মুরাদুল ইসলাম » ফিল্ম » রয় এন্ডারসনের সংগস ফ্রম দ্য সেকেন্ড ফ্লোর – একরাশ পরাবাস্তব নৈরাশ্য

রয় এন্ডারসনের সংগস ফ্রম দ্য সেকেন্ড ফ্লোর – একরাশ পরাবাস্তব নৈরাশ্য

একটি ধূষর বিবর্ন শহর। তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মানুষ। কেউ চাকরি হারিয়ে বসের পা জড়িয়ে থাকে, উপেক্ষা করে বস চলে যায়। লোকটা তবুও পা ছাড়ে না। পায়ের সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে এবং দেখা যায় লোকটি বার বার বলে যায় ‘আমি ত্রিশ বছর ধরে কাজ করছি’।

song

একজন যাদুকর যাদু দেখাতে গিয়ে সত্যি সত্যি সত্যি কেটে ফেলে সাহায্যকারী দর্শকের পেট। ধ্বস নামে তার খ্যাতিতে। আর আরেকজন লোক নিজেই নিজের দোকান জ্বালিয়ে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে বুঝায় আগুন লেগে গিয়েছিল। রাস্তা দিয়ে দেখা যায় একদল লোক যাচ্ছে তাজিয়া মিছিলের মত নিজেদের গাত্রে আঘাত করে। দেখা যায় দোকানে আগুন দেয়া লোকটির বড় ছেলে পাগল হয়ে গেছে কবিতা লিখতে গিয়ে। দেখা যায় কর্পোরেশন একটি মেয়েকে স্যাক্রিফাইস (বলি) দিচ্ছে। হয়ত ঈশ্বরের রাগ প্রশমনের জন্য। তারপর তারা বলেঃ

We have already sacrificed our youth. Can we do more?

ছবিটিতে কোন নির্দিষ্ট গল্প নেই। টুকরো টুকরো গল্প। কিন্তু তাদের মধ্যে যেন মিল আছে। আগুন দিয়ে নিজের দোকান পুঁড়ানো লোকটাকে দেখা যায় বার বার। সে তার ছোট ছেলেকে নিয়ে যায় পাগল বড় ছেলেকে দেখতে। বড় ছেলে বসে থাকে নিশ্চুপ। ছোট ছেলে তাকে কবিতা শোনায়। পেরুভিয়ান কবি সিজার ভেলেজোর কবিতাঃ

Beloved be the unknown man and his wife.
My fellow man with sleeves, neck and eyes!
Beloved be the one who sleeps on his back.
The one who wears a torn shoe in the rain.
Beloved be the bald man without hat.
The one who catches a finger in the door.
Beloved be the one who sweats out of pain or out of shame.
The one who pays with what he does not have…
Beloved be the ones who sit down.
Beloved be the one who works by the day, by the month, by the hour.
Beloved be the one who sweats out of pain or out of shame.
The person who goes, at the order of his hands, to the movies.
The one who pays with what he does not have.
The one who sleeps on his back.
The one who no longer remembers his childhood.
Beloved be the one who sits down.
Beloved be the just man without thorns.
The bald man without hat.
The thief without roses.
The one who wears a watch and has seen God.
The one who has honor and does not die!

 

ফিল্মে বিভিন্ন সময়ে ফিরে আসে এই কবিতার লাইন। বলা হয়ে থাকে ফিল্মটি এই কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত।

টুকরো গল্পের মধ্যেও যদি একটা মূল গল্প খোঁজা হয় তাহলে বলা যায় আগুন দিয়ে ফার্নিচারের দোকান জ্বালানো লোকটির গল্পই প্রধান। তার কবিতা লিখতে গিয়ে পাগল হওয়া ছেলে এবং ছোট ছেলে নিঃসঙ্গ ক্যাব ড্রাইভার। লোকটি এক পর্যায়ে ক্রুশ বিক্রির ব্যবসায় নামে এবং অদ্ভুতভাবে দেখতে থাকে মৃত মানুষদের। মৃত মানুষেরা তার সাথে কথা বলে।

কবিতা লিখতে গিয়ে পাগল হয়ে যাওয়া ছেলেটিকে দেখে আমার মনে হয়েছে ইউরোপিয়ান প্রথম রোমান্টিক কবি বলে খ্যাত থমাস চ্যাটারটনের কথা। মনে হয় এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার না যে ফিল্মেও কবি ছেলেটির নাম থমাস। যদিও এই বিষয়টা কেউ রিভিউতে বা আলোচনায় উল্লেখ করেছেন বলে দেখি নি।

চ্যাটারটনের মৃত্যু নিয়ে হেনরি ওয়ালিসের আঁকা ছবি।
চ্যাটারটনের মৃত্যু নিয়ে হেনরি ওয়ালিসের আঁকা ছবি।

ইউরোপে রোমান্টিসিজম আন্দোলনের সূত্রপাত আঠার শতকে। সেখানে চ্যাটারটনের প্রভাব ছিল। থমাস চ্যাটারটন মাত্র সতের বছর আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আত্মহত্যা করেছিল। ফিল্মের থমাসকে আমার মনে হয়েছে সে সাধারণ কর্পোরেট জীবন যাপন থেকে বিদ্রোহী একজন রোমান্টিক, যে এই জীবন যাপনে অস্বীকৃতি জানিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করে। এবং এর পরিণতি হিসেবে সে পাগল হয়ে যায়। ফিল্মে অন্য পাগলদের কথোপকথনে দেখা যায় তাকে জিসাস ক্রাইস্টের সাথে তুলনা করছে তারা।

কোন কোন ডায়লগে মনে হতে পারে ফিল্মটি এন্টি-ক্রিস্টিয়ানিটির ফিল্ম। আমার মনে হয় সেটা ফিল্মের কোন মূখ্য উদ্দেশ্য না। একজায়গায়, জিসাসের ক্রুশ বিক্রিকে অলাভজনক ব্যবসা বলে এক ব্যবসায়ীকে সব ক্রুশ আবর্জনায় ফেলে দিতে দেখা যায়। এটা হতে পারে ইউরোপীয়ান আধুনিক সমাজের ল্যাক অব ফেইথকে নির্দেশ করে।

ফিল্মটি মানুষের জীবনের নৈরাশ্য, হতাশা এবং অর্থহীনতাকে ইঙ্গিত করলেও সরাসরি কোন মেসেজ না দিয়ে মানুষের জীবনধারাকে পরিহাস করে যায়। এক ধরনের ডার্ক স্যাটায়ার বলা যায় একে। সমস্ত ছবিই রূপকে পূর্ণ যেগুলোর অর্থ বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তবে মূল লাইনটা হল এবসার্ড এবং হতাশাময়। হতাশাময় হলেও এর নির্মানে অভিনবতা এবং স্যাটায়ারিক টোন আছে। তাই দেখার পর দর্শকের হতাশ লাগার কথা না। এর বিভিন্ন দৃশ্যে নিয়ে দীর্ঘ চিন্তার মত উপাদান বিদ্যমান। মানুষের মৌলিক কিছু দার্শনিক সমস্যাকে ছুঁয়ে গেছে সাবধানে।

মানুষের হতাশা, দুঃখবোধ এবং জীবনের অর্থহীনতার দেখাতে গিয়ে সুইডিশ চিত্র পরিচালক রয় এন্ডারসন টুকরো টুকরো পরাবাস্তব চিত্র এঁকেছেন। তার এই ফিল্মকে সুরিরিয়ালিস্টিক (পরাবাস্তব), এবসার্ডিস্ট ইত্যাদি বলা যায়। কিন্তু তিনি  এটাকে বলেছেন ট্রিভিয়ালিজম।

তার কথায়ঃ

মানুষ ভাবে আমার ছবিকে কোন শ্রেণীতে ফেলবে। এবসার্ডিজম না সুররিয়ালিজম? আর আসলে এই বস্তুটা কী? …এই ছবি যে স্টাইলের সাথে পরিচিত করায় আমি তাকে বলব ট্রিভিয়ালিজম। জীবন বিভিন্ন ট্রিভিয়াল কমপোনেন্ট আকারে চিত্রায়িত হয়েছে। আমার উদ্দেশ্য আরো বড় কিছু, আরো দার্শনিক বিষয়াবলীকে স্পর্শ করা একই সাথে।

  • রয় এন্ডারসন

 

ট্রিভিয়ালিজম কী?

ট্রিভিয়ালিজম হচ্ছে লজিকের একটা থিওরী যা বলে সব কিছুই সত্য। সব দ্বন্দ্বই (বলটি লাল কিংবা লাল নয়) সত্য। এঁকে দার্শনিকভাবে বলা যায় স্কেপটিসিজম এর বিপরীত।

 

songs-poster-movie-1413687673
পোস্টার।

 

এই ফিল্মটি আমার অত্যধিক ভালো লেগেছে।  আমি এটাকে শ্রেষ্ট ফিল্মের কাতারে ফেলতে চাই।

1 thought on “রয় এন্ডারসনের সংগস ফ্রম দ্য সেকেন্ড ফ্লোর – একরাশ পরাবাস্তব নৈরাশ্য”

  1. Pingback: দ্য ম্যান উইদাউট এ পাস্ট – অতীতহীন লোকটি | @ মুরাদুল ইসলামের ব্লগ

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং