আমাদের প্রভাব বিদ্বেষ এর কারণ কী?

আকবর আলি খান

ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ

ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ মানে বুঝাচ্ছি ব্যক্তি হিসেবে নিজের আলাদত্ব নিয়ে অবস্থান। এর নানা ভালো এবং মন্দ দিক আছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ যখন জঘন্য পর্যায়ে পৌছে যায় তখন তা ক্ষতিকর হয়ে উঠে। তখন ইগোসর্বস্ব ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতাই মানুষকে চালিত করতে থাকে।

 

আমাদের প্রচলিত প্রভাব বিদ্বেষ

আমাদের এখানে একটা জিনিস খেয়াল করা যায়, যারাই একটু লেখালেখি করেন বা বুদ্ধিচর্চা করেন, তাদের প্রায় সবাই-ই একটা ধারণা প্রচার করতে চান যে কারো দ্বারা প্রভাবিত হলে চলবে না। অন্য কোন বই বা চিন্তক; এবং কোনক্রমেই দেশী এবং সমসাময়িক কালে জীবিত দেশী কোন লেখকের বা চিন্তকের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যাবে না। তাদের নাম নেয়া যাবে না। এই মত তারা প্রচার করেন বিভিন্নভাবে। কখনো সরাসরি, কখনো পরোক্ষভাবে। তাদের চিন্তা প্রক্রিয়ার মূল একটি স্তম্ভই হলো এই ধারণা। এবং তরুণ যারা এ লাইনে আসেন তারাও এমন ধারনার খপ্পরে পড়েন। স্পষ্ঠত, এ ধরনের চিন্তা জ্ঞান বিরোধী।

বিভিন্ন চিন্তকেরা অন্য লেখক বা চিন্তকের নামোল্লেখ করে কোন আইডিয়া যখন নিজের লেখায় বা বক্তব্যে আনেন,  তখন প্রথমত তিনি ঐ লেখকের প্রতি ঋণ স্বীকার করেন। দ্বিতীয়ত, এখানে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে সৎ থাকেন কারণ আইডিয়াটি তিনি ঐ চিন্তকের কাছ থেকেই পেয়েছেন। তৃতীয়ত, তিনি এরপরে যখন তার ব্যাখ্যা বা মত উপস্থাপন করেন তখন পাঠক যারা আছেন তারা ইচ্ছে করলেই তিনি যে চিন্তকের উদ্ধৃতি/আইডিয়া ব্যবহার করেছেন তার লেখাটি বের করে পড়তে পারবেন, আরো পরিস্কার হবার জন্য বা  কোন ভিন্ন মত নির্মানের জন্য।

একাডেমিক গবেষনা প্রবন্ধ যেসব লেখা হয় তাতে একে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। এই চর্চা ব্যতিত কারো গবেষণা প্রবন্ধ গৃহীত হবে না ভালো এমনকী নিম্নমানের কোন জার্নালে। একাডেমিক ক্ষেত্রে অন্যের আইডিয়া নাম উল্লেখ না করে, সূত্র উল্লেখ না করে লিখে দেয়াকে গর্হিত অপরাধ বলে ধরা হয়।

প্রভাবে দোষ নাই

যুগে যুগে চিন্তকের অন্য চিন্তকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। জ্ঞানচর্চার একটা স্রোত আছে, একটা নদীর মত। সেখানে সারা পৃথিবীর মানব জাতির চিন্তকদের চিন্তা বহমান। পৃথিবীর সব মানুষের অধিকার আছে এখান থেকে অকাতরে গ্রহণ করার। মানব সভ্যতা এগিয়েছে কারণ মানুষ তার পূর্বপুরুষের অর্জিত জ্ঞানের উপর ভর করে দাঁড়াতে শিখেছে।

তাই প্রভাব থাকবে। সমসাময়িক বা পুরানাকালের লেখক চিন্তকদের প্রভাবে কোন বুদ্ধিমান চিন্তকের হীনম্মন্যতার বোধে আক্রান্ত হবার কিছু নেই।

আইজাক নিউটন বলেছিলেন, আমি যদি বেশী কিছু দেখে থাকি তার কারন হলো আমি মহানদের কাঁধে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম।

অর্থাৎ, তিনি বুঝিয়েছে মহান জ্ঞানীদের অর্জিত জ্ঞানের উপর ভর করেই তিনি তার জ্ঞানচর্চা চালিয়েছেন, এটাই তাকে সাধারনের চাইতে বেশী কিছু দেখতে সাহায্য করেছে।

 

চার্লি মাঙ্গারের উপদেশ

ওয়ারেন বাফেটের বন্ধু ও পার্টনার চার্লি মাঙ্গার। তিনি বিলিনিয়ার, তা এরকম আরো অনেক বিলিনিয়ার আছেন; তাই এটা বিষয় না। বিষয় হচ্ছে তার অসাধারন প্রজ্ঞা এবং নিজের অর্জিত জ্ঞান অন্যকে শেখানোর প্রবণতা। ওয়ারেন বাফেটের মধ্যেও একই জিনিস রয়েছে।

চার্লি মাঙ্গার বিভিন্ন লেকচার দিয়েছেন কীভাবে ভালো জীবন যাপন করা যায়, কীভাবে সফল হওয়া যায়, ভালো সিদ্ধান্ত নেয়া যায় ইত্যাদি বিষয়ে। তার উপদেশগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ন একটি হলোঃ

“অন্য লোকেরা যেসব সবচেয়ে সেরা জিনিস বের করে ফেলেছেন সেগুলি আয়ত্ত্ব করে নেয়ার পন্থায় আমি বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি না বসে থাকা আর নিজে নিজে চিন্তা করে সব বের করে ফেলার পন্থায়, কেউই অত বুদ্ধিমান না।”

ম্যাকায়াভেলী তার প্রিন্স বইতে ইতালির রাজার উদ্দেশ্যে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তাতেও এরকম কথা ছিলেন। তিনি রাজাকে বলেছিলেন অন্য সব মহান রাজারা যে পথে গিয়ে সফল হয়েছেন, সেই পথ অনুসরন করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

 

আমরা এত জঘন্য ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রীক কেন?

কারো দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যাবে না, নিজে নিজে মৌলিক চিন্তা করতে হবে এইরকম পন করে থাকা; এই ধরনের ধারণা বোকামি ও জঘন্য ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রীক। কারণ মানব সভ্যতার এই তিন-পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে প্রায় সব চিন্তাই করা হয়ে গেছে।  নতুন চিন্তা মানে একেবারে নিজের আশ্চর্য মস্তক গোলক দ্বারা চিন্তা বানানো নয়। মৌলিক চিন্তা অসম্ভব, কারণ শিশু বড় হতে হতে নানা কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফ্রেঞ্চ লেখক আন্দ্রে জিদ এর কথায়, “যা বলা দরকার তা আগেই বলা হয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু কেউ শুনছিল না, তাই আবার বলা দরকার।” তার আকাঙ্খাগুলিও অন্যের অনুকরনে তৈরী হয়। এমতাবস্তায় প্রভাব বিদ্বেষ জঘন্য বোকামি। অন্যের চিন্তার উপর ভর করেও নিজের চিন্তা করা যায়, নতুন আঙ্গিকে দেখা যায়।

আকবর আলি খান
ছবিঃ আজব ও জবর আজব অর্থনীতি বইয়ে গ্রামের গঠন ও আমাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন আকবর আলি খান।

আমাদের দেশে গ্রামগুলি হয় উন্মুক্ত। অন্য দেশে গ্রাম হয় চারদিক দিয়ে আবদ্ধ ও সংযুক্ত। তাদের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিবিড় যোগাযোগ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রাম এমন নয়। বাংলাদেশের গ্রামদের উন্মুক্ত গ্রাম আখ্যা দিয়েছেন বুদ্ধিজীবি ও অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান তার বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা গ্রন্থে।

তিনি বলেছেন, গ্রামের এই ধরনের উন্মুক্ত অবস্থার কারণেই গ্রামে সংঘটনগুলি প্রবল হতে পারে নি। এসব অঞ্চলের মানুষ প্রবল ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী হয়ে উঠেছে। গ্রামের এই প্রবল ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রবাদের ভালো ও খারাপ দিক আছে। খারাপ দিকের একটি হলো আমাদের দেশের ঐক্যের অভাব। বাংলাদেশকে মুঘল আমলে ডাকা হত বিদ্রোহনগরী। আলাদা আলাদা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল বাঙলা মুসলমান সুলতানদের শাসনের আগ পর্যন্ত। ১৯৯৯-২০০১ সালের এক জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক পুজি অর্থাৎ পারস্পারিক বিশ্বাস বা আস্থার হার মাত্র ২৩.৫ ভাগ। অর্থাৎ একশো জনের মধ্যে পচাত্তর জনের উপরে লোক এঁকে অপরকে বিশ্বাস করে না। প্রবল ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রের এই এক মারাত্মক খারাপ দিক। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এই পারস্পারিক আস্থার পরিমাণ বেশী। এটাই তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা’র মতো বিশ্লেষকের কাছে।

উন্মুক্ত গ্রামগুলির উদ্ভব আমাদের প্রবল ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রের কথা ঘোষনা করে অথবা এমন গ্রামব্যবস্থায় থাকতে থাকতে এদেশের মানুষের চরিত্র ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রীক হয়ে উঠেছে। এবং এরই প্রভাব হচ্ছে, আমাদের সবক্ষেত্রে ইউনিক হয়ে উঠার ভ্রান্ত চেষ্টা, এবং সকল প্রভাব বিদ্বেষ। যেন কুয়াতে থাকা একলা ব্যঙ, রচনা করতে চায় আপন সঙ্গীত।

গ্রাম
ফেইসবুকের ভাইরাল এই ছবিটি সিম্বলিক ভাবে উপস্থাপন করতে পারে বিষয়টাকে।

গ্রামের গঠন বিষয়ক ভাবনা

আকবর আলী খান যে উন্মোক্ত গ্রামের কথা বলেছেন তার সম্পর্কে আরেকটু আলোচনা করা যায় ইতিহাস থেকে। গ্রামের গঠনের ক্ষেত্রে আরেকটি ধারণা পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলাদেশের কৃষক প্রবন্ধে। বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের জানান চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে জমিদারের ইচ্ছা অনুযায়ী কৃষক জমি পেত অথবা জমি থেকে উঠে যেত।

ভূমিতে অধিকাংশ কৃষকেরই অধিকার অস্থায়ী; জমীদার ইচ্ছা করিলেই তাহাদের উঠাইতে পারেন। দখলের অধিকার অনেক স্থানেই অদ্যাপি আকাশকুসুম মাত্র। যেখানে আইন অনুসারে প্রজার অধিকার আছে, সেখানে কার্য্যে নাই। অধিকা থাক্ বা না থাক্, জমীদার উঠিতে বলিলেই উঠিতে হয়। কয়জন প্রজা জমীদারের সঙ্গে বিবাদ করিয়া ভিটায় থাকিতে পারে? সুতরাং যে বেশী খাজানা স্বীকৃত হইবে, তাহাকেই জমীদার বসাইবেন। পূর্ব্বেই কথিত হইয়াছে, লোকসংখ্যা বৃদ্ধি হইতেছে। তাহার বিশেষ কোন প্রমাণ নাই বটে, কিন্তু ইহা অনুভবের দ্বারা সিদ্ধ। প্রজাবৃদ্ধি হইলেই জমীর খাজানা বাড়িবে। যে ভূমির আগে এক জন প্রার্থী ছিল, প্রজাবৃদ্ধি হইলে তাহার জন্য দুই জন প্রার্থী দাঁড়াইবে। যে বেশী খাজানা দিবে, জমীদার তাহাকেই জমী দিবেন। রামা কৈবর্ত্তের জমীটুকু ভাল, সে এক টাকা হারে খাজানা দেয়। হসিম শেখ সেই জমী চায়—সে দেড় টাকা হার স্বীকার করিতেছে। জমীদার রামাকে উঠিতে বলিলেন। রামার হয় ত দখলের অধিকার নাই, সে অমনি উঠিল। নয় ত অধিকার আছে, কিন্তু কি করে? কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করিয়া জলে বাস করিবে কি প্রকারে? অধিকার বিস‍‍র্জ্জন দিয়া সেও উঠিল। জমীদার বিঘা পিছু আট আনা বেশী পাইলেন।

এইরূপে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর কোন সময়ে না কোন সময়ে, কোন সুযোগে না কোন সুযোগে, দেশের অধিকাংশ ভূমির হার বৃদ্ধি হইয়াছে। আইন আদালতের আবশ্যক করে নাই—বাজারে যেরূপ গ্রাহকবৃদ্ধি হইলে ঝিঙ্গা পটলের দর বাড়ে, প্রজাবৃদ্ধিতে সেইরূপ জমীর হার বাড়িয়াছে। সেই বৃদ্ধি, জমীদারের উদরেই গিয়াছে।

– বঙ্গদেশের কৃষক, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

এক্ষেত্রে যেসব গ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে গ্রামের ভিতরেই লোকদের মধ্যে খুব একটা সদ্ভাব থাকার কথা না। যেহেতু তারা পরস্পর অপরিচিত। এবং এই কারণে তাদের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক চিন্তা-ঈর্ষা তৈরী হওয়া স্বাভাবিক।

আরেক ধরনের গ্রামের কথা ভাবা যেতে পারে, যেখানে কোন গোষ্ঠীর বা কয়েকটা গোষ্ঠীর লোক একসাথে গিয়ে বাসস্থান তৈরী করেছিলেন। সেসব গ্রাম পাড়ায় পাড়ায় ভাগ থাকত, এবং তাদের মধ্যে গোষ্ঠী ভিত্তিক আলাদত্ব ছিল।

আমাদের গ্রামের এই গঠন আমাদের লোকদের মনস্তত্ত্বকে করেছে ঈর্ষাপরায়ণ, পরশ্রীকাতর ও ইগো সর্বস্ব ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী।

 

উপসংহারঃ

সৃষ্টিশীলতার জন্য ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রীক চিন্তা ভালো, সব শিল্পীই চান নিজের মত কিছু তৈরী করতে কিন্তু তা যখন একেবারে জঘন্য পর্যায়ে পৌছে যায় তখন শিল্পী নিজে তৈরী করার মত কিছুই পাবেন না। আর সৃষ্টিশীল লেখকও নানা জায়গা থেকে অনুপ্রেরণা ও আইডিয়া নিতে থাকেন। এগুলি তার লেখায় জায়গা করে নেয় চেতনে বা অবচেতনে। সুতরাং প্রভাবে এবং তা স্বীকারে কোন দোষ নেই।