মুরাদুল ইসলাম » অবশ্যপাঠ্য » ইতিহাসের শিক্ষাসমূহ

ইতিহাসের শিক্ষাসমূহ

উইল ডুরান্ট এবং তার স্ত্রী এরিয়েল ডুরান্ট ইতিহাসবিদ, তারা লিখেছেন ১১ খন্ডে দ্য স্টোরি অব সিভিলাইজেশন বা সভ্যতার গল্প। তাদের আরেকটি বই দ্য লেসনস অব হিস্টরী বা ইতিহাসের শিক্ষাসমূহ। এতে এক ধরনের সারমর্ম আছে দুই ইতিহাসবিদের ইতিহাস গবেষণা এবং সেগুলি থেকে প্রাপ্ত অন্তদৃষ্টি বা ইনসাইটের। এই লেখায় আমি আনতে চাইব ইতিহাস কী সে সম্পর্কে ডুরান্টদ্বয়ের মত, মানব ইতিহাসে ভূগোলের প্রভাব, অসাম্য এবং ইতিহাসের বায়োলজিক্যাল শিক্ষা সম্পর্কে  তাদের বক্তব্য।

ইতিহাস সত্য কি?

ইতিহাস কি সত্য? যা লেখা হয়েছে, যেভাবে লেখা হয়েছে এমনই কী সত্যি সত্যি ঘটনা ঘটেছিল। নাকী অনেক ঘটনা বলা হয় নি, উঠে আসে নি ইতিহাসে। উইল ডুরান্ট এবং এরিয়েল ডুরান্ট ইতিহাসকে সত্য বলেন নি। তাদের কথায়ঃ

মাঝে মাঝে আমাদের মাঝে সন্দেহ এসে ভীড় করে, এমন মনে হয় যে আমরা কি আসলেই জানি অতীতে সত্যি সত্যি কী হয়েছিল,  নাকী ইতিহাস একটি রূপকথার মত যাতে একমত হওয়া যায় না? অতীতের কোন ঘটনা নিয়ে আমাদের জ্ঞান সব সময়েই অসম্পূর্ন, হয়ত ভুল, পরস্পরবিরোধী তথ্য উপাত্তে এবং পক্ষপাতদুষ্ঠ ইতিহাসবিদে ভর্তি এবং তারা হয়ত নিজেদের দেশপ্রেম বা ধর্মীয় পক্ষপাতে অর্ধান্ধ।

“অধিকাংশ ইতিহাসই  হচ্ছে অনুমান এবং বাকী সব হচ্ছে প্রেজুডিস (পূর্বের বদ্ধমূল ধারণা।)”; এমনকী যেসব ইতিহাসবিদ দেশ, জাতি, ধর্ম ইত্যাদির উপরে উঠবেন ভাবেন, তারাও বিষবস্তু চয়নে এবং উদ্দেশ্য যৎসামান্য পরিবর্তন ইত্যাদির ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেন।”

 

ইতিহাস বিজ্ঞান নয় এবং এর বেশীরভাগই অজানাসে সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডুরান্টদ্বয় মত দিলেনঃ

“ইতিহাসবিদ্যা অবশ্যই বিজ্ঞান নয়। এটাকে বলা যেতে পারে ইন্ডাস্ট্রি, শিল্প এবং দর্শন। ইন্ডাস্ট্রি এই কারনে সত্য খোঁজা বা তুলে আনা,  আর্ট এই কারণে যে তা বিশৃঙ্খলার মাঝে শৃঙ্খলা তৈরীর প্রয়াস, এবং দর্শন এই কারনে এর মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গী এবং জ্ঞান (এনলাইটনমেন্ট) খোঁজা।”

“আমরা মানুষের পুরো ইতিহাস জানি না; সুমেরিয়ান বা মিশরীয় সভ্যতার পূর্বেও হয়ত আরো অনেক সভ্যতা ছিল, আমরা তো কেবল খুঁড়তে শুরু করলাম!”

 

ভূ-প্রকৃতি গুরুত্বপূর্ন

ভূ-প্রকৃতি মানুষের চরিত্র কেমন হবে, তাতে প্রভাব ফেলে। এছাড়াও জ্যারেড ডায়মন্ড তার বইতে দেখিয়েছেন কীভাবে ইতিহাসের নানা সময়ে মানুষ ভূ-প্রকৃতির সাহায্য পেয়ে এসেছে। যেসব অঞ্চলে শক্তিশালী পোষ মানানোর মত প্রাণী ছিল তারা বেশী সুবিধা পেয়ে এসেছে। অনেক অঞ্চলে আরেকটি সুবিধা দিয়েছে কম তাপমাত্রা। তবে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ভূ-প্রকৃতির প্রভাব অনেক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে মানুষ। উদ্ভাবন প্রতিভাধর মানুষ ভূ-প্রকৃতি্র সীমাবদ্ধতাকে অনেক দিক দিয়েই জয় করতে সক্ষম। ডুরান্ট দ্বয় এ বিষয়ে বলেনঃ

“মন্টেস্কু ও বাকলে যেভাবে বলেছিলেন ওইভাবে পরিবেশ প্রকৃতি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে না আর, কিন্তু এটি আমাদের সীমাবদ্ধ করে। মানুষ তার অন্যন্য ক্ষমতার কারণে ভৌগলিক প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে প্রায়ই, সে মরুভূমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে পারে, সাহারাকে করতে পারে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, সে পাহাড় কেটে সমতল বানাতে পারে, পাহাড়ের সোপানগুলি ভরে দিতে পারে দ্রাক্ষালতায়, সমুদ্র পারি দিতে বানাতে পারে ভাসমান শহর,  অথবা আকাশে উড়তে বানাতে পারে বিশাল পাখি। কিন্তু একটি টর্নেডো এক ঘন্টায় ধ্বংস করে দিতে পারে শত বছরে নির্মিত কোন শহর। কোন হিমশৈল ভেঙ্গে দিতে পারে ভাসমান প্রাসাদ এবং হাজারো আনন্দ উৎসবকারীকে পাঠিয়ে দিতে পারে চির নিশ্চয়তায়।”

“বৃষ্টি যদি কমে যায়, সভ্যতা চাপা পড়ে যায় বালির নিচে, যেমন কেন্দ্রীয় এশিয়ায় হয়েছে। বৃষ্টি যদি খুব বেশী হয়, সভ্যতা জঙ্গলে পূর্ন হয়ে উঠে, যেমন হয়েছে কেন্দ্রীয় আমেরিকায়। তাপমাত্রা গড়ে যদি বিশ ডিগ্রী বাড়ালে আমরা সম্ভবত অসাধারন বর্বরতায় পুনঃপতিত হবো। সেই অবস্থায় আধা গ্রীষ্মমন্ডলীয় একটি পরিবেশে অর্ধ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর কোন জাতি পিঁপড়ার মত বংশবিস্তার করতে পারে, অধিক তাপমাত্রার কারণে তারা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তা অন্যান্য এলাকার আক্রমণকারীদের জন্য সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে তাদের। মানুষের প্রজাতি পৃথিবীর উপর তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু এর মাটিতেই ফসিল হওয়া তাদের নিয়তি।”

“কিন্তু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আমাদের উপর ভূগোলের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে।”

“ভূগোলের প্রভাব অনেক কমেছে প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে সাথে। ভূ-প্রকৃতির গঠন ও ধরন কৃষি, খনিজ, ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুবিধা দিতে পারে, কিন্তু নেতাদের চিন্তাশক্তি ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ, এবং পরিশ্রমী অনুসরনকারীতা, সেই প্রকৃতির দেয়া সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারে এবং কেবল এই ধরনের সমাহারই ( ইজরায়েলের মত) একটি সংস্কৃতি তৈরী করতে পারে হাজারো বাঁধা পেরিয়ে।। প্রকৃতি নয়, মানুষই তৈরী করে সভ্যতা।”

কয়েকটি বিষয় এখান থেকে দেখা যেতে পারেঃ

১। ভূ-প্রকৃতি সুবিধা দিতে পারে।

২। সে সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য দরকার উন্নত চিন্তাশক্তির নেতা

৩। চিন্তা অনুযায়ী নেতাদের পদঃক্ষেপ নেয়া।

৪। নেতাদের অনুসরন করে কাজ করার মত অনুসরনকারী।

এইসব থাকলেই কোন দেশ তার ভূ-প্রকৃতির সুবিধা কাজে লাগিয়ে, বা ভূ-প্রকৃতির অসুবিধা কাটিয়ে উঠে এগিয়ে যেতে পারে।

 

বিশাল প্রাণীকূলে মানুষ খুবই গুরুত্বপূর্ন নয়

মানুষ হিসেবে আমাদের মধ্যে সবসময় কাজ করে শ্রেষ্টত্বের বোধ। আমরা মনে করি আমরাই সব কিছুর কেন্দ্রে। যতক্ষণ না আমরা মহাবিশ্বের বিশালতা অনুভব করি। যেমন, কার্ল স্যাগানের ভয়েজারের এক মিশন থেকে ছোট নীল বিন্দুর মত পৃথিবীকে দেখে অনুভব করেছিলেন। ডুরান্টদ্বয় একই ধরনের একটি অনুভূতি আমাদের সামনে তুলে ধরেন, পৃথিবীর ইতিহাস থেকেঃ

“ইতিহাস জীববিজ্ঞানের একটি খন্ডাংশঃ মানুষের জীবন হচ্ছে ভূমিতে ও সমুদ্রে বসবাসকারী বিশাল জীবজগতের একটা অংশ। মাঝে মাঝে কোন এক গ্রীষ্মের দিনে হাঁটতে গিয়ে আমরা যদি একা একা জঙ্গলে গিয়ে উপস্থিত হই, আমতা শুনি বা দেখি যে হাজারো প্রজাতির কেউ উড়ে যাচ্ছে, লাফিয়ে যাচ্ছে, হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে, কেউ বা গর্তে। বিস্ময়ে অভিভূত প্রাণীকূল আমাদের আগমনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে যায়। পাখিরা উড়ে যায়, মাছেরা নদীতে অদৃশ্য হয়ে যায়। হঠাৎ আমাদের মনে হয় এই নিরপেক্ষ পৃথিবীতে আমরা কত বিপজ্জনক সংখ্যালঘু শ্রেণীতে আছি, এবং অল্প সময়ের জন্য আমরা অনুভব করতে পারি যে ঐসব প্রাণীদের প্রাকৃতিক বাসস্থানে আমরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। তারপর ইতিহাসের সব ধারাবিবরনী এবং মানুষের সব অর্জন বিনীত ভাবে পড়ে ইতিহাসে এবং বহুরূপী জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে; আমাদের সব অর্থনৈতিক প্রতিযোগীতা, সঙ্গীর জন্য বিবাদ, আমাদের ক্ষুধা ও ভালোবাসা, দুঃখ এবং যুদ্ধ, একইরকম খোঁজা, পুনরুৎপাদন, সংগ্রাম, যাতনাভোগ সবই এইসব পতিত গাছ ও পাতার নিচে লুকায়, অথবা এইসব পানিতে বা গাছের ডালে ডালে।”

 

অসাম্য বাস্তবতা

একসময় মানুষ সহযোগীতা মূলক হান্টার-গেদারার বা শিকার-সংগ্রহ সমাজে ছিল। তখনকার এক সময়ে সমাজে শ্রেনী বিভেদ ও বৈষম্য ছিল না। কিন্তু যখন তথাকথিত “সভ্য” সমাজের শুরু হলো, কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও নগরের উদ্ভব হতে লাগল, তখন থেকেই অসাম্য আমাদের নিত্যসঙ্গী। ডুরান্টদ্বয়ের ইতিহাসের শিক্ষা বইটি ইতিহাস নিয়ে নয়, ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে মূলত। এবং তারা এই তথাকথিত সভ্য সমাজ বা লেখা প্রচলন হবার পর থেকে ধরে যে ইতিহাস, তার আলোকেই ইতিহাসের শিক্ষাকে তুলে ধরছেন।

“অসাম্যতা প্রাকৃতিক এবং আজন্ম বিদ্যমান ব্যাপারটা শুধু এমন নয়, সভ্যতার জটিলতা বাড়ার সাথে সাথে অসাম্যতা বাড়তে থাকে। উত্তরাধিকারগত অসাম্যতার কারণে সামাজিক এবং কৃত্রিক অসাম্যতার তৈরী হয়, প্রতিটি উদ্ভাবন বা আবিষ্কার হয়েছে বা দখলকৃত হয়েছে অসাধারন ব্যক্তিদের দ্বারা, এতে শক্তিমান হয়েছে আরো শক্তিশালী এবং দূর্বল হয়েছে আগের চাইতে অপেক্ষাকৃত বেশী দূর্বল। অর্থনৈতিক উন্নয়ন কাজকে গুরুত্ব দেয়, দক্ষতাকে আলাদা করে এবং দলের লোকদের গুরুত্বে ভিন্নতা বা অসাম্যতা তৈরী করে। আমরা যদি আমাদের লোকদের চিনি ভালোভাবে তাহলে আমরা ত্রিশ জন নির্বাচন করতে পারব যাদের সামগ্রীক ক্ষমতা বাকী সবার সম্মিলিত ক্ষমতার সমান। জীবন ও ইতিহাস ঠিক তাই করে, ক্যালভিনের ঈশ্বরের মহিমান্বিত অবিচার স্মারকসমেত।”

 

স্বাধীনতা ও সমতা একে অন্যের শত্রু

“স্বাধীনতা এবং সাম্য একে অন্যের চিরশত্রু, যখন একটা শক্তিশালী হয়, অন্যটার মৃত্যু হয়। মানুষকে মুক্ত করে ছেড়ে দিন, তাদের প্রাকৃতিক অসাম্য প্রায় জ্যামিতিকভাবে বেড়ে যাবে, যেমন অবাধনীতির সময়ে ১৯ শতকের ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় হয়েছিল। অসাম্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিতে হয়, যেমন হয়েছিল রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে। এমনকী নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থাতেও অসাম্য বাড়তে থাকে, যেসব লোক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গড়ের নিচে থাকে এরাই সাম্য চায়, যারা সচেতন ও উন্নত দক্ষতার এরা চায় স্বাধীনতা, এবং শেষপর্যন্ত উন্নত দক্ষতা তার পথ খুঁজে নেয়। সাম্যের স্বপ্ন বা কল্পালোক কল্পনা জীবতাত্ত্বিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে, এবং সবচেয়ে ভালো যে ব্যবস্থা অমায়িক দার্শনিক চাইতে পারেন তা হলো আইনগতভাবে ন্যায়বিচারের সাম্য ও শিক্ষাগত সুযোগের সাম্য।”

 

প্রকৃতি ব্যক্তিতে আগ্রহী নয়, প্রজাতিতে আগ্রহী

“বায়োলজিক্যাল ইতিহাসের তৃতীয় শিক্ষা হলো জীবন অবশ্যই পুনরোৎপাদন করবে। যেসব প্রানী, গ্রুপ বা প্রজাতি প্রচুরভাবে পুনরোৎপাদন করতে পারে না, প্রকৃতির দরকার নেই তাদের। প্রকৃতির কোয়ালিটি নির্বাচনের জন্য দরকার কোয়ান্টিটি অর্থাৎ প্রচুর পুনরোৎপাদন, প্রচুর বাচ্চা কাচ্চা সে পছন্দ করে এবং সেখান থেকে সংগ্রাম করে যে অল্প ক’টি টিকে থাকতে পারে তাদেরকেই সে নির্বাচন করে। প্রকৃতি ব্যক্তির চাইতে প্রজাতিতে বেশী আগ্রহী, এবং সভ্যতা ও বর্বরতার মধ্যে সে কোন পার্থক্য করে না। উচ্চ জন্মহার তুলনামূলক বাজে সভ্যতা এবং নিম্ন জন্মহার সংস্কৃতিগতভাবে তুলনামূলক ভালো সভ্যতা নিয়ে আসে, এতে প্রকৃতির কিছুই আসে যায় না; সে এভাবে দেখে যে যাদের জন্মহার কম সে জাতি একসময় অধিক বীর্যবান ও উর্বর কোন জাতি দ্বারা পর্যায়ক্রমে শোধিত হবে।”

 

উইল ও এরিয়েল ডুরান্ট

উইল ও এরিয়েল ডুরান্ট

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং