো ইউরেনিয়ামসহ নানা সম্পদে পূর্ন। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে যে লিটল বয় আর ফ্যাটম্যান ফেলা হয়েছিল এগুলোর আশিভাগ ইউরেনিয়াম সংগৃহীত হয়েছিল এই কংগো থেকে। কংগোর লোকদের দিয়ে খালি হাতে এসব সংগ্রহ করানো হয়েছে। লোকদের উপর পড়েছে রেডিয়েশনের মারাত্মক প্রভাব।

কংগোতেও লিডার এসেছিলেন। নির্যাতীত জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন প্যাট্রিক লুবুম্বা। মনে হয়েছিল তখন লিওপল্ডের ভুতের কবল থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে কংগো। কিন্তু তাকে কম্যুনিস্ট আখ্যা দিয়ে খুন করার পথ করে দেয় ইউনাইটেড স্টেটস অব আম্রিকা। তারপর বেলজিয়ামের সাথে মিলে ক্যু করায়। প্যাট্রিক লুবুম্বাকে ধরে নিয়ে দুই তিন ঘন্টা নির্যাতন করে খুন করা হয়।

ফিল্মে ধরে নেয়ার পর অসহায় লুবুম্বার মুখ দেখা যায়। এর চেয়ে করুণ দৃশ্য আমি খুব কম দেখেছি। লুবুম্বা তখন নিশ্চয়ই মানুষের হিংস্র বর্বতায় ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার কী তখন নিজের দেশের কথা ভেবে দুঃখ হচ্ছিল? যে দেশকে স্বাধীন করেও তিনি মুক্ত করতে পারলেন না।

লুবুম্বার মৃত্যুর পর আসল আমেরিকার বসানো স্বৈরশাসক। যে নিজেই একটা ডাকাত, দেশের সম্পদ ডাকাতিতে বিদেশীদের সাহায্য করার পাশাপাশি ইউরোপে বাড়াতে লাগল নিজের সম্পদ। হানাহানি, খুন, বিভৎসতার দিকে আবার ফিরে গেল কংগো। আবার ফিরে আসল এবং ঝেঁকে বসল লিওপল্ডের ভূত।

ভালো মানুষও ছিলেন। ই ডি মোরেল কিংবা জর্জ ওয়াশিংটন উইলিয়ামস লিওপল্ডের নির্যাতনের প্রতিবাদ করে গেছেন। জোসেফ কনরাড লিওপল্ডের মহানুভব কাজের ভক্ত ছিলেন। তিনি একবার ভ্রমণে গিয়েছিলেন কংগো। কংগোতে লিওপল্ডের নির্যাতনের বিভীষিকা দেখে ফিরে এসে মানবজাতি সম্পর্কে তার ধারণাই পালটে যায়। তিনি লিখেন ইংরেজি ভাষার একটি বহুল পঠিত ক্ষুদ্রাকৃতির উপন্যাস হার্ট অব ডার্কনেস।

Punch_congo_rubber_cartoon.ashx

এই ফিল্মটি কেন দেখা প্রয়োজন?

আমরা সাধারণত আফ্রিকায় কলোনিয়ালাইজেশনের ইতিহাস জানতে পারি না। পাঠ্যপুস্তকে নাই, মিডিয়াতে আসে না, বই টই এসব নিয়ে বেশি লেখা হয় না। ফলে হয় কী, আমরা নিজেদের একটু আধটু জেনেই কলোনিয়ালিস্টদের নিয়ে হালকা পাতলা ধারণা নিয়ে বসে থাকি। এর ফলে পৃথিবীর সামগ্রিক পরিস্থিতি বুঝতে অসুবিধা হয়। মিডিয়া যেটা দেয়, সেটাকে পরখ করার কোন পথ থাকে না।

কিন্তু এসব ইতিহাস জানা থাকলে আমরা বুঝতে পারব কে কী করেছে। কার ব্রুটালিটি কেমন ছিল। যে আমাদের মানবতার গান শেখাচ্ছে সে আদৌ আমাদের মানবতা শেখানোর যোগ্য কী না।

(খুব সহজে এবং কম সময়ে জানতে চাইলে আমি বলব গুগলে ইমেজ সার্চ দিন লিওপল্ডের ভুত (King Leopold’s Ghost) লিখে। সময় কম থাকলে এভাবে সহজে যেকোন বিষয় নিয়ে জানা যেতে পারে। ছবি হাজার শব্দের সমান শক্তিশালী।)

আজ এই বেলজিয়ামের জাঁকঝমক কংগোর সম্পদ এবং মানুষের লাশের উপর গড়ে উঠেছে। কংগোর ছোট ছোট শিশুরা অস্ত্র হাতে নিজেদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করে মরছে। এগুলোর সবই তো এরা তৈরী করে রেখেছে। এই ইউএসএ, বেলজিয়াম। লিওপল্ডের ভূতেরা।

এই ক্যাপিটালিস্ট সমাজ এবং মিডিয়ার যুগে নিত্য নতুন ইলেক্টনিক্স পণ্যের সমারোহ। নতুন নতুন চাহিদার তৈরী করা হচ্ছে ভোক্তাদের মধ্যে। এর জন্য আছে হাজারো মার্কেটিং এবং বিজ্ঞাপণ ব্যবস্থা। কিন্তু এসব ইলেক্ট্রনিক পণ্যের ট্যানটালাম ক্যাপাসিটর তৈরীর জন্য ব্যবহৃত কোলটানের প্রায় ৭০ ভাগের বেশি আসে কংগো থেকে। সেখানে খালি হাতে এগুলো লোকদের দ্বারা সংগ্রহ করানো হয়। এগুলো স্মাগলিং এ বড় হাত বিস্তার করে আছে লিওপল্ডের ভূতেরা, সুতরাং প্রাণহানি হচ্ছে নিরন্তর।

আমরা যে মোবাইল ব্যবহার করি তার জন্য কোলটান সংগ্রহ এবং স্মাগলিং এ হয়ত কয়েকটা কংগোর ছেলে মরে গিয়েছিল। কে সঠিক বলতে পারে, হতেও পারে তো।

এমন যদি হয় যে, আমাদের মোবাইলের কোলটান কংগোর লোকদের রক্ত এবং ঘামের জলে ধোয়া, তবে কী লিওপল্ডের ভূতদের কংগোতে চালানো এক্সপ্লোয়েটশনে আমরাও অংশ নিয়ে ফেলছি, না জেনে?

 

(অনেক মারাত্বক ছবি ছড়িয়ে আছে লিওপল্ডের কংগোতে চালানো নির্যাতন নিয়ে। সেগুলো এখানে আর দিলাম না। লিওপল্ডের ছবিও দিলাম না ঘৃণা থেকে। এখানে যতগুলো ছবি ব্যবহৃত হয়েছে এর কোনটাই আমার না। যারা এগুলো তৈরী করেছেন ছবি ক্রেডিট সম্পূর্ণরূপে তাদের। এখানে ইতিহাস হালকাভাবে তুলে ধরা হয়েছে। খুব সামান্য। কোন সন তারিখ ইত্যাদি উল্লেখ নেই।ফিল্মে বা বইয়ে বিস্তারিত আছে। আগ্রহীদের জন্য বইটি পড়া বা ফিল্মটি দেখার কোন বিকল্প নেই।)

 

এই লেখার আরেকটি রূপ নকটার্নে প্রকাশিতঃ হরর! ইট’স হরর! : ‘‘কিং লিওপল্ড’স গোস্ট’’ প্রামাণ্য চিত্রে বিভীষিকা ::

2 thoughts on “লিওপল্ডের ভূত”

  1. Pingback: ‘হু ক্যান কিল এ চাইল্ড?’ :: মুরাদুল ইসলাম |

  2. Pingback: ‘হু ক্যান কিল এ চাইল্ড?’ :: মুরাদুল ইসলাম |

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং