মুরাদুল ইসলাম » অনুবাদ » দ্য লিটল প্রিন্স – সম্পূর্ন উপন্যাস বাংলা অনুবাদ

দ্য লিটল প্রিন্স – সম্পূর্ন উপন্যাস বাংলা অনুবাদ

অধ্যায় এক থেকে পাঁচ – লিংক।

অধ্যায় ছয় থেকে দশ – লিংক।

 

অধ্যায় – এগারো

ছোট রাজপুত্র অহংকারী লোকটিকে দেখতে গেল।

 

দ্বিতীয় গ্রহতে বাস করত একজন অহংকারী লোক।

“আরে! একজন ভক্ত দেখছি আমাকে দেখতে এসেছে –“ সে ছোট রাজপুত্রকে দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠল।

অহংকারী লোকটির কাছে সব মানুষই তার ভক্ত বা প্রশংসাকারী।

“শুভ সকাল। আপনি বেশ অদ্ভুত হ্যাট পড়ে আছেন।” ছোট রাজপুত্র বলল।

“এটা স্যালুট হ্যাট। যখন মানুষ আমার নামে জয়ধ্বনি করে তখন এটি স্যালুট দিতে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু আফসোস কেউ কখনো এদিক দিয়ে যায় না।”

“তাই?” বলল ছোট রাজপুত্র। অহংকারী লোকটি আসলে কী নিয়ে বলছিল তা ছোট রাজপুত্র ঠিকমত বুঝতে পারছিল না।

“হাততালি দাও।” অহংকারী লোকটি এবার আদেশের সুরে বলল।

ছোট রাজপুত্র হাততালি দিল। অহংকারী লোকটি বিনয়ী স্যালুটে তার হ্যাট তুলল।

“এটি রাজা’র থেকে বেশি উপভোগ্য।” ছোট রাজপুত্র বলল নিজেকে। সে আবার হাততালি দিতে শুরু করল। অহংকারী লোকটি আবার হ্যাট তুলে স্যালুট দিল।

পাঁচ মিনিট এইরকম চলার পরে ছোট রাজপুত্র একঘেয়েমিতায় ক্লান্ত হয়ে পড়ল।

“তাহলে হ্যাটকে আবার নিচে ফিরিয়ে আনতে কী করতে হবে?” সে জিজ্ঞেস করল।

কিন্তু অহংকারী লোকটি তার কথা শুনল না। অহংকারী লোকেরা কখনো প্রশংসা ছাড়া কোন কথা শুনে না।

“তুমি কি সত্যি আমাকে দেখে মুগ্ধভাবে প্রসংশা করছ?” সে ছোট রাজপুত্রকে কে জিজ্ঞেস করল।

ছোট রাজপুত্র বলল, “মুগ্ধভাবে প্রশংসা কী জিনিস?”

“মুগ্ধভাবে প্রশংসা বলতে বুঝায় তুমি স্বীকৃতি দিচ্ছো যে আমি সবচেয়ে সুদর্শন, সবচেয়ে সুসজ্জিত পোশাকে, আমি সবচেয়ে বুদ্ধিমান, এবং এই গ্রহের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি।”

“কিন্তু তোমার গ্রহে তুমিই তো একমাত্র মানুষ!”

“আমাকে দয়া করো। মুগ্ধভাবে আমার প্রশংসা করো।”

ছোট রাজপুত্র কাঁধ সামান্য ঝাঁকিয়ে বলল, “আমি তোমার প্রশংসা করছি। কিন্তু এতে কী এমন আছে যা তোমাকে এত আকৃষ্ট করে?”

তারপর ছোট রাজপুত্র চলে গেল।

সে তার ভ্রমন চালিয়ে যেতে যেতে নিজে নিজেই বলল, “বড়রা অবশ্যই খুব অদ্ভুত।”

 

অধ্যায় – বারো

ছোট রাজপুত্র মাতালের সাথে দেখা করল।

 

তারপরের গ্রহে বাস করত একজন মাতাল। এটি ছিল খুব ছোট একটি স্বাক্ষাৎ, কিন্তু তা ছোট রাজপুত্রকে গভীর বিষন্নতায় নিমগ্ন করে ফেলল।

“তুমি এখানে কী করছ?” সে মাতালকে জিজ্ঞেস করল। মাতালটি নিরবে বসে ছিল কিছু খালি মদের বোতল এবং অনেক পূর্ন বোতল সামনে নিয়ে।

“আমি মদ পান করছি,” মাতালটি বিষাদমাখা কন্ঠে উত্তর দিল।

“কেন তুমি মদ্যপান করছ?” জানতে চাইল ছোট রাজপুত্র।

মাতার উত্তর দিল, “যাতে আমি ভুলে থাকতে পারি।”

ছোট রাজপুত্র মাতাল লোকটির জন্য দুঃখবোধ করছিল। সে জিজ্ঞেস করল, “কী ভুলে থাকতে?”

মাতালটি মাথা দুলিয়ে বলল, “ভুলে থাকতে যে আমি লজ্জিত ছিলাম।”

ছোট রাজপুত্র চাইছিল লোকটিকে সাহায্য করতে। সে আবার জিজ্ঞেস করল, “কী জন্য লজ্জিত?”

“মদ পানের জন্য লজ্জিত…” বলে মাতালটি কথা বলা বন্ধ করল এবং নিজেকে দুর্ভেদ্য নিরবতার মধ্যে নিমগ্ন করে ফেলল।

ছোট রাজপুত্র ঠিকমত বুঝতে না পেরে এক ধরনের ধাঁধার ভেতর থাকতে থাকতই সেখান থেকে চলে গেল।

সে তার ভ্রমন চালিয়ে নিতে নিতে নিজে নিজেই বলল, “বড়রা আসলে খুব, খুব অদ্ভুত!”

 

অধ্যায় – তেরো

ছোট রাজপুত্র ব্যবসায়ীর সাথে দেখা করল।

 

চতুর্থ গ্রহটির মালিক ছিল একজন ব্যবসায়ী। সে এতই ব্যস্ত ছিল যে ছোট রাজপুত্র পৌছানোর পর মাথা তুলেও দেখল না।

ছোট রাজপুত্র বলল, “শুভ সকাল। আপনার সিগারেট নিভে গেছে।”

“তিন আর দুইয়ে পাঁচ। পাঁচ আর সাথে বারো। বারো আর তিনে পনের। পনের আর সাতে বাইশ। বাইশ আর ছয়ে আটাশ। আমার নতুন করে জ্বালানোর সময় নেই। ছাব্বিশ আর পাঁচে একত্রিশ। দারুণ! তারপর এতে হয় পাঁচশত এক মিলিয়ন, ছয়শত বাইশ হাজার, সাতশত একত্রিশ।”

ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল, “কী পাঁচশত মিলিয়ন?”

“এহ! তুমি এখনো এখানে? পাঁচশত এক মিলিয়ন – আমি থামতে পারবো না- অনেক কাজ বাকী। আমি অতি গুরুত্বপূর্ন কাজে ব্যস্ত। বাজে বকার সময় আমার নেই। দুই আর পাঁচ মিলে সাত……”

ছোট রাজপুত্র কোন প্রশ্ন করলে উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত থামে না। সে আবার জিজ্ঞেস করল, “পাঁচশত এক মিলিয়ন কী?”

ব্যবসায়ী লোকটি তার মাথা তুলে তাকাল।

সে বলা শুরু করল, “এই গ্রহে আমি চুয়ান্ন বছর ধরে আছি। এর মাঝে এ পর্যন্ত তিনবার মাত্র বিরক্ত হয়েছি কাজে। প্রথমবার, বাইশ বছর আগে কোত্থেকে যেন একটা হাঁস এসে পড়ল। ভয়ংকর শব্দে মুখরিত করে তুলল এবং সে শব্দগুলো অনুরণিত হচ্ছিল চারপাশে। আমি তখন আমার যোগে চারটা ভুল করেছিলাম। দ্বিতীয়বার, এগারো বছর আগে আমি পেশির ব্যথায় আক্রান্ত হলাম। তখন কাজে ব্যঘাত ঘটল। আমি ব্যায়াম করি না। অযথা নষ্ট করার মত সময় আমার নেই। এবং তৃতীয়বারটা হচ্ছে এখন। তো আমি যা বলছিলাম, পাঁচশত এক মিলিয়ন…

“কী পাঁচশত এক মিলিয়ন?”

ব্যবসায়ী লোকটি তখন বুঝতে পারল উত্তর না দেয়া পর্যন্ত তার শান্তিতে থাকার কোন উপায় নেই।

সে উত্তর দিল, “ওই সমস্ত ছোট বস্তুগুলো। যেগুলো আকাশে মাঝে মাঝে দেখা যায়।”

“মাছি?”

“না। ওই চকচকে বস্তুগুলো।”

“মৌমাছি?”

“অহ! না। ঐ ছোট চকচকে সোনালী বস্তুগুলো। যা দেখে অলস ব্যক্তিরা স্বপ্ন দেখে। আমার স্বপ্ন দেখার সময় নেই। আমি অতি গুরুত্বপূর্ন কাজে ব্যস্ত।”

“আপনি কি তারাদের কথা বলছেন?”

“হ্যা। ঠিক তাই। তারা।”

“আপনি এই পাঁচশত মিলিয়ন তারাদের দিয়ে কী করবেন?”

“পাঁচশত এক মিলিয়ন, ছয়শত বাইশ হাজার, সাতশত একত্রিশ। আমি গুরুত্বপূর্ন কাজের ব্যাপারে সতর্ক।  আমার সংখ্যাটা সঠিক।”

“আচ্ছা, আপনি এই তারাদের দিয়ে কী করবেন?”

“আমি এগুলো দিয়ে কী করব?”

“হ্যা।”

“কিছু করব না। এগুলো আমার।”

“আপনি তারাদের মালিক?”

“হ্যা।”

“কিন্তু আমি একজন রাজা দেখেছি যিনি……”

“রাজারা কোন কিছুর মালিক হয় না। তারা শুধুমাত্র শাসন করে। এগুলো খুব জটিল বিষয়।”

“তারাদের মালিক হয়ে আপনার লাভটা কী হয়?”

“এটি আমাকে ধনী হতে সাহায্য করে।”

“ধনী হলে কী হয়?”

“এটি আমার জন্য নতুন কোন তারা আবিষ্কৃত হলে তা কেনা সম্ভব করে তোলে।”

ছোট রাজপুত্র নিজের মনেই বলল, “এই লোক কিছুটা সেই দূর্ভাগা মাতালটার মত।”

কিন্তু তবুও তার কিছু প্রশ্ন বাকী রয়েছিল।

সে জিজ্ঞেস করল, “একজন কীভাবে তারাদের মালিক হতে পারে?”

“তারাগুলো কার?” ব্যবসায়ী লোকটি রাগান্বিত হয়ে প্রশ্ন করে বসল।

“আমি জানি না। কারো নয়।”

“তাহলে এগুলো আমার। কারণ সর্বপ্রথম আমিই এগুলো নিয়ে চিন্তা করেছি।”

“শুধু এই কারণেই?”

“অবশ্যই। যখন তুমি কোন হীরার টুকরা পাবে যার মালিক কেউ না, এটা হয়ে যাবে তোমার। যখন তুমি কোন দ্বীপ আবিষ্কার করবে যার মালিক কেউ না এটা হয়ে যাবে তোমার। যখন তুমি কোন আইডিয়া পাবে যা আগে কেউ ভাবে নি, এটা তুমি প্যাটেন্ট করবে এবং তা হয়ে যাবে তোমার। তাই আমার ক্ষেত্রেও, তারাগুলো আমার, কারণ আমার আগে কেউ তারাগুলোকে নিজের করে নেয়ার চিন্তা করে নি।”

“হ্যা। তা ঠিক। কিন্তু আপনি এগুলি দিয়ে কী করবেন?

“আমি তাদের তদারকি করি। আমি তাদের গুনি এবং বার বার গুনি। এটা কঠিন কাজ। কিন্তু আমি এমন মানুষ গুরুত্বপূর্ন কাজে প্রাকৃতিকভাবেই আগ্রহী।”

ছোট রাজপুত্র তখনো উত্তরে সন্তুষ্ট ছিল না।

“যদি আমার কোন স্কার্ফ থাকে আমি সেটা গলায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি। আমার যদি কোন ফুল থাকে সেটা আমি ছিঁড়ে সাথে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আপনি তো আকাশ থেকে তারাগুলিকে ছিঁড়ে আনতে পারবেন না…”

“না। কিন্তু আমি তাদের ব্যাংকে জমা রাখতে পারি।”

“এর মানে কী?”

“এর অর্থ হল আমি একটি কাগজে আমার তারাদের সংখ্যা লিখে তারা ড্রয়ারে তালাবদ্ধ করে রাখি।”

“শুধু এই?”

ব্যবসায়ী উত্তর দিল, “এটাই যথেষ্ট।”

ছোট রাজপুত্র ভাবল, “এটা উপভোগ্য। কিছুটা কাব্যিক। কিন্তু এর তো কোন গুরুত্ব নেই।”

আসলে মুল ব্যাপার হল, ছোট রাজপুত্রের চিন্তাগুলি বড়দের চেয়ে ভিন্ন ছিল।

ছোট রাজপুত্র ব্যবসায়ীর সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে থাকল, “আমার একটি ফুল আছে। আমি তাতে প্রতিদিন পানি দেই। আমার তিনটি আগ্নেয়গিরি আছে। আমি প্রতি সপ্তাহে এগুলি পরিস্কার করি। (আমি মৃত আগ্নেয়গিরিটাও পরিস্কার করি। কারণ কী ঘটবে কিছুই বলা যায় না।) এগুলি হচ্ছে আমার আগ্নেয়গিরি এবং ফুলের ব্যবহার। কিন্তু আপনার তারাদের ত কোন ব্যবহার নেই…”

ব্যবসায়ী লোকটি কিছু বলতে মুখ খুলল কিন্তু বলার মত কিছুই খুঁজে পেল না।

এবং ছোট রাজপুত্র চলে গেল।

সে তার ভ্রমনে চলতে চলতে নিজেকেই বল, “বড়রা আসলে অস্বাভাবিকও।”

 

অধ্যায় – চৌদ্ধ

ছোট রাজপুত্র দীপপ্রজ্বলক লোকটির সাথে দেখা করল।

 

পঞ্চম গ্রহটা ছিল অদ্ভুত। গ্রহগুলির মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে ছোট। তাতে একটা রাস্তার বাতি এবং একজন দীপপ্রজ্বলকের থাকার মত জায়গা ছিল। দীপপ্রজ্বলক হল যে বাতি জ্বালানো-নিভানোর দায়িত্বে ছিল সে। ছোট রাজপুত্র চিন্তা করে কোন ব্যাখায় যেতে পারল না এখানে মহাকাশের কোন একটি অংশে, কোন একটি গ্রহে যেখানে কোন মানুষ নেই, কোন বাড়ি নেই, সেখানে বাতি এবং সেই বাতি জ্বালানোর লোকের কী দরকার।

কিন্তু তবুও সে নিজেকে বলল, এটা মনে হতে পারে অযৌক্তিক এবং হাস্যকর। কিন্তু এই লোকটি সেই রাজা,অহংকারী লোক, মাতাল এবং ব্যবসায়ীর মত হাস্যকর না। কারণ তার কাজের সামান্য হলেও কিছু অর্থ আছে। যখন সে বাতি জ্বালায় তখন যেন সে নতুন একটি তারা বা ফুলকে জীবিত করল। যখন সে বাতিটি নিভিয়ে ফেলে তখন যেন সে তারা বা ফুলকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তাই এটি একটি সুন্দর পেশা। এবং সুন্দর বলেই তা সত্যি কাজের।

যখন সে গ্রহে পৌছল, সম্মানের সাথে দীপপ্রজ্বলককে স্যালুট দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“শুভ সকাল। আপনি কেন আপনার বাতিটাকে নিভিয়ে ফেললেন?”

“কারণ ওগুলো  নিয়ম।। শুভ সকাল।” দীপ প্রজ্বলক উত্তর দিল।

“কী নিয়ম?”

“এই যেমন আমি বাতিটা নিভিয়ে ফেললাম। শুভ সন্ধ্যা।”

এবং সে আবার বাতি জ্বালাল।

“কিন্তু তাহলে তুমি আবার কেন বাতি জ্বালালে এখন?”

“ওগুলো নিয়ম।” উত্তর দিল দীপ প্রজ্বলক।

ছোট রাজপুত্র বলল, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

“এখানে বুঝার কিছু নেই। নিয়ম তো নিয়মই। শুভ সকাল।”

সে আবার বাতি নিভিয়ে ফেলল।

সে লাল লাল বর্গাকার ডিজাইনে সাজানো একটি রুমাল দিয়ে তার কপাল মুছল।

“আমি একটি ভয়ংকর পেশায় আছি। আগে যাও ব্যাপারটি যুক্তিযুক্ত ছিল। আমি সন্ধ্যায় বাতি জ্বালাতাম আর সকালে নিভাতাম। আমি বিশ্রামের জন্য পুরো দিন এবং ঘুমানোর জন্য পুরো রাত পেতাম।”

“কিন্তু এরপর নিয়মগুলি কি বদলে গেছে?”

দীপপ্রজ্বলক উত্তর দিল, “না। নিয়মের কোন পরিবর্তন হয় নি। আসলে এটা একটা দূর্ভাগ্য! বছরের আবর্তনে এখন গ্রহে দ্রুত সময় যাচ্ছে। কিন্তু নিয়মের কোন পরিবর্তন হয় নি।”

“তাহলে কী?” ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল।

“তাহলে- এখন গ্রহ প্রতি মিনিটে একবার আবর্তন করছে। তাই আমার এক সেকেন্ড অবকাশ নেই। প্রতি মিনিটে আমাকে বাতি জ্বালাতে নেভাতে হয়।”

“এটা খুব মজার! এখানে দিন মাত্র এক মিনিটের।”

“এটা মোটেও মজার কিছু না। এই যে আমরা কথা বলছি এর মাঝে একমাস চলে গেছে।” বলল দীপ প্রজ্বলক।

“একমাস?”

“হ্যা, একমাস। ত্রিশ মিনিট, ত্রিশ দিন। শুভ সন্ধ্যা।”

সে আবার বাতি জ্বালাল।

ছোট রাজপুত্র তাকে দেখছিল এবং তার মনে হচ্ছিল নিয়মের প্রতি অতি বিশ্বস্ত এই বাতিজ্বালক লোকটাকে সে পছন্দ করে।  তার ফেলে আসা দিনের সেইসব সূর্যাস্তের কথা মনে হল, যখন সে চেয়ার ঘুরিয়েই সূর্যাস্ত দেখতে পারত। সে তার এই বন্ধুকে সাহায্য করতে চাইল।

ছোট রাজপুত্র বলল, “আমি তোমাকে একটা উপায়ের কথা বলতে পারি যাতে যখন ইচ্ছা তুমি বিশ্রাম নিতে পারো।”

“আমি সব সময় বিশ্রাম নিতে চাই,” উত্তর দিল বাতিজ্বালক।

একজন মানুষের পক্ষে একই সাথে বিশ্বস্ত এবং অলস হওয়া সম্ভব।

ছোট রাজপুত্র ব্যাখ্যা করতে শুরু করল কীভাবে সে বিশ্রাম নিতে পারে তা,

“তোমার গ্রহ খুব ছোট। মাত্র তিন পা হেটেই তুমি পুরোটা ভ্রমণ করতে পারবে। সবসময় সূর্যালোকে থাকতে হলে তোমাকে ধীরে হাটতে হবে। যখন তুমি বিশ্রাম নিতে চাইবে তখন হাটবে।– তাহলে তুমি যতক্ষণ চাও ততক্ষণই দিন থাকবে।”

বাতিজ্বালক উত্তরে বলল, “এটা আমাকে বিশেষ সাহায্য করতে পারবে না। আমি জীবনে একটা জিনিসই ভালোবাসি এবং তা হচ্ছে ঘুম।”

“তাহলে তুমি দূর্ভাগ্যবান,” ছোট রাজপুত্র বলল।

উত্তরে বাতিজ্বালক বলল, “আসলেই আমি দূর্ভাগা। শুভ সকাল।”

সে বাতি নিভিয়ে ফেলল।

ছোট রাজপুত্র তার ভ্রমণ চালিয়ে যেতে যেতে নিজেকে বলল, “এই লোকটি আসলে সেই রাজা, অহংকারী, মাতাল এবং ব্যবসায়ীর অপব্যবহারের স্বীকার হবে। যাইহোক, তাকে আমার ওদের মত হাস্যকর মনে হয় নি। সম্ভবত এই কারণে যে সে শুধু নিজের কথাটাই ভাবছে না।”

সে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং বলল, “এদের মধ্যে এই লোকটিই একমাত্র যাকে আমি বন্ধু বানাতে পারি। কিন্তু তার গ্রহটি আসলেই খুব ছোট। এখানে দুজনের জায়গা হবে না…”

যা ছোট রাজপুত্র স্বীকার করতে সাহস করে নি তা হল গ্রহটি ছাড়তে তার খুব খারাপ লাগছিল -এর প্রধান কারণ এটি দিনে ১৪৪০ বার সূর্যাস্তে ধন্য হয়।

 

অধ্যায় -পনের

ছোট রাজপুত্র ভূগোলবিদের সাথে দেখা করল।

ষষ্ট গ্রহটা তার আগেরটা থেকে প্রায় দশগুণ বড় ছিল। সেখানে থাকতেন একজন ভদ্রলোক যিনি বড় বড় বই লিখতেন।

ছোট রাজপুত্রকে আসতে দেখে তিনি বলে উঠলেন, “আরে! এই তো একজন অনুসন্ধানকারী!”

ছোট রাজপুত্র টেবিলে বসল এবং ছোট ছোট কিছু নিঃশ্বাস ফেলল। সে ইতিমধ্যেই অনেক জায়গা ভ্রমণ করে ফেলেছে!

ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কোথা থেকে এসেছ?”

“এই বড় বইটা কী? আপনি কী করছেন?” ছোট রাজপুত্র পালটা প্রশ্ন করল।

ভদ্রলোক উত্তরে বললেন, “আমি একজন ভূগোলবিদ।”

ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল, “ভূগোলবিদ কী?”

ভূগোলবিদ হচ্ছেন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি যিনি পাহাড়, নদী, সাগর, শহর, মরুভূমি ইত্যাদির অবস্থান জানেন।

এটা খুব ভাল। এখানে শেষ পর্যন্ত একজন লোক পাওয়া গেল যার সত্যিকারের কোন পেশা আছে। ছোট রাজপুত্র ভূগোলবিদের গ্রহের আশপাশে তাকিয়ে দেখল। এটি ছিল তার দেখা সবচেয়ে অসাধারণ এবং মহিমান্বিত গ্রহ।

ছোট রাজপুত্র বলল, “আপনার গ্রহটি অনেক সুন্দর। এতে কোন সমুদ্র আছে?”

ভূগোলবিদ উত্তর দিলেন, “আমি বলতে পারবো না।”

“অহ! তাহলে কি কোন পাহাড় আছে?”

ভূগোলবিদ উত্তর দিলেন, “আমি বলতে পারবো না।”

“তাহলে কোন শহর, নদী, অথবা মরুভূমি?”

“আমি এগুলোও বলতে পারবো না।”

“কিন্তু আপনি তো একজন ভূগোলবিদ!”

ভূগোলবিদ উত্তরে বললেন, “ঠিক বলেছ। আমি একজন অনুসন্ধানকারী না। আমার গ্রহে একজনও অনুসন্ধানকারী নেই। এটা ভূগোলবিদের কাজ না গিয়ে নদী, পাহাড়, সমুদ্র, মরুভূমি গোনে দেখা। ভূগোলবিদ এর চেয়ে বরং আলস্যে বসে থাকবেন। তিনি কখনো তার ডেস্ক ছেড়ে যান না। কিন্তু তিনি তার এই অধ্যয়নে অনুসন্ধানকারীর সাহায্য নেন।  তিনি তাদের প্রশ্ন করেন। তারা তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে যা উত্তর দেয় তিনি তা লিখে রাখেন। এবং যদি কোন অনুসন্ধানকারী বর্নিত কোন ঘটনা কৌতুহল উদ্দীপক হয় তাহলে তিনি ঐ অনুসন্ধানকারীর নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে তদন্তের আদেশ দেন।”

“এটা কেন?”

“কারণ একজন অনুসন্ধানকারী যে মিথ্যা কথা বলে সে ভূগোলবিদের বইয়ে ভয়াবহ বিপর্জয় ডেকে আনতে পারে। ঠিক তেমনি একজন মদ্যপ অনুসন্ধানকারীও পারে।”

“কিন্তু এটা কেন হয়?” ছোট রাজপুত্র প্রশ্ন করল।

“কারণ নেশাগ্রস্ত লোক এক জিনিসের জায়গায় দুইটা জিনিস দেখে। এক্ষেত্রে দেখা যাবে ওর কথা শোনে ভূগোলবিদ একটা পাহাড়ের জায়গায় দুইটা লিখে বসে আছেন।”

ছোট রাজপুত্র বলল, “আমি এরকম একজনকে চিনি। যে আপনার খারাপ অনুসন্ধানকারী হতে পারে।”

“হ্যা। এটা খুব সম্ভব। অনুসন্ধানকারীর নৈতিক চরিত্রের তদন্তের পর তার আবিষ্কার নিয়ে আরেকটি তদন্তের আদেশ দিতে হয়।”

“কেউ কি গিয়ে ঐ আবিষ্কার দেখে আসে?”

“না। সেটা খুব জটিল হয়ে পড়ে। এজন্য আবিষ্কারের প্রমাণ আনলেই চলে। যেমন কেউ যদি কোন বড় পাহাড়ের কথা বলে তাহলে তার সেই পাহাড়ের একটা বড় পাথর আনলেই হবে।”

ভূগোলবিদ হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “কিন্তু তুমি অনেক দূর থেকে এসেছ। তুমি একজন অনুসন্ধানকারী। তুমি আমাকে তোমার গ্রহ সম্পর্কে বলতে পারো।”

ভূগোলবিদ তার বড় রেজিস্টার খাতা বের করে পেনসিলে ধার দিতে শুরু করলেন। প্রথমে অনুসন্ধানকারীদের বর্ননা পেনসিলে লেখা হয়। তারপর প্রমাণের অপেক্ষা করা হয়। ঠিকঠাক মত প্রমাণ অনুসন্ধানকারী হাজির করতে পারলে তবেই তা কলমের সাহায্যে লেখা হয়।

আশাব্যঞ্জক দৃষ্টিতে ছোট রাজপুত্রের দিকে তাকিয়ে ভূগোলবিদ বললেন, “বলো।”

ছোট রাজপুত্র বলা শুরু করল, “আসলে যেখানে আমি থাকতাম ওটা বেশ সুন্দর গ্রহ না। এটা খুব ছোট ছিল। আমার তিনটা আগ্নেয়গিরি ছিল। দুইটা সক্রিয় এবং একটা মৃত। মৃত হলেও সামনে কী ঘটবে তা তো কেউ জানে না।”

ভূগোলবিদও বললেন, “সামনে কী ঘটবে তা কেউ জানে না।”

“আমার একটি ফুলও আছে।”

“আমরা ফুল রেকর্ড করি না,” ভূগোলবিদ উত্তর দিলেন।

“এটা কেন? আমার গ্রহের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস ছিল ঐ ফুলটি!”

ভূগোলবিদ উত্তর দিলেন, “আমরা ওগুলো রেকর্ড করি না। এগুলো হচ্ছে ক্ষণজন্মা।”

“ক্ষণজন্মা – মানে কী?”

ভূগোলবিদ উত্তরে বললেন, “ভূগোল হচ্ছে, এমন কিছু বই যাতে আমরা শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ন জিনিসগুলো লিখে রাখি। যেগুলো কখনো পুরনো হয় না। একটা পাহাড় সাধারনত তার জায়গা পরিবর্তন করে না, একটা সমুদ্র পানিশূন্য হয়ে পড়ে না। আমরা শাশ্বত জিনিসগুলো নিয়েই লিখি।”

ছোট রাজপুত্র বাধা দিয়ে বলল, “কিন্তু মৃত আগ্নেয়গিরি সক্রিয় হতে পারে! আর ক্ষণজন্মা মানে কী?”

ভূগোলবিদ বললেন, “আগ্নেয়গিরি জীবিত বা মৃত হোক, দুটোই আমাদের কাছে সমান। আমাদের কাছে মুল ব্যাপার পাহাড়। এটি পরিবর্তিত হয় না।”

ছোট রাজপুত্র যে তার জীবনে কোন প্রশ্ন করে উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত থামে নি, পুনরায় প্রশ্ন করল, “কিন্তু ক্ষণজন্মা মানে কী?”

“এর অর্থ যা দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাবার বিপদের মধ্যে আছে।”

“আমার ফুল কি দ্রুত অদৃশ্য হবার বিপদের মধ্যে আছে?”

“অবশ্যই।”

“আমার ফুল ক্ষণজন্মা।” ছোট রাজপুত্র নিজে নিজে বলল। “তার মাত্র চারটি কাঁটা আছে নিজেকে রক্ষা করতে। এবং আমি তাকে একা গ্রহে ফেলে এলাম!”

এই প্রথম সময় ছোট রাজপুত্রের অনুশোচনা হল। কিন্তু সে সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি আমাকে কোন জায়গা ভ্রমণ করার জন্য উপদেশ দিতে চান এখন?”

ভূগোলবিদ উত্তর দিলেন, “পৃথিবী নামক গ্রহে যাও। এর বেশ সুনাম আছে।”

এবং ছোট রাজপুত্র তার ফুলের কথা ভাবতে ভাবতে চলে গেল।

 

অধ্যায় – ষোল

কথক পৃথিবীর দীপ প্রজ্বলকদের সম্পর্কে বললেন

 

সুতরাং, সাত নম্বর গ্রহটি ছিল পৃথিবী।

পৃথিবী একটি সাধারণ গ্রহ না। এখানে গুনলে প্রায় ১১১ জন্য রাজা (নিগ্রো রাজাদের কথা ভুলে যাওয়া হয় নি, তাদেরও ধরা হয়েছে), ৭০০০ জন ভূগোলবিদ, ৯০০,০০০ জন ব্যবসায়ী, ৭,৫০০,০০০ জন মাতাল, ৩১১,০০০,০০০ জন অহংকারী মানুষ – মোটকথা ২ ০০০ ০০০ ০০০ জন বড় মানুষ।

পৃথিবীর আকার সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে আমি তোমাকে বলতে পারি বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পূর্বে  এখানে ছয়টি মহাদেশে প্রায় ৪৬২,৫১১ জন দীপ প্রজ্বলকের বিশাল বাহিনী লাগত রাস্তার বাতিগুলি জ্বালাতে।

দূর থেকে দেখলে যাদের মনে হবে কোন জমকালো প্রদর্শনী। অপেরার নাচের দলের মত এদের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রিত। প্রথমে নিউজিল্যান্ড এবং অষ্ট্রেলিয়ার দিপ প্রজ্বলকেরা তাদের বাতি জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। তারপর চীন এবং সাইবেরিয়ার বাতি প্রজ্বলকেরা। তারপর রাশিয়া এবং ইন্ডিজের বাতিজ্বালকেরা, তারপর আফ্রিকা এবং ইউরোপের বাতিজ্বালকেরা, তারপর দক্ষিণ আমেরিকা, এবং তারপর উত্তর আমেরিকা। এভাবে এবং তারা কখনো তাদের এই নিয়ম ভঙ্গ করতে পারবে না। তাহলেই এটা হবে চমৎকার।

শুধুমাত্র উত্তর মেরুর মাত্র একটি বাতি জ্বালানোর দায়িত্বে যে আছে সে এবং দক্ষিণ মেরুর একটি বাতির দায়িত্বে থাকা তার সহকর্মী – এই দু’জন শুধুমাত্র পরিশ্রম থেকে বেঁচে যাবে। তাদের বছরের মাত্র দুটি সময়ে ব্যস্ত থাকতে হবে।

 

 

অধ্যায় – সতের

ছোট রাজপুত্র সাপের সাথে পরিচিত হল।

 

যখন কেউ রসিকতা করে তখন এর মাঝে কিছু কিছু সত্য থাকতে পারে।  আমি বাতিজ্বালক বা দীপপ্রজ্বলক সম্পর্কে যা তোমাকে বলেছি হয়ত তা পুরোপুরি সত্য না। আমি জানি এতে যারা আমার গ্রহ চেনে না তারা ভুল ধারনা পেতে পারে।  মানুষেরা পৃথিবীতে খুব ছোট জায়গাব্যাপী বাস করে। বিশ মাইল দৈর্ঘ্য ও বিশ মাইল প্রস্থের একটি মাঠে দুই বিলিয়ন লোক দাঁড়াতে পারবে।  সব মানুষকে একটি ক্ষুদ্র প্যাসিফিক দ্বিপে আটকানো সম্ভব।

বড়রা এটা অবশ্যই বিশ্বাস করবে না যদি তুমি তাদের বলো। তারা মনে করে তারা খুব বেশি জায়গা দখল করে আছে।  তারা নিজেদের ভাবে বাওবাব গাছের মত গুরুত্বপূর্ন। তুমি তাদের উপদেশ দিবে যেন তারা নিজেরা হিসেব করে নেয়। তারা ছবি বা ফিগার খুব পছন্দ করে। এগুলি তাদের খুশি করবে। কিন্তু অতিরিক্ত কাজ করতে গিয়ে তোমার সময় নষ্ট করো না। আমি জানি আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস আছে।

ছোট রাজপুত্র যখন পৃথিবীতে আসল তখন চারপাশে কোন মানুষ না দেখে সে অনেক আশ্চর্য হয়েছিল। চাদের উজ্জ্বল আলোতে যখন সোনার কুন্ডলীর মত সাপের শরীর চমকে উঠল, তখন সে ভুল করে অন্য কোন গ্রহে চলে এসেছে ভেবে কিছুটা ভয় পেল।

ছোট রাজপুত্র বিনীতভাবে বলল, “শুভ সন্ধ্যা।”

সাপ উত্তরে বলল, “শুভ সন্ধ্যা।”

“এটা কোন গ্রহ যাতে আমি নেমে এসেছি?” ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল।

উত্তরে সাপ বলল, “এটি পৃথিবী। এই জায়গা আফ্রিকা।”

“অহ! তাহলে কি পৃথিবীতে কোন মানুষ নেই?”

সাপ বলল, “এটি মরুভূমি। মরুভূমিতে কোন মানুষ নেই। পৃথিবী অনেক বড়।”

ছোট রাজপুত্র একটি পাথরে বসে পড়ল এবং আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকাল।

“আমি বিস্মিত! যেন আকাশের এই তারাগুলি স্বর্গে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে একদিন আমরা আমাদের নিজেকে খোঁজে পাই। আমার গ্রহের দিকে তাকাও। এটা ঠিক ওইখানে আমাদের উপরে। কিন্তু আসলে কত দূরে!”

সাপ বলল, “এটা অনেক সুন্দর। তুমি কীজন্য এখানে এসেছে?”

ছোট রাজপুত্র বলল, “একটা ফুলের সাথে আমার কিছু সমস্যা হচ্ছিল।”

“অহ!” সাপ বলল।

তারপর তারা উভয়েই কিছুক্ষণ নিরব থাকল।

ছোট রাজপুত্র আবার কথা শুরু করল, “মানুষেরা কোথায়? এখানে মরুভূমি কিছুটা নির্জন জায়গা…”

সাপ উত্তরে বলল, “মানুষের মাঝেও এই জায়গাটা নির্জন।”

ছোট রাজপুত্র স্থির দৃষ্টিতে অনেকক্ষন সাপটির দিকে তাকিয়ে রইল।

শেষ পর্যন্ত সে বলল, “তুমি একটি মজার প্রানি। একটি আঙ্গুলের থেকে তুমি মোটা না।”

সাপ বলল, “কিন্তু আমি একজন রাজার আঙ্গুলের থেকেও বেশি ক্ষমতাশালী।”

ছোট রাজপুত্র হাসল।

“তুমি বেশি ক্ষমতাবান না। তোমার পাও নেই। তুমি ভ্রমণ করতেও পারবে না…”

সাপ উত্তরে বলল, “আমি তোমাকে এতদুর বহন করে নিয়ে যেতে পারি যা একটা জাহাজও পারবে না।”

সাপ নিজেকে ছোট রাজপুত্রের পায়ে জড়িয়ে ফেলল একটি ব্রেসলেটের মত করে।

সাপ আবার বলল, “আমি কাউকে স্পর্শ করলে তাকে ঐ জায়গায় পাঠিয়ে দিতে পারি যেখান থেকে সে পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু তুমি নির্দোষ, এবং তুমি এসেছে দূরের তারকা থেকে…”

ছোট রাজপুত্র কোন উত্তর দিল না।

সাপ বলল, “তোমার প্রতি আমার মায়া জন্মেছে। এই গ্রাণাইটের পৃথিবীতে তুমি খুব দূর্বল। আমি তোমাকে কোনদিন সাহায্য করতে পারি, যদি তুমি কখনো তোমার গ্রহের জন্য খুব বেশি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ো, তাহলে আমি…”

ছোট রাজপুত্র বলল, “আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি সব সময় এমন হেঁয়ালি পুর্ণ কথা বলো কেন?”

উত্তরে সাপ বলল, “আমি সব হেঁয়ালির সমাধান করি।”

এবং তারা উভয়েই নিরব হয়ে গেল।

 

অধ্যায় – আঠার

ছোট রাজপুত্র মানুষের খোজে বের হল এবং একটি ফুলের দেখা পেল।

ছোট রাজপুত্র মরুভূমি অতিক্রম করে একমাত্র ফুলের দেখা পেল। এটি ছিল তিন পাঁপড়ির একটা ফুল, কোন কাজেরই না।

“শুভ সকাল,” ছোট রাজপুত্র বলল ফুলটিকে।

ফুলটাও বলল, “শুভ সকাল।”

ছোট রাজপুত্র শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল, “মানুষেরা কোথায়?”

ফুল অনেক আগে একটি ক্যারাভানকে যেতে দেখেছিল।

সে বলল, “মানুষেরা? আমার মনে হয় তারা ছয় সাত জন আছে। আমি তাদের কয়েক বছর আগে দেখেছিলাম। কিন্তু কেউ জানে না তাদের কোথায় পাওয়া যাবে। বাতাস তাদের উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাদের কোন শেকড় নেই এবং এটাই তাদের জীবনকে কঠিন করে তোলে।”

“বিদায়,” বলল ছোট রাজপুত্র।

ফুল উত্তরে বিদায় জানাল।

 

 

 

অধ্যায় – উনিশ

ছোট রাজপুত্র একটি পর্বত শ্রেণী বেয়ে উঠল।

 

এরপর ছোট রাজপুত্র একটি উঁচু পাহাড় বেয়ে উঠল। একমাত্র পাহাড় যা সে চিনত, তাতে তিনটি আগ্নেয়গিরি ছিল এবং সেটি ছিল তার হাটুর সমান। এবং সে মৃত আগ্নেয়গিরিকে পা রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করত।

ছোট রাজপুত্র ভাবল, “এই পাহাড়ের মত উঁচু পাহাড় থেকে আমি পৃথিবীটাকে একবারেই দেখতে পারব এবং মানুষদেরও…।”

কিন্তু সে সুইয়ের মত ধারালো পাহাড়ের চূড়া ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না।

সে বিনীত ভাবে বলল, “শুভ সকাল।”

প্রতিধ্বনি হল, “শুভ সকাল, শুভ সকাল, শুভ সকাল…”

“তুমি কে?” ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল।

“তুমি কে? তুমি কে? তুমি কে?”  উত্তর আসল প্রতিধ্বনি থেকে।

“কিন্তু আমার বন্ধুরা, আমি খুব একা,” সে বলল।

প্রতিধ্বনি উত্তর দিল, “আমি খুব একা, খুব একা, খুব একা।”

“কি বিচিত্র গ্রহ! এটি একইসাথে শুকনো, ধারালো, কঠোর এবং ভয়ংকর। এবং লোকগুলির কোন চিন্তা করার ক্ষমতা নেই। তারা যা শোনে তাই বলে। আমার গ্রহে আমার একটি ফুল ছিল যা সর্বদাই প্রথমে কথা বলত…।”

 

অধ্যায়-বিশ

ছোট রাজপুত্র একটি গোলাপ ফুলের বাগান আবিষ্কার করল।

 

দীর্ঘ সময় বালি, পাথর এবং তুষার পেরিয়ে হাটতে হাটতে একসময় ছোট রাজপুত্র একটি রাস্তার দেখা পেল। প্রতিটি রাস্তাই মানুষের ঘরের দিকে যায়।

“শুভ সকাল,” সে ফুলগুলিকে বলল।

সে একরাশ ফুটন্ত গোলাপ ফুলে পূর্ন বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।

গোলাপেরাও উত্তরে জানাল, “শুভ সকাল।

ছোট রাজপুত্র তাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তারা সবাই ঠিক তার ফুলটির মতই দেখতে।

অবাক হয়ে বজ্রাহতের মত সে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা?”

ফুলেরা উত্তরে বলল, “আমরা গোলাপ।”

ছোট রাজপুত্রের খুব মন খারাপ হল। তার ফুল তাকে বলেছিলো, “সেই এই রকম একমাত্র ফুল এই মহাবিশ্বে। কিন্তু এখানে একটিমাত্র বাগানেই আছে তার মত পাঁচ হাজার ফুল!”

“এটা দেখতে পেলে সে খুব বিরক্ত হত। হয়ত খুব কাশত শব্দ করে-  যেন তার খুব ঠান্ডা লেগেছে। সে এমন ভাব করত যে সে কাশিতে মারা যাচ্ছে। সে এরকম করত যাতে কেউ তাকে নিয়ে হাসতে না পারে। তারপর আমাকে ভান করতে হত, সেবা করার। সেবা করে তাকে সুস্থ করার। এবং যদি আমি তা না করতাম তাহলে হয়ত সত্যিই সে মরে যেত…”

তারপর ছোট রাজপুত্র নিজের ভাবনায় ফিরে গেল, “আমি ভাবতাম আমার একটি ফুল আছে যা এই মহাবিশ্বে মাত্র একটিই। কিন্তু আসলে সেটি একটি সাধারণ গোলাপ। একটি সাধারন গোলাপ, তিনটি আগ্নেয়গিরি যা আমার হাটুর কাছে পড়ত, এর মাঝে একটি হয়ত চিরজীবনের জন্য মরে গেছে…এই এগুলি আমাকে খুব মহান একজন রাজপুত্র বানায় না।”

সে ঘাসে শুয়ে পড়ল এবং কাঁদতে লাগল।

 

 

অধ্যায়- একুশ

ছোট রাজপুত্রের সাথে শেয়ালের বন্ধুত্ব হল।

 

এরপর শেয়ালের আবির্ভাব।

 

শেয়াল বলল, “শুভ সকাল।”

 

ছোট রাজপুত্র যদিও ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে দেখতে পেল না তবুও শান্তভাবে বলল, “শুভ সকাল।”

 

“আমি এখানে। এই আপেল গাছের নিচে।” কন্ঠস্বরটি বলল।

 

ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে? তুমি তো দেখতে বেশ সুন্দর!”

 

শেয়াল বলল, “আমি শেয়াল।”

 

ছোট রাজপুত্র প্রস্তাব করল, “আসো আমার সাথে খেলবে। আমার খুব মন খারাপ।”

“আমি তোমার সাথে খেলতে পারবো না। আমি পোষা শেয়াল না।” শেয়াল উত্তরে জানাল।

 

ছোট রাজপুত্র বলল,  “ঠিক আছে। ক্ষমা করো আমাকে।”

 

তারপর কিছুক্ষণ পরে সে জিজ্ঞেস করল, “ ‘পোষা’ জিনিসটা কী?”

 

শেয়াল জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে থাকো না। এখানে কী খুঁজছ?”

 

ছোট রাজপুত্র বলল, “আমি মানুষ খুজছি। কিন্তু এই “পোষা”  মানে কী?”

শেয়াল বলল, “মানুষ! তাদের বন্দুক আছে, তারা শিকার করে। খুব বিরক্তিকর একটা ব্যাপার। তারা মোরগও পালন করে। এটাতেই তাদের একমাত্র আগ্রহ। তুমি কি মোরগের খোঁজ করছ?”

 

ছোট রাজপুত্র উত্তরে বলল, “না। আমি বন্ধু খোঁজছি। কিন্তু এই “পোষা”  শব্দের মানেটা কী?”

শেয়াল বলল, “এটা এমন একটা শব্দ যাকে কেউ তেমন গুরুত্ব দেয় না। এটার অর্থ হতে পারে কোন ধরনের বন্ধন তৈরী করা।”

“বন্ধন তৈরী করা?”

“এরমকই।“ শেয়াল বলতে থাকল, “যেমন ধরো আমার কাছে এখন পর্যন্ত তুমি একজন ছোট বালক। হাজার হাজার ছোট বালকের মত আরো একজন ছোট বালক। তোমাকে আমার কোন দরকার নেই। এবং তোমার ক্ষেত্রে, তোমারও আমাকে কোন দরকার নেই। আমি তোমার কাছে হাজার হাজার সাধারন শেয়ালের মত একটা সামান্য শেয়াল। কিন্তু তুমি যদি আমার সাথে বন্ধন তৈরী করো, তাহলে আমাদের একে অপরকে দরকার হবে। আমার কাছে তুমি হবে সারা পৃথিবীর মধ্যে অদ্বিতীয় একজন। এবং তোমার কাছে আমিও হব ইউনিক একজন।”

 

“আমি কিছুটা বুঝতে শুরু করেছি। একটি ফুল আছে…আমার মনে হয় সে আমাকে পোষ মানিয়ে ফেলেছে…” ছোট রাজপুত্র বলল।

শেয়াল বলল, “হ্যা। এটা সম্ভব। পৃথিবীতে অনেক ধরনের ব্যাপারই ঘটে।”

ছোট রাজপুত্র বলল, “কিন্তু সেটি পৃথিবীতে নয়।”

শেয়ালকে কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং কৌতুহলী মনে হল।

“অন্য কোন গ্রহে?”

“হ্যা।”

“সেই গ্রহে শিকারীরা আছে?”

“না।”

“আহ! দারুণ! মুরগী আছে?”

“না।”

“কোনকিছুই নিঁখুত না।” শেয়াল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

কিন্তু সে তার চিন্তায় ফিরে এল।

শেয়াল বলতে থাকল, “আমার জীবন একঘেয়ে। আমি মোরগ শিকার করি, মানুষেরা আমাকে শিকার করে। প্রতিটি মোরগ একইরকম, প্রতিটি মানুষ একইরকম। তাই, আমি কিছুটা বিরক্ত। কিন্তু তুমি আমাকে পোষ মানালে এটা হবে, যেন নতুন সূর্যোদয়ে আলোকিত হলো আমার জীবন। আমি তোমার পায়ের আওয়াজ অন্য পায়ের আওয়াজের চেয়ে আলাদাভাবে চিনতে পারবো। অন্য পায়ের আওয়াজগুলো আমাকে দ্রুত মাটির নিচে গর্তে লুকাতে বাধ্য করে। কিন্তু তোমার পায়ের আওয়াজ হবে সঙ্গীতের মত যা আমাকে টেনে নিয়ে আসবে গর্ত থেকে। এবং ঐ যে অদূরে শস্য ক্ষেত দেখা যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছো? আমি পাউরুটি খাই না। এগুলো আমার কোন কাজেই লাগে না। এই গমক্ষেতের আমার কোন দরকারই নেই। দুঃখজনক। কিন্তু তোমার চুলের রঙ সোনার মত। চিন্তা করে দেখো, যখন তুমি আমাকে পোষ মানাবে, তখন কী হবে! এই যে সোনালী রঙের শস্যক্ষেত, তা আমাকে তোমার কথা মনে করিয়ে দিবে। এবং  বাতাসের সাথে গম ক্ষেতের আন্দোলন দেখে ভালো লাগবে।”

শেয়াল অনেকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ছোট রাজপুত্রের দিকে তাকিয়ে রইল।

তারপর বলল, “দয়া করে আমাকে পোষ মানাও।”

ছোট রাজপুত্র বলল, “আমি খুব চাই। কিন্তু আমার সময় খুব কম। আমার অনেক কিছু বুঝতে হবে।”

শেয়াল বলল, “কেউ সে জিনিসই বুঝতে পারে যা সে বশে আনতে পারে বা যার সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। মানুষের কোন কিছু বুঝার সময় নেই। তারা দোকান থেকে তৈরী করা জিনিস কেনে। কিন্তু এমন কোন দোকান নেই যেখান থেকে বন্ধুত্ব কেনা যায়, তাই মানুষের এখন কোন বন্ধু নেই। তুমি যদি একজন বন্ধু চাও, আমাকে পোষ মানাও।”

“পোষ মানাতে হলে আমাকে কী করতে হবে?” ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল।

শেয়াল উত্তরে বলল, “তোমাকে খুব ধৈর্যশীল হতে হবে। প্রথমে আমার থেকে কিছুটা দূরত্বে তুমি বসবে। এখনকার মতই। ঐ ঘাসের মধ্যে। আমি তোমার দিকে চোখের কোনা দিয়ে তাকাব। এবং তুমি কিছু বলবে না। কথাই হচ্ছে সমস্ত ভুল বুঝাবুঝির কারণ। তারপর থেকে প্রতিদিন তুমি একটু একটু করে আমার কাছে বসবে…”

তারপরের দিন ছোট রাজপুত্র ফিরে এল।

শেয়াল বলল, “প্রতিদিন তুমি যদি একই সময়ে আসো তাহলে ভালো হয়। উদাহরণস্বরুপ, যদি তুমি বিকেল চারটায় আসো প্রতিদিন, তাহলে বিকেল তিনটা থেকেই আমি খুশি হতে শুরু করব। যত চারটা বাজতে থাকবে ততই আমি আরো খুশি হতে থাকবো। চারটায় আমি দুশ্চিন্তা এবং খুশিতে প্রায় লাফাতে শুরু করে দেব। আমি তোমাকে দেখাতে পারব আমি কত খুশি। কিন্তু তুমি যদি যেকোন সময় আসো তাহলে আমি বুঝতে পারবো না ঠিক কখন আমার হৃদয় তোমাকে অভ্যর্থনা জানাতে যাচ্ছে। প্রত্যেকেরই উচিত সঠিক আচার অনুষ্ঠান পালন করা।”

ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল, “আচার কী?”

শেয়াল উত্তরে বলল, “এটা প্রায়ই এড়িয়ে যাওয়া হয় এমন একটা ব্যাপার। এটা হচ্ছে এমন জিনিস যা একদিনকে অন্যদিনের থেকে, এক ঘন্টাকে অন্য ঘন্টার থেকে আলাদা করে দেয়। উদাহরন হিসেবে বলি, একটি আচার আছে, আমার শিকারীদের মাঝে। প্রতি বৃহস্পতিবারে তারা গ্রামের মেয়েদের নিয়ে নাচানাচি করে। তাই বৃহস্পতিবার আমার জন্য অসাধারণ একটা দিন। আমি সেদিন যতদূর ইচ্ছা আঙুরক্ষেতে ঘুরে বেড়াতে পারি। কিন্তু যদি শিকারীরা যেকোন দিন নাচত তাহলে প্রতিদিনই হত একইরকম। আমি কোন অবসর পেতাম না।”

ছোট রাজপুত্র শেয়ালকে পোষ মানাল। এবং যখন তার প্রস্থানের সময় ঘনিয়ে আসল শেয়াল বলল, “আমার কান্না পাচ্ছে। আমি কাঁদবো।”

ছোট রাজপুত্র বলল, “এটা তোমার দোষ। আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে চাই নি। তুমিই চেয়েছিলে আমি তোমাকে পোষ মানাই।”

শেয়াল বলল, “হ্যা। তা ঠিক।”

ছোট রাজপুত্র বলল, “কিন্তু এখন তুমি কাঁদতে যাচ্ছো!”

শেয়াল বলল, “হ্যা। তাও ঠিক।”

“সুতরাং এতে তোমার ভালো কিছুই হল না।”

শেয়াল বলল, “না। এটা আমার অনেক ভালো করেছে। ঐ শস্যক্ষেতের সোনালী রঙের জন্য।” সে আরো যোগ করল, “যাও এবং ঐ ফুলগুলোর দিকে আবার তাকাও। তুমি বুঝতে পারবে তোমার ফুলটি পৃথিবীতে ইউনিক। তারপর এসো আমার কাছে বিদায় বলতে। আমি তোমাকে একটি গোপন উপহার দেব।”

ছোট রাজপুত্র গোলাপগুলিকে দেখতে গেল আবার।

সে ফুলদের বলল, “তোমরা আমার গোলাপ ফুলের মত না। তোমরা আসলে এখনো কিছুই না। তোমরা কারো সাথে বন্ধুত্ব করো নি, কেউ তোমাদের সাথে বন্ধুত্ব করে নি। আমি আমার শেয়ালকে প্রথম যখন দেখেছিলাম তখন সে যেরকম ছিল তোমরা সেরকমই। সে ছিল শত সহস্র সাধারন শেয়ালের মত একটা শেয়াল। কিন্তু এখন আমি তাকে আমার বন্ধু বানিয়ে ফেলেছি। এখন আমার কাছে সারা পৃথিবীর মধ্যে সে ইউনিক।”

ফুলেরা বেশ লজ্জা পেল।

“তোমরা সুন্দর কিন্তু শূন্য,” ছোট রাজপুত্র বলতে থাকল, “কেউ তোমাদের জন্য মরতে চাইবে না। এটা ঠিক যে একজন সাধারন পথচারী ভাবতে পারে আমার ফুলটি ঠিক তোমাদের মত। কিন্তু আমার ফুল তার নিজের কাছে তোমাদের মত শত সহস্র ফুলের থেকে সে উত্তম, কারণ সে সেই ফুল যাকে আমি নিজ হাতে পানি দিয়েছি, আমি গ্লাস গ্লোব দিয়ে থাকে ঢেকেছি, আমি তাকে পর্দা দিয়ে ছায়া দিয়েছি, তার জন্য আমি শুয়োপোকাকে মেরেছি (দু একটি বাদে যাতে তারা প্রজাপতি হতে পারে), আমি শুনেছি তাকে যখন সে অভিযোগ করেছে, অহংকারে আত্মহারা হয়েছে অথবা যখন সে কিছুই বলে নি। কারণ সে আমার গোলাপ।”

এরপর ছোট রাজপুত্র শেয়ালের কাছে ফিরে গেল।

গিয়ে বলল, “বিদায়।”

শেয়াল বলল, “বিদায়। এবং আমার গোপন কথাটি হল, একটি সহজ গোপন কথা – একমাত্র হৃদয় ব্যবহার করেই কেউ সঠিক ভাবে দেখতে পারে, যা খুবই দরকারী তা চোখে দেখা যায় না।”

ছোট রাজপুত্র সাথে সাথে বলল, “যা খুবই দরকারী তা চোখে দেখা যায় না,” যাতে সে কথাটা মনে রাখতে পারে।

“যে সময় তুমি তোমার গোলাপের জন্য ব্যয় করেছিলে তাই তোমার গোলাপকে এত গুরুত্বপুর্ন করে তুলেছে।”

ছোট রাজপুত্র বলল, “যে সময় আমি আমার গোলাপের জন্য ব্যয় করেছি… যাতে সে নিশ্চিতভাবে আমার স্মৃতিতে থাকে।”

শেয়াল বলল,” মানুষ এই সত্য ভুলে গেছে। তুমি ভুলে যেও না। তুমি যাদের সাথে বন্ধুত্ব করেছ তাদের কাছে তুমি চিরজীবন দায়বদ্ধ। তুমি তোমার গোলাপের কাছে দায়বদ্ধ।”

ছোট রাজপুত্র বলল, “আমি আমার গোলাপের প্রতি দায়বদ্ধ, যাতে আমি তাকে অবশ্যই মনে রাখতে পারি।”

 

অধ্যায় – বাইশ

ছোট রাজপুত্রের সাথে রেলওয়ে সুইচম্যানের স্বাক্ষাত।

 

ছোট রাজপুত্র বলল, “শুভ সকাল।“

রেলওয়ে সুইচম্যান উত্তরে বলল, “শুভ সকাল।”

ছোট রাজপুতর বলল, “আপনি এখানে কী করেন?”

“আমি রেলগাড়িকে এক লাইন থেকে অন্য লাইনে চালনা করি। কখনো ডানে, কখনো বামে।”

একটি দারুণ আলোতে উজ্জ্বল রেলগাড়ি সুইচম্যানের কেবিনে তুমুল গর্জনে ছুটে এল।

ছোট রাজপুতর বলল, “তারা খুব তাড়াহুড়ায় আছে। তারা কী খুঁজছে?”

সুইচম্যান জানাল, “রেল ইঞ্জিনের ইঞ্জিনিয়ারও জানে না।”

দ্বিতীয় আরেকটি রেলগাড়ি আলোকোজ্জ্বল হয়ে অন্যদিক থেকে ছুটে এল।

 

“তারা কি ফিরে আসছে?” ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল।

 

“এগুলো একটা গাড়ি নয়। এটা একটা একচেঞ্জ।” সুইচম্যান উত্তর দিল।

 

ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল, “তারা যেখানে আছে সেখান নিয়ে কি তারা সন্তুষ্ট না?”

সুইচম্যান বলল, “কেউই তার নিজের জায়গা নিয়ে সন্তুষ্ট না।”

 

এরপর তারা তৃতীয় আলোকোজ্জ্বল রেলগাড়ি আসার শব্দ শুনতে পেল।

 

ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল, “তারা কি প্রথম ভ্রমণকারীদের অনুসরন করছে?”

 

সুইচম্যান বলল, “তারা কাউকেই অনুসরণ করছে না। তারা ওখানে ঘুমিয়ে আছে। যারা ঘুমায় নি তারা হাই তুলছে। শুধুমাত্র ছোট ছোট বাচ্চারা জানালাতে নাক লাগিয়ে বাইরে দেখছে।”

 

ছোট রাজপুত্র বলল, “শুধুমাত্র বাচ্চারা জানে তারা কী খোঁজছে। তারা যখন একটি ছেঁড়া পুতুল নিয়ে সময় নষ্ট করে এবং এটিই তখন তাদের কাছে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে যায়। কেউ তা কেড়ে নিলে তারা কান্না জুড়ে দেয়।”

 

সুইচম্যান বলল, “তারা ভাগ্যবান।”

 

অধ্যায়- তেইশ

ছোট রাজপুত্রের সাথে দোকানদারের স্বাক্ষাত হল।

 

“শুভ সকাল,” ছোট রাজপুত্র বলল।

দোকানদার উত্তরে বলল, “শুভ সকাল।”

এই দোকানদার কিছু ঔষধের বড়ি বিক্রি করছিল যা তৃষ্ণা নিবারণ করে। সপ্তাহে একটা খেলে পুরো সপ্তাহে কোন তৃষ্ণা জাগবে না।

“আপনি এগুলি কেন বিক্রি করছেন?” ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল।

দোকানদার বলল, “কারণ এগুলো প্রচুর সময় বাঁচায়। বিশেষজ্ঞরা হিসেব করে দেখেছেন এগুলো প্রতি সপ্তাহে তোমার ৫৩ মিনিট সময় বাঁচাবে।”

“এই ৫৩ মিনিটে আমি কী করব?”

“যা তোমার ইচ্ছা…”

 

ছোট রাজপুত্র নিজেকে বলল, “আমি যদি ৫৩ মিনিট সময় পাই যা ইচ্ছা করার জন্য তাহলে আমি চাইব বিশুদ্ধ পানির ফোয়ারার ভেতর দিয়ে হেটে এই অবসর সময় কাটাতে।”

 

অধ্যায় – চব্বিশ

পিপাসার্ত হয়ে ছোট রাজপুত্র এবং কথক মরুভূমিতে একটি কুয়া খোজতে লাগল।

 

এটা ছিল দূর্ঘটনায় মরুভূমিতে এসে পড়ার পর অষ্টম দিন। আমি ছোট রাজপুত্রের কাছ থেকে যখন দোকানদারের গল্প শুনছিলাম তখন পান করছিলাম আমার সাথে থাকা পানির শেষ ফোঁটা।

“আহ! তোমার স্মৃতিগুলো দারুণ। কিন্তু এখনো আমি আমার প্লেন ঠিক করতে পারলাম না। আমার পান করার মত কোন পানিও নেই আর। তাই তোমার মত বিশুদ্ধ পানির ফোয়ারার ভেতর দিয়ে হাটতে পারলে আমিও খুশি হতাম।”

ছোট রাজপুত্র বলতে শুরু করল, “আমার বন্ধু শেয়ালটি…”

“প্রিয় ছোট্ট বন্ধু, শেয়ালের কথায় এখানে কোন কাজ হবে না।”

“কেনো?”

“কারণ আমি পিপাসায় মরতে বসেছি।”

সে আমার কথা বুঝতে পারল না এবং বলল, “একটা বন্ধু থাকা একটা ভাল ব্যাপার। যদি কেউ মরতে বসে তবুও। শেয়ালকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে আমি গর্বিত।”

আমি মনে মনে ভাবলাম, তার বিপদ সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই। সে কখনো ক্ষুধার্ত বা পিপাসার্ত হয় না। তার শুধু দরকার হয় একটু সূর্যের আলো।

কিন্তু সে আমার দিকে ধীরভাবে তাকাল এবং বলল, “আমি তৃষ্ণার্থ। চলো একটা কুয়া খোঁজে বের করি।”

আমি একটা ক্লান্ত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললাম। মরুভূমিতে হঠাৎ করে কুয়া খোঁজা হাস্যকর একটা ব্যাপার। কিন্তু তবুও আমরা হাটতে শুরু করলাম।

যখন আমরা ক্লান্তিভরা মন নিয়ে অনেকক্ষন নিঃশব্দে হাটছিলাম তখন একসময় অন্ধকার নেমে এল। এবং দেখা দিল উজ্জ্বল তারকারাজি। তৃষ্ণা আমাকে জ্বরভাবাপন্ন করে তুলেছিল। আমি আকাশের তারাদের দিকে তাকালাম। মনে হল এগুলি যেন স্বপ্নে দেখছি। ছোট রাজপুত্রের শেষ বলা কিছু কথা আমার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছিলঃ

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তারপরে, “তাহলে তুমিও পিপাসার্ত?”

সে আমার প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর দেয় নি। শুধু বলেছিলো, “পানি হৃদয়ের জন্যও ভালো হবে…”

আমি তার উত্তর বুঝতে পারছিলাম না। তবুও কিছু বললাম না। কারণ আমার বেশ ভালোমতই জানা ছিল তাকে জেরা করা অসম্ভব।

সে ক্লান্ত ছিল এবং বসে পড়ল। আমিও তার পাশে বসলাম। কিছুক্ষণ নিরবতার পর সে আবার কথা বলল, “তারাগুলো সুন্দর একটা ফুলের জন্য, যাকে দেখা যাবে না…”

আমি উত্তর দিলাম, “ঠিক।” এবং আর কোন কিছু না বলে আমি বালির ঢালের দিকে তাকালাম যা চাদের আলোয় সম্প্রসারিত হয়ে গেছে আমাদের সামনে।

 

ছোট রাজপুত্র বলল, “মরুভূমিটা সুন্দর।”

 

এটা ছিল সত্যি কথা। আমি সব সময় মরুভূমিকে ভালোবেসেছি। কেউ একজন মরুভূমির বালিতে বসে থাকলে কিছু দেখেনা, কিছু শুনে না। তবুও নিরবতা কিছু স্পন্দন সৃষ্টি করে, মৃদু ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়।

 

ছোট রাজপুত্র বলল, “যা মরুভূমিকে সুন্দর করেছে তা হলো কোথাও না কোথাও এটি পানির কুয়া লুকিয়ে রাখে…”

 

আমি মরুভূমির বালিতে প্রতিবিম্বের প্রকৃত অর্থ হঠাৎ বুঝতে পেরে অবাক হয়ে গেলাম। যখন আমি ছোট ছিলাম তখন একটি পুরনো বাড়িতে থাকতাম। কিংবদন্তি অনুযায়ী প্রচলিত একটা ধারনা ছিল যে ঐ বাড়িতে গুপ্তধন লুকানো আছে। কিন্তু কেউ জানতো না কীভাবে সে গুপ্তধন খোঁজে পাওয়া যাবে। মনে হয় কেউ কোনদিন সে চেষ্টাও করে নি। কিন্তু সেই কিংবদন্তি আমার বাড়িতে এক ধরনের জাদুময়তা ছুঁড়ে দিয়েছিল যেন। আমার বাড়ি তার হৃদয়ের গভীরে এক গুপ্ত কথা লুকিয়ে রেখেছিল…

 

আমি ছোট রাজপুত্রকে বললাম, “হ্যা। এই তারা, মরুভূমি কিংবা বাড়িকে সৌন্দর্য দিয়েছে এমন কিছু, যা চোখে দেখা যায় না।”

সে বলল, “আমি আনন্দিত যে তুমি আমার শেয়ালের সাথে একমত হয়েছ।”

 

ছোট রাজপুত্র ঘুমিয়ে পড়লে আমি তাকে কোলে নিয়ে হাটতে শুরু করলাম। আমি ভেতরে ভেতরে নিজেকে আন্দোলিত অনুভব করছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি যেন হালকা একটি গুপ্তধন নিয়ে হাটছি। আমার মনে হচ্ছিল এর চেয়ে হালকা কিছু আর নেই পৃথিবীতে। আমি তার ম্লান কপালের দিকে তাকালাম, তার চোখ বন্ধ, তার চুলগুলি বাতাসে কাঁপছিল। আমি নিজেকে বললাম, “আমি যা দেখছি তা একটি খোলক মাত্র। যা গুরুত্বপূর্ন তা চোখে দেখা যায় না…”

তার ঠোট একটি সংশয়ী অর্ধ হাসিতে কিছুটা নড়ে উঠলে আমি আবার নিজেকে বললাম, “আমাকে যে জিনিসটা এই ছোট রাজপুত্রের ব্যাপারে বেশি আন্দোলিত করেছে তা হল একটা ফুলের প্রতি তার বিশ্বস্থতা। একটি গোলাপের ছবি যা তার সমস্তটার ভেতর দিয়ে বাতির শিখার মত জ্বলজ্বল করে, যখন সে ঘুমিয়ে থাকে তখনো…”

এবং তাকে তখনো আমার হালকা মনে হচ্ছিল। আমি অনুভব করলাম তাকে রক্ষা করতে চাই আমি, যেন সে একটি আগুনের শিখা যা বাতাস এলেই নিভে যাবে।

 

যেহেতু আমি হাঁটছিলাম তাই ভোরের দিকে একটি কুয়া পেলাম।

 

 

অধ্যায় – পঁচিশ

কুয়া খোঁজে পাওয়ার পর কথকের  সাথে ছোট রাজপুত্র তার গ্রহে ফিরে যাবার ব্যাপারে কথা বলল।

 

ছোট রাজপুত্র বলল, “মানুষেরা একপ্রেস ট্রেনে চড়ে রাস্তায় বের হয় কিন্তু তারা কী খোঁজছে তারা তা জানে না। তারপর তারা ছুটে বেড়ায়, উত্তেজিত হয়ে ঘুরতে থাকে এবং ঘুরতেই থাকে।”

সে আরো যোগ করে, “অর্থহীন ঝামেলা!”

আমরা যে কুয়ার কাছে আসলাম তা সাধারন সাহারা মরুভূমির কুয়ার মত ছিল না। সাধারনত সাহারা মরুভূমির কুয়াগুলি হয় বালিতে একটা গর্তের মত। কিন্তু এই কুয়াটি হচ্ছে গ্রামের কুয়ার মত। কিন্তু আশেপাশে কোন গ্রাম ছিলো না, তাই আমার মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি।

আমি ছোট রাজপুত্রকে বললাম, “আশ্চর্যের ব্যাপার! সবকিছু যেন ব্যবহার করার জন্য তৈরী করা আছে, পুলি, রশি, বালতি…”

 

হে হাসলো, দড়িকে ধরে পুলিকে কাজ করানো শুরু করে দিল। দীর্ঘদিন বাতাসের স্পর্শ না পাওয়া বায়ুনির্দেশক যন্ত্রের মত শব্দ করে উঠল পুলি।

ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি শুনতে পেয়েছো? আমরা কুয়াটাকে জাগিয়ে তুলেছি এবং সে গান গাওয়া শুরু করেছে…”

আমি চাইছিলাম না সে দড়ি নেড়ে ক্লান্ত হোক। তাই বললাম, “এটা আমাকে ছেড়ে দাও। এটা তোমার জন্য খুব ভারী।”

আমি বালতিকে টেনে কুয়ার পাশে তোলে আনলাম। তোলে এনে খুশি এবং ক্লান্ত দুটোই হয়ে গেলাম একসাথে। পুলির গানটি আমার কানে বাজছিলো তখনো এবং আমি দেখতে পাচ্ছিলাম কুয়ার কম্পিত পানিতে সূর্যের আলো এখনো চকমক করছে।

ছোট রাজপুত্র বলল, “আমি এই পানির জন্য তৃষ্ণার্থ। আমাকে পান করার জন্য দাও কিছু।”

 

আমি বুঝতে পারলাম সে কী খোঁজছিলো।

আমি বালতিটাকে তার ঠোটের কাছে নিলাম। সে চোখ বন্ধ করে পানি পান করল। এটা ছিলো বিশেষ কোন উৎসবের আনন্দের মত। এই পানি অবশ্যই সাধারন খাদ্যের চেয়ে আলাদা কিছু। এর মিষ্টতা তারকাদীপ্ত আকাশের নিচে দীর্ঘ পথচলা, পুলির সঙ্গীত এবং আমার হাতের শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। এটা হৃদয়ের জন্য ভালো, উপহারের মত। আমি যখন ছোট বালক ছিলাম, ক্রিসমাস ট্রির বাতি, মধ্যরাতে মানুষের গান, হাসিমুখের কোমলতা –  আমি যেসব গিফট পেতাম সেগুলির মতই ঔজ্জ্বল্য বিকিরন করে হৃদয় ভরিয়ে দিত।

ছোট রাজপুত্র বলল, “তুমি যেখানে থাকো যেখানকার লোকেরা একই বাগানে পাঁচ হাজার গোলাপ উৎপন্ন করে এবং এর মধ্যে তারা যা খোঁজছে তা খোঁজে পায় না।”

আমি উত্তরে বললাম, “তা তারা খোঁজে পায় না।”

“এবং তারা যা খোঁজছে তা একটি মাত্র ফুলের মধ্যে কিংবা সামান্য পানির মধ্যে খোঁজে পাওয়া যেত।”

আমি বললাম, “হ্যা। ঠিক বলেছ।”

ছোট রাজপুত্র যোগ করল, “কিন্তু চোখেরা তো অন্ধ। একজনকে অবশ্যই হৃদয় দিয়ে খোঁজতে হবে…”

 

আমি পানি পান করলাম। শান্তভাবে নিঃশ্বাস নিলাম। সূর্যোদয়ের সময় মরুভূমির বালি মধুর মত দেখায়। এবং সেই মধুর রঙ আমাকে উৎফুল্ল করে তোলে। যা তারপরে আমাকে এক বিষাদের অনুভূতির দিকে নিয়ে যায়।

ছোট রাজপুত্র আবার আমার পাশে বসতে বসতে বলল, “তুমি অবশ্যই তোমার কথা রাখবে।”

“কী কথা?”

“তুমি জানো…আমার ভেড়ার জন্য মুখবন্ধ তৈরি করে দেয়া- আমি ফুলের কাছে দায়বদ্ধ।”

 

“আমি আমার আঁকাগুলোর রাফ পকেট থেকে বের করলাম।” ছোট রাজপুত্র এগুলি দেখলো এবং হাসতে হাসতে বলল, “তোমার বাওবাবকে বাঁধাকপির মত লাগছে।”

“অহ!”

আমি আমার বাওবাবের জন্য গর্বিত ছিলাম!

“তোমার শেয়াল – তার কান কিছুটা শিং এর মত। তারা খুব লম্বা।”

এবং সে আবার হাসলো।

আমি বললাম, “এটা ঠিক না ছোট রাজপুত্র। আমি ছবি আঁকতে জানি না শুধুমাত্র ভিতর থেকে বোয়া কন্সট্রিকটর এবং বাইরে থেকে বোয়া কন্সট্রিকটর ছাড়া।”

সে বলল, “ঠিক আছে। কোন সমস্যা নেই। বাচ্চারা বুঝতে পারে।”

আমি পেনসিল দিয়ে একটি মুখবন্ধ আঁকলাম। এবং তাকে দিলাম।

আমি বললাম, “তোমার কিছু পরিকল্পনা আছে যা আমি জানি না।”

কিন্তু সে কোন উত্তর না দিয়ে আমাকে বলল, “তুমি আমার পৃথিবীতে অতর্কিত আগমন সম্পর্কে জানো, কাল তার এক বছর পূর্তি হবে।”

তারপর সামান্য নিরবতার পর সে আরো বলল, “আমি নেমে এসেছিলাম এখানেরই কাছাকাছি জায়গায়।”

 

তারপর হঠাৎ সে রক্তিম হয়ে গেল।  এবং আবারো কেন জানি না অদ্ভুত কষ্ট আমাকে ছুঁয়ে গেল। একটা প্রশ্ন আমার মাথায় আসলঃ

“তাহলে এটা কাকতালীয় ছিলো না- আমি যে তোমাকে একদিন সকালে চোখ খোলে দেখেছিলাম – এক সপ্তাহ আগে-মানববসতি থেকে হাজার মাইল দূরে তুমি একা একা পায়চারি করছিলে?”

ছোট রাজপুত্রের মুখ আবার রক্তিম হয়ে গেল।

এবং আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত কন্ঠে যোগ করলাম, “সম্ভবত এটা তোমার এক বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে?”

ছোট রাজপুত্র আবার রক্তিম হয়ে গেল। কিন্তু সে কোন উত্তর দিলো না। কিন্তু কেউ এরকম রক্তিম হয়ে গেলে এ থেকে কী বোঝা যায় না যে উত্তরটা – “হ্যা”?

আমি বললাম, “অহ! আমি কিছুটা ভয় পাচ্ছি।”

কিন্তু সে আমাকে বাঁধা দিয়ে বলল,  “এখন তুমি কাজ শুরু করো। তোমার উচিত ইঞ্জিনের কাছে ফেরত যাওয়া। আমি এখানে অপেক্ষা করব। কাল সন্ধ্যায় ফিরে এসো।”

কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম না। আমার শেয়ালের কথা মনে হল। কেউ যদি বন্ধুত্ব করে তাহলে থাকে কিছুটা কান্নার ঝুঁকি নিতে হয়।

 

 

অধ্যায় – ছাব্বিশ

ছোট রাজপুত্র সাপের সাথে কথা বলল, কথককে স্বান্তনা দিল এবং নিজের গ্রহে ফিরে গেল।

 

কুয়ার পাশে একটা ভাঙা দেয়াল ছিল। আমি যখন পরদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষে ফিরে এলাম তখন দেখলাম ছোট রাজপুত্র ওই দেয়ালের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আমি শুনলাম সে বলছে- “তাহলে তোমার মনে নেই। এটা ঠিক জায়গা না।”

আরেকটি স্বর উত্তর দিল, “হ্যা হ্যা! এটা ঠিক দিন কিন্তু ঠিক জায়গা না।”

আমি দেয়ালের দিকে হাটতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুই দেখতে বা শুনতে পেলাম না। ছোট রাজপুত্র আবার ঐ স্বরকে উত্তরে বলল, “ঠিক! তুমি দেখবে বালিতে কোথায় আমার পায়ের চিহ্ন শুরু হয়েছে। তোমার কিছু করার নেই শুধু সে জায়গায় আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি আজ রাতেই সেখানে পৌছব।”

আমি দেয়াল থেকে মাত্র বিশ মিটার দূরে ছিলাম। কিন্তু তবুও কিছু দেখতে পেলাম না।

কিছুক্ষণ নিরবতার পর ছোট রাজপুত্র আবার বলল, “তোমার ভালো বিষ আছে? আমাকে দীর্ঘ সময় কষ্ঠের ভিতর দিয়ে যেতে হবে না তো?”

আমি আমার চলা থামালাম। এই কথা শোনে মনে হচ্ছিল আমার হৃদয় বিদীর্ন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তখনো কী ঘটছে আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।

ছোট রাজপুত্র ওই স্বরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তাহলে এবার তুমি চলে যাও। আমি দেয়াল থেকে নামব।”

 

 

আমার চোখ এবার দেয়ালের নিচে চলে গেল। চোখ ওদিকে যাওয়ামাত্র আমি লাফিয়ে উঠলাম। আমার সামনে, ছোট রাজপুত্রের দিকে মুখ করে আছে বিষাক্ত হলুদ সাপ। যা মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে কাউকে মেরে ফেলতে পারে। আমি পকেটে হাত দিয়ে আমার রিভলবারটা বের করছিলাম যদিও, তবুও কয়েক পা পিছনে সরে গেলাম। কিন্তু আমি যে শব্দ করেছিলাম তাতেই সাপটি আস্তে আস্তে চলে যেতে শুরু করল।  কোন তাড়াহুড়া না করে, পাথরের সাথে মৃদু ধাতব কিছু শব্দ করে সাপটি আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।

আমি দেয়ালে গেলাম। ছোট রাজপুত্রের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। আমি তার বাহুতে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, “এসবের মানে কী? তুমি কেন সাপের সাথে কথা বলছ?”

 

সে সবসময় যে মাফলার পড়ে থাকে আমি তা একটু খোলে ঢিলা করে দিলাম। তার কপাল পানি দিয়ে মুছে দিলাম এবং পান করার জন্য পানি দিলাম। তখন তাকে আর প্রশ্ন করতে আমার সাহস হল না। সে বেশ গম্ভীরভাবে আমার দিকে তাকাল এবং আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি বুঝতে পারছিলাম তার হৃদস্পন্দন। তার হৃতপিন্ড একটা রাইফেলের গুলি খেয়ে মরতে বসা পাখির মত স্পন্দিত হচ্ছিল…

 

“আমি খুশি যে তুমি তোমার ইঞ্জিন ঠিক করতে পেরেছ। এখন তুমি বাড়ি যেতে পারবে।”

 

“তুমি কীভাবে তা জানতে পারলে?”

 

আমি তাকে বলতে এসেছিলাম যে আমার কাজ সফল হয়েছে। আমি যেরকম কখনো ভাবতেও পারিনি ঠিক সেরকম ভাবে সফল হয়েছে।

সে আমার প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না কিন্তু আরো বলল, “আমিও বাড়ি যাচ্ছি।”

এবং দুঃখিতভাবে যোগ করল, “এটা অনেক দূরে এবং অনেক কঠিন।”

 

আমি বুঝতে পারছিলাম অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে চলেছে। আমি তাকে ধরে রেখেছিলাম। যেন সে একটি ছোট বাচ্চা। মনে হচ্ছিল সে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যগ্রভাবে ছুটে চলেছে অতলস্পর্শী নরকের দিকে কিন্তু তাকে আমি ফেরাতে পারছি না।

 

তার দৃষ্টি ছিল গম্ভীর, যেন কেউ বহুদূরে হারিয়ে গেছে।

 

আমার কাছে তোমার ভেড়া আছে। ভেড়ার বাক্স আছে। ভেড়ার মুখবন্ধ আছে।

 

সে আমার দিকে তাকিয়ে দুঃখভরা হাসি হাসল।

 

আমি দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষা করে ছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম সে আস্তে আস্তে পুনরজ্জীবিত হচ্ছে যেন।

 

আমি তাকে বললাম, “প্রিয় ছোট্ট বন্ধু, তুমি ভয় পাচ্ছ।”

সে ভীত ছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সে হালকা করে হাসল।

“আমি এই সন্ধ্যায় আরো বেশি ভয় পাবো।”

এই কথায় আবারো আমার মনে হল অপরিবর্তনীয় কোন ভয়ে আমি জমে যাচ্ছি। ছোট রাজপুত্রের হাসির শব্দ আমি আর কোনদিন শুনতে পারব না –এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না মনে হচ্ছিল। আমার জন্য এই হাসি ছিল মরুভূমিতে বিশুদ্ধ পানির ফোয়ারার মত।

আমি বললাম, “ছোট্ট বন্ধু, আমি তোমার হাসি আবার শুনতে চাই।”

কিন্তু সে আমাকে বলল, “আজকে এক বছর পূর্ণ হবে। আমার তারাকে সেই জায়গায় দেখা যাবে যেখানে এক বছর আগে আমি এসে নেমেছিলাম।”

আমি বললাম, “ছোট্ট বন্ধু, আমাকে বলো এইসব দুঃস্বপ্ন- এই তারা, সাপের সাথে কথা বলা, নির্দিষ্ট জায়গা – সব দুঃস্বপ্ন।”

কিন্তু সে এর কোন উত্তর না দিয়ে আমাকে বলল, “যা গুরুত্বপূর্ন তা কখনো চোখে দেখা যায় না।”

“হ্যা। আমি তা জানি।”

 

“এটা ফুলের মতই। তুমি যদি কোন ফুলকে ভালোবাসো যা একটি তারায় বাস করে তাহলে রাতের আকাশ তোমার কাছে অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে যাবে। প্রতিটি তারাই প্রস্ফুটিত ফুলের সম্ভার নিয়ে আবির্ভূত হবে তোমার কাছে।”

 

“হ্যা। আমি তা জানি।”

 

“এটা পানির মতই। পুলি, রশি এবং বালতির সাহায্যে যে পানি তুলে আমাকে তুমি পান করতে দিয়েছিলে – তা ছিলে গানের মত সুন্দর। তোমার জানো নিশ্চয়ই- কত সুন্দর ছিল!”

 

“হ্যা। জানি।”

 

“এবং রাতে তুমি আকাশের দিকে তাকাবে। আমি যেখানে থাকি সেখানে সব কিছু খুব ছোট ছোট। তাই আমি তোমাকে দেখাতে পারব না ঠিক কোথায় আমার তারাকে দেখা যাবে। তোমার জন্য আমার তারা হবে অসংখ্য তারকার মধ্যে যেকোন একটা। তাই তুমি স্বর্গের সব তারকাকেই দেখতে ভালোবাসবে। তারা সবাই হবে তোমার বন্ধু। এবং আমি তোমাকে একটি উপহার দেব।”

 

সে আবার হাসল।

 

“আহ ছোট রাজপুত্র! প্রিয় ছোট রাজপুত্র! আমি এই হাসির শব্দ ভালোবাসি।”

 

“এটাই আমার উপহার। এটা হবে আমরা যখন পানি খেয়েছিলাম ঠিক তখনকার মুহুর্তের মতই।”

 

“তুমি কী বলতে চাচ্ছো?”

 

সে বলল, “প্রত্যেক মানুষের তারকা আছে। কিন্তু প্রত্যেকের জন্য তা একই জিনিস না। যেমন – যারা ভ্রমনকারী তাদের জন্য তারকারা পথ প্রদর্শক। অন্য সাধারণ লোকদের কাছে তা আকাশের ক্ষুদ্র আলো ব্যতিত কিছুই নয়। পন্ডিতদের জন্য তারকাগুলি সমস্যা। আমার ব্যবসায়ী লোকটির জন্য এগুলি সম্পদ। কিন্তু সব তারকাই নিরব। তুমি – শুধুমাত্র তোমার হবে এইসব তারকাগুলি, তোমার মত করে।”

 

“তুমি ঠিক কী বলতে চাচ্ছো?”

 

“এই তারকাগুলোর যেকোন একটিতে আমি থাকবো। যেকোন একটিতে আমি হাসব। তখন সব তারয়াগুলি হেসে উঠবে। যখন তুমি রাতের আকাশে তাকাবে। তুমি …শুধুমাত্র তোমার তারকা থাকবে যেগুলি হাসতে পারে।”

 

সে আবার হাসল।

 

“এটা হবে যেন তারকার পরিবর্তে আমি তোমাকে অসংখ্য ঘন্টা দিলাম যেগুলি হাসতে পারে…”

 

সে আবার হাসল। কিন্তু দ্রুতই আবার গম্ভীর হয়ে গেল,

 

ছোট রাজপুত্র বলল, “আজ রাতে – তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো – এসো না।”

 

আমি বললাম, “আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না।”

 

“আমাকে এরকম দেখাবে যে মনে হবে আমি কষ্ট পাচ্ছি। মনে হবে আমি মারা যাচ্ছি। এগুলি দেখতে তাই এসো না। এগুলো দেখার কোন মানে হয় না…”

 

“আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না।”

 

সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল।

 

“আমি তোমাকে বলছি শোনো- এটা সাপের জন্যও। সাপ ভয়ংকর প্রানী। সে মজা করার জন্য তোমাকেও কামড়ে দিতে পারে।”

 

“আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না।”

 

কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে বলল, “এটাও সত্য যে দ্বিতীয় কামড় দেয়ার মত পর্যাপ্ত বিষ তাদের কাছে থাকে না।”

 

সেই রাতে আমি তাকে হাটতে বের হওয়ার সময় দেখলাম না। সে কোন শব্দ না করে আমার পাশ থেকে চলে গেল। যখন আমি অনেক খোঁজে তাকে দেখতে পেলাম তখন সে দ্রুত কিন্তু ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। আমি তার পাশে গেলে সে শুধু বলল, “আহ! তুমি এখানে…”

সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল। আমাকে হাত ধরল। এবং বলল, “তোমার এখানে আসা ঠিক হয় নি। তুমি কষ্ট পাবে। আমাকে দেখে মনে হবে আমি মারা গেছি। কিন্তু সেটি আসলে সত্য না।”

আমি কিছু বললাম না।

“তুমি বুঝতে পারছ। আমার তারকা অনেক দূরে। আমি এই শরীর নিয়ে সেখানে যেতে পারব না। এটা অনেক ভারী।”

আমি কিছু বললাম না।

“কিন্তু এটি হবে একটি পুরনো পরিত্যক্ত খোলসের মত। পুরনো খোলক নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই।”

আমি কিছু বললাম না।

সে কিছুটা হতাশ হল। কিন্তু আরেকবার চেষ্টা করল, “তুমি জানো, এটা হবে খুব মজার। আমিও তারকাদের দিকে তাকাব। সব তারকাগুলোতে থাকবে মরিচাপড়া পুলি যুক্ত কুয়া। প্রতিটা গ্রহে থাকবে আমার পান করার জন্য নির্মল পানি…”

 

আমি কিছু বললাম না।

 

“তা হবে অসাধারন! তোমার থাকবে পাঁচ শত বিলিয়ন ছোট ঘন্টা এবং আমার থাকবে পাঁচ শত বিলিয়ন বিশুদ্ধ পানির ফোয়ারা।”

 

সে আর কিছুই বলছিল না। কারণ সে তখন কাঁদছিল।

 

“এই তো…আমাকে আমার মতো যেতে দাও…”

 

সে বসে পড়ল। কারণ সে ভয় পেয়েছিল। তারপর সে আবার বলল, “তুমি জানো আমার ফুলের কথা। আমি তার কাছে দায়বদ্ধ। সে খুব দূর্বল। সে খুব সহজ সরল। তার মাত্র চারটি কাঁটা আছে যেগুলি তাকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে কোন কাজেরই না।”

 

আমি আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। তাই বসে পড়লাম।

 

“এই তো…এই সব কিছু।”

 

সে তখন দ্বিধাদন্দ্বে ভুগছিল। তারপর সে দাঁড়াল। এক পা বাড়াল। আমি নড়তে পারছিলাম না।

 

তার পায়ের গোড়ালির কাছে হলুদ আলো ঝলসে উঠল। সে নিস্পন্দ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। সে কোন চিৎকার করল না। শান্তভাবে গাছ যেমন পড়ে ঠিক তেমনি পড়ে গেল। বালির জন্য কোন শব্দও হল না।

 

অধ্যায় –সাতাশ

বর্ননাকারীর পরের চিন্তা।

 

এখন এরপর আরো ছয় বছর চলে গেছে।

 

আমি এই গল্প বলিনি কাউকে। আমার পরিচিতরা আমাকে জীবিত ফিরতে দেখেই খুশি ছিল। আমি দুঃখিত ছিলাম। কিন্তু তাদের বললাম আমি ক্লান্ত।

এখন আমার দুঃখবোধ কমেছে কিছুটা। পুরোপুরি না অবশ্যই । কিন্তু আমি জানি সে তার গ্রহে ফিরে গিয়েছিল কারন ভোরে তার দেহ আমি দেখতে পাই নি। এটা খুব ভারী শরীর ছিল না। এবং রাতে আমি তারাদের শুনতে পছন্দ করি। এগুলি যেন পাঁচ শত মিলিয়ন ছোট ছোট ঘন্টা।

কিন্তু এখানে একটা বিষয় অসাধারন। যখন আমি ছোট রাজপুত্রের ভেড়ার জন্য মুখবন্ধ একেছিলাম তখন চামড়ায় হুক দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। সে কখনো তাই এটি তার ভেড়ার মুখে বাঁধতে পারবে না। তাই আমি এখন ভাবি তার গ্রহে কী হচ্ছে? ভেড়াটা মনে হয় তার ফুলটাকে খেয়ে ফেলেছে।

কিন্তু এক সময় আমি নিজেকে বলি, অবশ্যই না। ছোট রাজপুত্র প্রতি রাতে তার ফুলটিকে গ্লাস গ্লোবে দিয়ে ঢেকে রাখে। এবং সে তার ভেড়াকে সতর্কভাবে পাহাড়া দেয়। এই চিন্তায় আমার মন খুশি হয়ে উঠে। সকল তারকায় ছড়িয়ে পড়ে নির্মল হাসি।

কিন্তু অন্য সময় আমি ভাবি, কেউ হঠাৎ বেখেয়াল হয়ে যেতে পারে। এটা স্বাভাবিক। ছোট রাজপুত্র যদি কোন রাতে তার ফুলকে গ্লাস গ্লোব দিয়ে ঢাকতে ভুলে যায় এবং তার ভেড়া যদি কোন শব্দ না করে রাতে বেড়িয়ে পড়ে। তখন সব তারকাগুলি আমার জন্য হয়ে উঠে কান্নায় পরিপূর্ণ।

 

এটা আসলে একটা বড় রহস্য। আমার জন্য এবং তোমার জন্য যে রাজপুত্রকে ভালবাসো। এই মহাবিশ্বের কোন কিছু এর মত রহস্যপূর্ণ না-  আমরা জানিনা যে ভেড়াটিকে আমরা দেখিনি তা ফুলটাকে খেয়েছে কি না!

 

আকাশের দিকে তাকাও। নিজেকে জিজ্ঞেস করোঃ খেয়েছে কি না? ভেড়াটি ফুলটিকে খেয়েছে কি না? তুমি দেখতে পাবে কীভাবে সবকিছু পরিবর্তিত হয়।

এবং কোন বড় ব্যক্তি কখনোই বুঝতে পারবে না এটি কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

 

আমার কাছে এই ছবিটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এবং সবচেয়ে দুঃখের ছবি। এটা শুরুর পৃষ্ঠার মতই। কিন্তু আমি আবার আঁকলাম তোমার স্মৃতিতে আবার তুলে দেয়ার জন্য। এইখান সেই জায়গা যেখানে প্রথম ছোট রাজপুত্র পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিল এবং এখান থেকেই সে অদৃশ্য হয়ে যায়।

 

এটা ভালোভাবে দেখে রাখো যাতে কোনদিন আফ্রিকান মরুভূমি ভ্রমণ করলে তুমি জায়গাটা চিনতে পারো। যদি তুমি এই জায়গায় আসো তাহলে দয়া করে তাড়াহুড়া করো না। কিছু সময়ের জন্য অপেক্ষা করো, ঠিক তারকাটির নিচে। তারপর যদি কোন ছোট্ট মানুষ আবির্ভূত হয় যে হাসে, যার সোনালী চুল,  এবং যে প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় না তাহলে তুমি চিনে নেবে সে আসলে কে। এটা যদি কখনো ঘটে তাহলে দয়া করে আমাকে স্বান্তনা দিও। আমাকে জানিও যে সে ফিরে এসেছে।

 

 

  • সমাপ্ত-

 

1 thought on “দ্য লিটল প্রিন্স – সম্পূর্ন উপন্যাস বাংলা অনুবাদ”

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং