মুরাদুল ইসলাম » ক্রিটিক্যাল থিওরী » দ্য লাইভস অব আদারসঃ অন্যের জীবনসমগ্র

দ্য লাইভস অব আদারসঃ অন্যের জীবনসমগ্র

শুরু

যদিও একজন ব্যক্তি সাধারণত ফিল্মের গল্প দেখেন বা বইয়ের গল্প পড়েন, অনেকটা নিছক বিনোদন হিসেবে, কিন্তু তবুও এইসব গল্পের প্রভাব তার উপর পড়ে সুদূরপ্রসারী ভাবে। গল্প নিছকই গল্প নয়। কোন গল্প মানুষকে আরো মানবিক করে তুলতে পারে, কোন গল্প করে তুলতে পারে হিংস্র। মানুষের মনোজগতে গল্পের প্রভাব ও পরিবর্তন সহসাই দেখা যায় না, ধীরে ধীরে সংঘটিত হয় বলে অনেকের চোখে পড়ে না।

যেকোন গল্পই দর্শক বা পাঠক অনুভব করেন, বুঝেন নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে। নির্মাতা বা লেখক যে গল্প বলেছেন, যে অর্থ দিয়েছেন, তার সাথে পাঠক বা দর্শকের অভিজ্ঞতা মিলেমিশে এক নতুন অর্থ তৈরী করে। অনেক সময় এই অর্থ মানুষের অব্যক্ত অনুভূতিকে ভাষা দেয়, মানুষের নিজেকে বুঝতে সহায়তা করে।

মূলঃ

দ্য  লাইভস অব আদারস (২০০৭) ফিল্মের গল্প সময়কাল ১৯৮৪, পূর্ব জার্মানীতে। সেখানে চলছে তীব্র সমাজতন্ত্র। ভয়ংকর গোপন গোয়েন্দা সংস্থা স্টাসির জিজ্ঞাসাবাদ পন্থা দেখিয়েই ফিল্মের গল্প শুরু করা হয়।

জার্ড উইজলার স্টাসির একজন ক্যাপ্টেন। একসময় সে স্টাসি থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় নাট্যকার ড্রেম্যানের উপর চোখ রাখার। ড্রেম্যানের ঘরে তারা গোপন প্রযুক্তি সব সেট করে এবং মাইক্রোফোনে কান লাগিয়ে নিরব নিথর হয়ে জার্ড উইজলার শুনতে থাকে ড্রেম্যানের কথাবার্তা, জীবনযাপন। ড্রেম্যান থাকতেন তার প্রেমিকা ক্রিস্টা মারিয়া জিল্যান্ডকে নিয়ে।

ড্রেম্যানই তাদের একমাত্র লেখক যাকে এখন পর্যন্ত পশ্চিমে পড়া হয়। স্টাসি থেকে সন্দেহ করা হয় ড্রেম্যান হয়ত সমাজতন্ত্র বিরোধী।

জার্ড উইজলারের বিগ ব্রাদার হয়ে ড্রেম্যানের জীবন যাপনের উপর চোখ রাখাই ফিল্মের প্রধান গল্প। রাষ্ট্র যখন টোটালিটারিয়ান হয়ে উঠে তখন সে কীভাবে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তাই উঠে এসেছে এখানে। কিন্তু এই সরল গল্পের বাইরে গিয়েও ফিল্মের গল্পটিকে দেখা যায়।

ফিল্ম এগিয়ে গেলে দেখা যায় জার্ড উইজলার পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। ক্রুর কঠিন অফিসার থেকে সে একজন মানবিক মানুষে পরিণত হচ্ছে অন্যের জীবনের ভেতরে প্রবেশ করে। এখানে এই অন্যের জীবনটা কী?

(1875 – 1961). (Photo by Hulton Archive/Getty Images)

সাইকোএনালিস্ট, ও এনালিটিক সাইকোলজির ফাদার ফিগার কার্ল গুস্তাব জাং এর  তত্ত্বমতে, মানুষের নিজস্ব অবচেতনের বাইরেও একটি কালেকটিভ বা সমগ্র অবচেতন রয়েছে। এই সমগ্র অবচেতন সে পেয়েছে তার প্রজাতিগত উত্তরাধিকার হতে। এই সমগ্র অবচেতনে, প্রতিটি মহিলার ভেতরে রয়েছে একটি পুরুষস্বত্তা এবং প্রতিটি পুরুষের ভেতরে রয়েছে এক নারী স্বত্তা।

নারীদের সমগ্র অবচেতনের পুরুষস্বত্তার নাম দিয়েছেন এনিমাস। পুরুষের সমগ্র অবচেতনের নারী স্বত্তার নাম এনিমা।

Every man carries within him the eternal image of woman, not the image of this or that particular woman, but a definite feminine image. This image is fundamentally unconscious, an hereditary factor of primordial origin engraved in the living organic system of the man, an imprint or “archetype” of all the ancestral experiences of the female, a deposit, as it were, of all the impressions ever made by woman-in short, an inherited system of psychic adaptation. Even if no women existed, it would still be possible, at any given time, to deduce from this unconscious image exactly how a woman would have to be constituted psychically. The same is true of the woman: she too has her inborn image of man.

“Marriage as a Psychological Relationship” (1925) In CW 17: The Development of the Personality. P.338

দ্য লাইভস অব আদারস গল্পে জার্ড উইজলার এবং ড্রেম্যান ও তার প্রেমিকার জীবন মূলত একজন ব্যক্তির জীবন হিসেবে দেখা যায়। জার্ড উইজলার তার সমগ্র অবচেতন এর নারীস্বত্তার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল, এবং তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে সে ধীরে ধীরে এই নারী স্বত্তাকে বুঝতে পারে। ড্রেম্যানের শিল্পজীবন, সংগীত ইত্যাদি তাকে এক ভিন্ন জীবন, এক পূর্ন জীবনের দিকে নিয়ে যায়।

এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়েই জার্ড উইজলার পূর্ন মানুষ হয়ে উঠে। উইজলারের সাথে প্রথম ড্রেম্যানের দেখা হয় বা ড্রেম্যানকে সে প্রথম দেখতে পায় থিয়েটারে। তখন উইজলার দুরবীন দিয়ে বার বার উইজলারকে নিরীক্ষণ করতে থাকে। এই ধাপ হচ্ছে তার নারী স্বত্তার সাথে প্রথম পরিচয়, এখানে তার ডেজায়ারের উৎপত্তি। একে বলা হয় ইভ।

এরপরে যখন সে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর জন্য ড্রেম্যানের বাড়িতে প্রযুক্তি সেট করে, যখন প্রথমদিকে সে তাদের শুনতে থাকে; তখন উইজলার ড্রেম্যানের জীবনকে দেখে নিজের ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জনের উপায় হিসেবে। তার লক্ষ্য সন্দেহজনক কিছু বের করা এবং দেশের শত্রুকে নিধন করা। এর ফলে নিজের সুনাম ও পদ বৃদ্ধি। নারী স্বত্তার সাথে তার এই সম্পর্ক হলো দ্বিতীয় ধাপের রূপক, যার নাম হেলেন।

তৃতীয় পর্যায়ে এসে জার্ড উইজলার দেখতে পাইয় ড্রেম্যানের শিল্পজীবনের ভার্চু বা সদগুণাবলী। সে এমন জিনিস দেখে যা তার ভেতর নেই, কিন্তু এই ভার্চুয়াস লাইফে সে আকৃষ্ট হয়। এই পর্যায়ের নাম ম্যারী।

চতুর্থ পর্যায় সোফিয়া। গ্রীক এই শব্দের অর্থ উইজডম বা প্রজ্ঞা। উইজলার তখন তার নারীস্বত্তার প্রজ্ঞা দেখতে পায়। ভালো বা খারাপের বিচারে সে যায় না, কারণ অথোরিটারিয়ান সমাজতন্ত্র যে খারাপ এবং মানুষের মানবিক বেঁচে থাকার পথে অন্তরায় উইজলার তা বুঝতে পারে।

প্রথমদিকে জার্ড উইজলারকে দেখা যায় রোবটের মত। কিন্তু শেষের দিকে তার ভেতরে দেখা উইজলার একজন মানবিক এবং প্রজ্ঞাবান মানুষ। আরেকজন অফিসারও কিন্তু ড্রেম্যানের জীবন মাইক্রোফোন দিয়ে শুনেছে, কিন্তু তার কোন পরিবর্তন হয় নি। অর্থাৎ, মূলত এখানে গল্পটা উইজলারেরই।

উপসংহারঃ

ফিল্ম একজন ভিজুয়াল অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে আমাদের নিয়ে যায়। আমরা ফিল্মে অন্যের জীবন দেখি। তাদের ভাব, ভাষা, অনুভূতি আমাদের স্পর্শ করে।  সে স্পর্শ অনেক সময় আমাদের ভেতরের অনেক সুপ্ত অনুভূতিকে নাড়া দেয়, জাগিয়ে তুলে। তাই ফিল্ম একধরনের সাইকোলজিক্যাল জার্নি।

দ্য লাইভস অব আদারস ফিল্মে ব্যক্তি জার্ড উইজলারের এমনই এক সাইকোলজিক্যাল জার্নি দেখা গেল। এই ফিল্মের শেষ দৃশ্যটি অসাধারণ লেগেছে, তখন জার্ড উইজলার বই খুলে, ফিল্ম ইতিহাসের অন্যতম সেরা টাচি একটি দৃশ্য।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং