মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » জীবনের জন্য উপদেশমালা

জীবনের জন্য উপদেশমালা

উপদেশ কী? মনে হয় এক ধরণের সাজেশন। পরামর্শ। এমন না যে, এটা আমি বলছি, তাই করতেই হবে। এমন হলে তা হইত আদেশ।

কিন্তু উপদেশ কী ইনসাইট? মানে নতুন একটা আইডিয়া দেয় বা দেখার ভিউ দেয় বা কোন কাজরে সহজভাবে-ভিন্নভাবে করার উপায় দেখায়। উপদেশের মধ্যে ইনসাইট থাকতে পারে।

আবার উপদেশ যিনি দিচ্ছেন, তিনিই কি বানাইছেন? এমন তো না সব সময়। যেমন সদা সত্য কথা বলবে, এই উপদেশ ধরা যাক। এটা তো কেউ বানান নাই, চলতেছে।

এবং উপদেশের কি এমন কোন বাধ্যবাধকতা আছে যে, যিনি দিচ্ছেন তার ঐটা আগে মানতে হবে? অবস্থাভেদে, এথিক্যাল জায়গায় এটা হতে পারে।

এক অফিসে বড় অফিসার নিজে ঘুষ খান এবং অন্যদের ঘুষ খাবেন না এই উপদেশ দিলে, তার এই উপদেশ দেয়াটা কি আন এথিক্যাল হয়?

এইখানেও এক অবস্থা বিবেচনার বিষয় আছে বলে আমার মনে হয়।

ওই বড় অফিসার যে “ঘুষ খাবেন না” উপদেশ দেন, আলাদাভাবে এটা কিন্তু তার আন এথিক্যাল কাজ না। তিনি যে ঘুষ খান, এটা তার খারাপ কাজ। এবং তিনি যখন “ঘুষ খাবেন না” বলেন তার কর্মচারীদের, এর উদ্দেশ্য যদি হয় তার ঘুষ খাওয়া লুকানো, এবং যাতে তিনি আরও বেশি ঘুষ খাইতে পারেন তখন তার উপদেশ দেয়াটা আন এথিক্যাল হয়। একই ব্যক্তি তার ছেলেরে যদি ছেলের নৈতিক ক্যারেক্টার ঠিক রাখতে “ঘুষ খাইবা না” বলেন, তখন তার উপদেশ দেয়াটা অনৈতিক হয় না। কিন্তু এর মধ্যে নিজের ঘুষ খাওয়া লুকানো বা ঘুষ খাওয়া ক্যারেক্টারকে নৈতিক ভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা হলে, উপদেশ দেয়াটি অনৈতিক হয়।

পরামর্শ বিচারের এক নিয়ম হচ্ছে, দেখা যে যিনি দিচ্ছেন তার স্কিন আছে কি না ঐখানে, এটাও দেখা তার স্বার্থ কী। শুনতে স্থূল মনে হইলেও কাজের।

কোন এক ধান্দাবাজ কোম্পানিতে আপনারে কেউ ইনভেস্ট করতে বলল। আপনার দেখতে হবে সে ঐখানে ইনভেস্ট করছে কি না, বা সে ওই কোম্পানির মালিকের ছোট ভাই কি না।

উপদেশ নিয়া এই সামান্য ভূমিকার পরে উপদেশ দেয়া শুরু করি। এর একটা বা কয়েকটা কারো কাজে লাগলেই এর স্বার্থকতা।

কোন উপদেশ সরাসরি ব্যক্তি আপনার অবস্থা বিবেচনা করে দেয়া না হলে, সেটা আক্ষরিক অর্থে মেনে চলা বা গ্রহণের আগে চিন্তা ভাবনা করুন। 

আক্ষরিকের চাইতে,  উপদেশটির ফিলোসফি কী তা বুঝার চেষ্টা করুন। 

একই উপদেশ কারো জন্য ভালো এবং কারো জন্য খারাপ হতে পারে। কারো জন্য এর উলটা জিনিশ প্রয়োজনীয় হতে পারে। 

সব উপদেশ সবার সামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হতে পারে। 

আপনার জন্য সেরা উপদেশ অবশ্যই ব্যক্তিগত হবে। অর্থাৎ যিনি আপনাকে জানেন, আপনার অবস্থা, পরিস্থিতি জানেন ও আপনাকে ভালোবাসেন, তার কাছ থেকেই আসবে। 

কখনো ছোট, অদরকারী দোষ ত্রুটি খুঁজে বেড়াবেন না। এতে লাইফ অসুখী হবে, এবং লাইফের হতাশা প্রকাশ পায়। 

লেখেন, আঁকেন, মিউজিক করেন। প্রকাশ করেন। সৃষ্টিশীলতা দরকারী। পারফেকশনের আশায় বসে থাকবেন না। সব কিছুর ৯০% গার্বেজ হয়। 

কোন জিনিশ আপনার ক্ষতি করছে বুঝতে পারেন যদি, এবং একে পুরোপুরি ছাড়তে না পারেন, তাহলে লিমিট করুন। যতটুকু পারেন ততটুকু দূরে থাকুন। ছোট ইম্প্রুভমেন্ট, ইম্প্রুভমেন্টই। 

সবাই দেখছে তাই ইচ্ছা না হলেও কোন টিভি সিরিজ বা মুভি দেখবেন না, বই পড়বেন না। 

জ্ঞানের বড় আইডিয়া সম্পর্কে জানতে থাকুন।

হাঁটুন। 

দিনে অন্তত ৩০ টি পুশ আপ দেবার অভ্যাস করুন। 

এক্সারসাইজ করতে যদি মজা না লাগে তাহলে করবেন না, তা উপকারী বা যাই হোক না কেন। 

কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনুন। 

আপনে যেভাবে আপনার ঘন্টা, দিন ব্যয় করেন, সেভাবেই আপনার জীবন ব্যয় করেন। মনে রাখুন। 

নির্ভরযোগ্য মানুষ হয়ে উঠুন। 

অনেক জিনিশে, আপনার কোন দোষ না থাকলেও সেই ব্যাপারে দায়িত্ব থাকতে পারে। 

আপনি যদি আপনার মা বাবার খারাপ ব্যবহার, চাইল্ডহুড ট্রমা বা এরকম অন্য কোন দুর্দশা দিয়ে নিজেকে পরিচিত (আইডেন্টিফাই)  করেন, তাহলে একে চিরস্থায়ী করে ফেললেন। 

অধিকাংশ উপদেশ হচ্ছে নতুন কিছু বলা না, মানুষ যা জানে কিন্তু ভুলে গেছে তা মনে করিয়ে দেয়া। 

দুনিয়াতে হিরো আলম ও তার রুচির মানুষ থাকবে। তাদের অধিকার। 

আপনি যা উপভোগ করেন, ভাবুন কেন উপভোগ করেন। 

আপনার পার্টনার সম্পর্কে অনলাইনে বা সহকর্মীর কাছে  অভিযোগ করবেন না। এতে লাভ নেই, কিন্তু ক্ষতি বেশি। 

রিলেশনশিপে কেউ আপনার জন্য ভুল মানুষ হতে পারে, সে ব্যক্তিগত ভাবে খারাপ না হয়েও। 

মানুষের সাথে ডিলিং তার সাথে থাকা সাইকোলজিক্যাল ব্যাগেজের সাথেও ডিলিং। 

আপনার মা বাপের কথা মনে হলে তাদের কল দিন। প্রিয় বন্ধুদের কথা মনে হলে তাদের জানান। 

ভালো দেখলে, মানুষকে প্রশংসা করুন। 

মনে রাখবেন অনেক মানুষ তাদের সমস্যা নিয়ে সাফার করছে, যা বাইরে থেকে দেখা যায় না। 

মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র হওয়া সহজ না। আপনার ইগো বাঁধা দিবে। দয়ালু বা কাইন্ড হতে সচেতন চেষ্টা জরুরী। 

লাইফস্টাইলে সবচাইতে বড় যে পজিটিভ পরিবর্তন আনতে পারেন, তা হল এক্সারসাইজ। 

ওয়েট লিফটিং করুন, এটি মাসল ম্যাস কেবল বাড়ায় না, স্কেলেটাল স্ট্র্যাকচারও ইম্প্রুভ করে। 

যে অভ্যাস করতে চান এটি করার প্রক্রিয়া যতটা পারা যায় সহজ করুন। বাঁধা কমান। যে অভ্যাস ছাড়তে চান, সেটি করার প্রক্রিয়া যতটা পারা যায় জটিল করুন। বাঁধা বাড়ান। 

মানুষের ভালো মুড, ভালো থাকা সিম্পল জিনিশের উপর নির্ভর করে। যেমন, খাওয়া, এক্সারসাইজ, গোসল, আলো, প্রাকৃতিক পরিবেশ। এগুলি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখুন কোনটাতে আপনার ভালো লাগে। 

কোন কিছুকে ডিভ্যালু এবং ডিসমিস করে দেবেন না। ফালতু বলে খারিজ করে দেয়া থেকে বিরত থাকুন। কারো লেখা, গান বা আর্ট আপনার ফালতু লাগলে মনে রাখবেন, হয়ত এটি তার ফালতু ৯০% এর মধ্যে পড়ে, ভালো ১০% হয়ত আপনি দেখেন নি। 

যেসব কাজ ভালো লাগে কেবল সেসব নিয়েই সময় কাটাবেন না। প্রতীকী শিল্প, ধর্মতত্ত্ব ও ইতিহাস, মিউজিক, লিটারেচার এগুলি স্টাডি করুন। এগুলি আপনাকে রাজনৈতিক ও ইন্টেলেকচুয়াল আলাপের ভিন্ন পয়েন্ট অব ভিউ দেখাবে। 

কোন কিছুর “দাম” জিনিশটা কী তা বুঝার চেষ্টা করুন। 

কারো কথা শোনার সময় কী উত্তর দিবেন তা ভাবতে বসবেন না। তার কথা শুনুন, এরপর দরকার হলে উত্তর দিন। 

বাটপারি করবেন না। কারণ এতে নিজের কাছে বাটপার হিসেবে পরিচিত হবেন। 

আপনার কোন লক্ষ্য যদি প্রতিদিন নিয়ম করে নিজেকে স্মরণ করান, তাহলে ব্রেইন এ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে, এবং এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর নানা উপায় নিয়ে কাজ করতে থাকবে, এবং সুযোগ বের করে নিবে বা সামনে আসলে ধরতে পারবে। এফারমেশন এভাবে কাজ করে। একে সেলফ সিগন্যালিংও বলতে পারেন। সম্ভবত প্রার্থনা/দোয়াও একইভাবে কাজ করে। 

গ্রেট ম্যাজিশিয়ান হতে হলে গ্রেট ম্যাজিশিয়ান খুঁজে বের করুন ও তাদের কাছ থেকে ম্যাজিক শিখে নিন। 

অন্তত একটা বাদ্যযন্ত্র বাজান। প্রফেশনাল লেভেলে শিখতে হবে না, বাজান। 

কাউকে কোন বিষয়ে ব্যক্তিগত উপদেশ দেবার আগে তার অবস্থা বুঝুন। যেমন, কেউ একজন লোনলিনেসে ভুগছে, এই সমস্যা নিয়ে উপদেশ চাইল। এখানে আপনাকে বুঝতে হবে তার লোনলিনেস কী প্রকারের। নার্সিসাসের লোনলিনেস ছিল, মেডুসার ছিল, প্রমিথিউসের ছিল, ক্যাসান্দ্রার ছিল, পেনেলোপির ছিল, এটলাসের ছিল, সিসিফাসের ছিল, বেহুলার ছিল, ধৃতরাষ্ট্র–গান্ধারী-কর্ণ-দ্রোণের ছিল। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের লোনলিনেসের প্রকৃতি, কার্যকারণ ভিন্ন। 

প্রাচীন মিথলোজি স্টাডি করুন। 

মাথায় রাখুন অনেক অনেক জিনিশ সম্পর্কে আপনি অনেক কিছুই জানেন না। 

যেসব জিনিশে আপনি অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন, যেমন ম্যাট্রেস, চেয়ার ইত্যাদি, এগুলিতে ইনভেস্ট করুন। হয়ত আপনার দামী হাতঘড়ির মত, এগুলি দেখাতে পারবেন না মানুষকে, কিন্তু এইসব জিনিশ ভালো ও আরামদায়ক হলে আপনার জন্য বেটার। 

বেড়া কী জন্য দেয়া হয়েছিল তা নিশ্চিতরূপে না জেনে কখনোই বেড়া তুলে ফেলবেন না। 

নোট টেকিং এপ রেমনোট ব্যবহার করুন। 

কোন কাজে সফল হলে এখানে ভাগ্যের ভূমিকা কীরকম ছিল স্মরণ করুন। এটি ভেতর থেকে বিনয়ী করবে। কোন কাজে অসফল হলে নিজের কোন কোন জায়গায় ভুল ছিল তা বের করুন। এটি ইম্প্রুভমেন্টের জায়গা দেখাবে। 

নিজ-স্বার্থ যেকোন মহাজ্ঞানীকেও অন্ধ করে তুলতে পারে। এই ব্লাইন্ড স্পট সম্পর্কে সচেতন থাকুন। 

যখন চারপাশের মানুষেরা  উন্মাদের মত আচরণ করছে তখন যিনি এভারেজ বুদ্ধির আচরণ করতে পারেন, তিনিই জিনিয়াস। মিলিটারি জিনিয়াসের ক্ষেত্রে নেপোলিয়ন একথা বলেছিলেন। স্মরণে রাখুন। 

কম্পাউন্ডিং/ কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট সম্পর্কে জানুন। 

যারা ছোটগল্প লেখতে চান, তারা গল্প লেখা নিয়ম কানুনের বই পড়বেন না।

জব ইন্টার্ভিউতে কথা বলবেন ইন্টার্ভিউ গ্রহীতার বুদ্ধি ও জানাশোনার মাপে, নিজের মাপে নয়। 

সবাই ভীত হলে আমি গ্রিডি হব, আর সবাই গ্রিডি হলে আমি ভীত হব, এটা বলা সহজ, করা কঠিন। 

আপনি বিগিনার হলে ভুল এড়িয়ে চলার দিকে মনোযোগ দিন, আর এক্সপার্ট হলে গ্রেট মুভ করার দিকে। 

মনে রাখবেন নতুন কোন রাজবংশ পুরান রাজবংশকে সরিয়ে ক্ষমতায় এলে “অতীত” বা ইতিহাসকেও বদলায়। 

আপনার ব্রেইনরে ধরে নিন একটা হাজার দুয়ারি কক্ষ। যতবার আপনি মনে করবেন কোন বিষয়ে আপনি জানেন ততবার একটা করে দরজা বন্ধ হয়। 

লাইফের প্রতি ঘটনারে দেখবেন, ছুঁড়ে দেয়া ছক্কার গুটির মত, ব্যতিক্রম শুধু ছক্কার গুটির ক্ষেত্রে ছয়দিক আছে আপনি জানেন, কিন্তু লাইফের ক্ষেত্রে গুটির কয়দিক আছে তা আপনার অজানা। 

মনে রাখবেন ঘটনা ঘটে যাবার পর সবাই ব্যাখ্যা দিতে পারে, এবং আপনারও মনে হবে আপনি জানেন বা বুঝেন বিষয়টা। কিন্তু ম্যাটার করে, ঘটনা ঘটার আগে বুঝা। 

কোন কাজ/প্রজেক্ট দশদিনে শেষ করতে পারবেন মনে হলে, হিসাবে আরও কয়েকদিন যোগ করুন। কোন কাজে ১০০০ টাকা লাগবে হিশাব বললে, ৫০০ বেশি রাখুন। কোন কাজ ৫০% ভাগ সফল হবে মনে হলে, আশা রাখুন ২৫% সফল হবে। প্ল্যানিং ফ্যালাসি এবং উইশফুল থিংকিং জনিত সমস্যা এড়াতে সাহায্য করবে এটি। 

যা শুনছেন তা সম্ভবত মিথ্যা কারণ মিথ্যা সত্যের চাইতে অনেক দ্রুত দৌড়ায়। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যৎ পার্টনার খুঁজে পাওয়ার ট্র্যাডিশনাল প্রতিষ্ঠান। পার্টনার বলতে সন্তান উৎপাদনের পার্টনার না খালি, ব্যবসার পার্টনার ইত্যাদিও।

শেষ সত্য বলতে কিছু নাই। ভালো ব্যাখ্যা, তার চাইতে ভালো ব্যাখ্যা আছে। 

1 thought on “জীবনের জন্য উপদেশমালা”

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং