মুরাদুল ইসলাম » মাঙ্গারিজম » দুই ধরনের জ্ঞান ও তলস্তয় ইফেক্ট

দুই ধরনের জ্ঞান ও তলস্তয় ইফেক্ট

চার্লি মাঙ্গার সম্পর্কে বিল গেটস বলেন মাঙ্গার হচ্ছেন তার দেখা সবচেয়ে ব্রডেস্ট থিংকার। মানে তার চিন্তার বিস্তৃতি বিশাল। ওয়ারেন বাফেট মনে করেন যৌক্তিকতার বিরল প্রতিভা নিয়েই জন্ম নিয়েছেন চার্লি, যেখানে তার সাথে আর কোন মানুষের তুলনা চলে না। বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা এবং সম্মানীত একজন ব্যবসায়ী তিনি; এবং অসাধারণ প্রজ্ঞার কারণে তিনি একজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বী। তার প্রজ্ঞাংশ নিয়ে মাঙ্গারিজম সিরিজ।

 

দুই ধরনের জ্ঞান  

 

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাংক জার্মানীতে গেলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপরে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। তার সাথে বক্তৃতা অনুষ্ঠানে যেত তার ড্রাইভার। যেতে যেতে এবং বসে শুনতে শুনতে প্ল্যাংকের বক্তৃতা ড্রাইভারের মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। একদিন ড্রাইভার বলল, “প্রফেসর প্ল্যাংক, আমার বসে থাকতে খুব বিরক্তি লাগে। আপনি কিছু মনে না করলে এবার আপনার বক্তব্য আমি দিতে চাই। আপনি ড্রাইভারের হ্যাট পরে বসে থাকুন।”

প্ল্যাংক বললেন, “ঠিক আছে।”

ড্রাইভার গেল। সে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপরে নির্ভুল বক্তৃতা দিয়ে ফেলল। বক্তৃতা শেষে একজন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ভারী একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। ড্রাইভার তখন একটুও না ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “মিউনিখের মত এত আধুনিক শহরে এমন সাধারণ প্রশ্ন পেয়ে আমি অবাক হলাম। এর উত্তর দিতে আমি আমার ড্রাইভারকে ডাকছি।”

সাধারণত এই গল্পকে বেশীরভাগ লোকেই মনে করেন ড্রাইভারের উপস্থিত বুদ্ধি’র গল্প।

কিন্তু এই স্থুল জিনিসের বাইরেও গল্পটিতে বুঝার মত গুরুত্বপূর্ন জিনিস আছে। এই গল্পটিতে দুই ধরনের জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়।

এক- ম্যাক্স প্ল্যাংক যা জানেন। তিনি এই জানার জন্য মূল্য দিয়েছেন। তার জীবনের প্রচুর সময় অর্থাৎ জীবনের বড় অংশ। অনেক কিছু তিনি ত্যাগ করেছেন, করতে পারেন নি এই জ্ঞাণ অর্জনের জন্য। এর বিনিময়ে তিনি এই জ্ঞান অর্জন করেছেন। হেনরি ডেভিড থরো’র একটা কথা আছে, “দ্য প্রাইস অব এনিথিং ইজ দ্য এমাউন্ট অব লাইফ ইউ এক্সেঞ্জ ফর ইট।”

দুই- ড্রাইভারের জ্ঞান। সে (এবং তার মত যারা পৃথিবীতে আছে) তারা কথা বলাটা শিখে নিয়েছে, তারা জানে কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে ইম্প্রেশন তৈরী করতে হয় এবং কীভাবে জানার ভান করতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের অর্জন ড্রাইভারের জ্ঞান, ম্যাক্স প্ল্যাংকের জ্ঞান নয়। চার্লি মাঙ্গার এই ধরনের ড্রাইভারি জ্ঞানীদের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন আমি বোধহয় আমেরিকার সব রাজনীতিবিদদের কথা বলে ফেললাম।

আপনি যদি প্ল্যাংকের জ্ঞান অর্জন করেন তাহলে আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে, যেহেতু আপনি তা জানেন। প্রশ্ন আসলে, সমস্যা তৈরী হলে আপনাকে আবার কাজে লাগতে হবে। কিন্তু ড্রাইভারি জ্ঞানীদের সেই দায় নেই।

 

 

তলস্তয় ইফেক্ট

 

চার্লি মাঙ্গারের প্রজ্ঞা নির্ভর বই পুওর চার্লি’জ অলমানাকে আছে এই ঘটনা।

এক ছেলে একবার তার বাপের এমপ্লয়ীর ঝুঁড়ি থেকে দুইটা চকলেট নিয়া বলল, “পরে দুইটা রাইখা দিব।”

বাচ্চা ছেলে, বয়স কম।

তার বাপের নজরে পড়ছিল ঘটনাটা। বাপ ছেলে বললেন, “হে আমার পোলা, তুমি ঐ ঝুঁড়ি থেকে যত ইচ্ছা চকলেট নিতে পারো। কিন্তু প্রত্যেকবার নিবার সময় নিজেরে বলবা, “আমি একটা চোর।”

এই বাপ তার পোলারে দারুণ এক শিক্ষা দিয়েছিলেন। অপরাধ করে অন্য নামে তা জায়েয না করার শিক্ষা। পোলা পরে একটা মিউজিক ইস্কুলের ডীন হন। পঞ্চাশ বছর পরেও তিনি এ শিক্ষা মনে রাখেন এবং তার এক বন্ধুরে বলেন। সেই বন্ধু, চার্লি মাঙ্গার। মাঙ্গার তার লেখায় এই ঘটনার উল্লেখ করেন এবং তিনি তলস্তয় ইফেক্টের কথা বলেন। তলস্তয় ইফেক্ট হচ্ছে অপরাধী অপরাধ করে যখন নানা অজুহাত দেখিয়ে তার সেই কৃত অপরাধের ন্যায্যতা দিতে চায়। চার্লি মাঙ্গার বলেন তলস্তয়ের উপন্যাসে দেখা যায় অপরাধীরা হয় তারা বলে তারা অপরাধটি করেই নি, অথবা তারা বলে তারা যে কঠিন অবস্থায় ছিল তাতে সেই অপরাধ করতে হয়েছে।

অপরাধী’রা এটা করে নিজের অপরাধবোধ থেকে বাঁচতে এবং নিজের কাছে নিজেকে ভালো হিসেবে রাখতে। কিন্তু ভিন্ন নামে অপরাধ করলে, তা কখনোই ন্যায্য বা ঠিক কাজ হয়ে উঠে না। অপরাধীর এটা এক ডিফেন্স মেকানিজম, যেমন ছোট বাচ্চাটি চকলেট সরিয়ে নেবার সময় চুরিকে ভিন্ন নামে ডেকে বুঝাতে চেয়েছিল সে চুরি করছে না। একজন প্রজ্ঞাবান পিতা তার ছিলেন বলে সে ছোটকালেই তার ভুলটা বুঝতে পেরেছিল।

 

বি দ্রঃ ম্যাক্স প্ল্যাংকের গল্পটি ২০০৭ সালে ইউএসসি ল স্কুলে দেয়া চার্লি মাঙ্গারের কমেন্সমেন্ট স্পীচ থেকে নেয়া। এছাড়াও ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে টেলিগ্রাফের ইনভেস্টিং সেক্টরে ম্যাক্স প্ল্যাংকের নাম টাইটেলে রেখেই তা প্রকাশ হয়েছে। গল্পটি আমি আগে আইনস্টাইনের নামে শুনেছি তবে কোন নির্ভরযোগ্য সোর্স পাই নি। ঐ গল্পের উপস্থাপন ছিল কৌতুকের মত, ড্রাইভারের উপস্থিত বুদ্ধি বুঝাতে। এখানে মাঙ্গার যেমন দুই প্রকারের জ্ঞানের পার্থক্য করেছেন এই গল্প দিয়ে, এমন আমি আর কোথাও দেখি নি। যাইহোক, গল্প এখানে বিবেচ্য নয়, গল্পের শিক্ষাটা গুরুত্বপূর্ন। এ ধরনের অনেক গল্প প্রচলিত আছে। ম্যাক্স প্ল্যাংকের জায়গা প্রফেসর খরগোশ আর তার ড্রাইভারের জায়গায় ড্রাইভার কচ্ছপ বসিয়ে পড়লেও কোন ক্ষতি নেই।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং