মুরাদুল ইসলাম » ভূ-রাজনীতি ও ইতিহাস » জিজেকঃ সৌদি-কানাডার অহেতুক ঝগড়া দেখিয়ে দিচ্ছে নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডার

জিজেকঃ সৌদি-কানাডার অহেতুক ঝগড়া দেখিয়ে দিচ্ছে নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডার

স্যাভোয় জিজেক একজন গুরুত্বপূর্ন দার্শনিক, কালচারাল তাত্ত্বিক। সিনিয়র গবেষক ইন্সটিটিউট অব সোশিওলজি এন্ড ফিলোসফি, ইউনিভার্সিটি অব লিউব্লিয়ানা, স্লোবেনিয়া। গ্লোবাল ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর অব জার্মান, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি। ইন্টারন্যাশনাল ডিরেক্টর অব ব্রিকব্যাক ইন্সটিটিউট ফর দ্য হিউমেনিটিজ, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন। তার এই লেখাটি ১২ আগস্ট ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে RT তে, আগে যা রাশিয়া টুডে নামে পরিচিত ছিল। জিজেকের ইদিওলজি বিষয়ক ধারণা নিয়ে একটি লেখা আছে এই সাইটে।

ছবিঃ স্ল্যাভোয় জিজেক

অনেক বছর ধরেই বিশেষজ্ঞদের ধারনা উদারনৈতিক গণতন্ত্র ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু সিস্টেম এই উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সম্ভাবনাকে খেয়ে ফেলেছে, এর ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি নতুন বিশ্ব লোকরঞ্জনবাদ (বা পপুলিজম)।

কানাডা এবং সৌদির সাম্প্রতিক বিবাদের কারণটি অতি তুচ্ছ। খুবই সামান্য এক গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ নিয়ে গেছে মিলিটারি সংঘর্ষের দ্বারপ্রান্তে।

যা ঘটেছিল তা হলো, সৌদি অবশেষে মহিলাদের গাড়ি চালানোর অধিকার দিয়েছে কিন্তু একই সাথে মহিলাদের গাড়ি চালানোর অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা নারীদের গ্রেফতার করেছে। এইসব গ্রেফতারকৃত নারীদের মধ্যে সামার বাদাউই ছিলেন, যার পরিবার কানাডায়, ফলে ওটোয়া তার মুক্তি চাইল।

এর উত্তরে সৌদি জানাল এই প্রতিবাদ তার দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কানাডার অযাচিত হস্তক্ষেপ, খুবই দ্রুত নিষেধাজ্ঞা জারী করল। এর মধ্যে আছে কানাডার এম্বাসেডরকে বহিঃষ্কার, কানাডা থেকে আসা ও কানাডায় যাওয়া জাতীয় বিমানের সব ফ্লাইট বাতিল, নতুন ব্যবসা ইনভেস্টমেন্ট জব্দ করা, কানাডার থাকা সম্পত্তি বিক্রি, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আসা এবং কানাডায় চিকিৎসা নিতে থাকা নিজ দেশের রোগীদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা।

এর সবই হচ্ছে ঐ প্রিন্সের নির্দেশে, যিনি নিজেকে উপস্থাপন করেন একজন বড় সমাজ সংস্কারকরূপে।

কোন দ্বিধা নেই

 বাস্তবতায় আমরা যা দেখছি তা হলো সৌদি আরব আগে যা ছিল তাই রয়ে গেছে, এটি সত্যিকার অর্থে কোন রাষ্ট্র নয়, একটি মাফিয়া কর্পোরেশন যা একটি পরিবার দ্বারা চালিত। এবং এই দেশ প্রায়ই নিন্দনীয় ভাবে ইয়েমেনের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে, বলা যায় ঐ দেশটিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

তারা যে একইসাথে নারীদের গাড়ি চালনার অধিকার দিচ্ছে আবার এই অধিকারের জন্য যারা আন্দোলন করেছে তাদের জেলে নিচ্ছে, এর মানে হলো তারা স্পষ্টভাবে বলতে চাচ্ছে যে, ছোটখাট পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু তা অবশ্যই আমরা উপর থেকে করব, এবং নিচ থেকে কোন ধরণের প্রতিবাদ সহ্য করা হবে না।

একইভাবে কানাডার সামান্য প্রতিবাদের উত্তরে সৌদি আরব যে এত তীব্র, অবিশ্বাস্য কার্যকলাপের দিকে গেল, তার বার্তাও পরিষ্কারঃ কানাডা বুঝতে পারে নি, তারা ভেবেছে আমরা এখনো বিশ্ব মানবাধিকারের সময়ে বাস করছি।

অবশ্যই মিশর ও রাশা সৌদি আরবকে তার এই কাজে সমর্থন দিয়েছে। এবং বিশ্ব মানবাধিকারের দুই বড় রক্ষাকর্তা হিসেবে যাদের ধরা হয় সেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এই লড়াই থেকে দূরে থাকার নীতি অবলম্বন করে নিশ্চুপ। এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডার বা বিশ্ব ব্যবস্থা আবির্ভূত হচ্ছে, যেটি “ক্ল্যাশ অভ সিভিলাইজেশনের” একমাত্র ব্যতিক্রম, সভ্যতাসমূহের মধ্যে শান্তিপূর্ন সহাবস্থান। (অথবা “জীবনের পথ/ ওয়েইজ অফ লাইফ, এখন এই টার্ম জনপ্রিয়।)

তাই, জোর করে বিয়ে করা এবং হোমোফোবিয়া (অথবা এই ধারণা যে একা একা পাবলিক প্লেইসে যাওয়া মানে রেইপ হওয়ার আমন্ত্রণ) ইত্যাদি যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য দেশে হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিক আছে। যদিও সে দেশটি আবার বিশ্ব বাণিজ্যের সাথে সংযুক্ত।

দ্বি-মুখিতা

এই নতুন ট্রেন্ডে সবার উপরে আছে কিছু রাজনীতিবিদের ইসলাম নিয়ে নতুন জন্মানো সম্মান, এই নেতারাই আবার আগে খ্রিস্টান পশ্চিমের ইসলামিকরণজনিত বিপদের কথা বলে সাবধান করতেন। যেমন এখন তারা এরদোয়ান গত নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় সম্মানের সাথে অভিনন্দিত করেন তাকে। তাদের মত এখন, ইসলামের অথোরিটারিয়ান শাসন তুরস্কের জন্য ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের জন্য না। একই জিনিস ইজরাইলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, ওরা ইহুদি নাগরিকদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে বৈষম্যমূলক আইন করেছে। এটাই সত্য এখন আজকের মাল্টি-কালচারালিজমের কালেঃ বৈশ্বিক মানদণ্ডের কোন কিছু আরোপ করতে গেলেই বলা হচ্ছে তা উপনিবেশবাদী।

নতুন যে বিশ্ব ব্যবস্থা আবির্ভূত হচ্ছে তা আর কখনোই ফুকুইয়ামাইস্ট উদার গণতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা নয়। নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক-ধর্মীয় মতের (জীবন বিধানের) মধ্যে সহাবস্থান, আর অবশ্যই পেছনে রয়েছে স্বচ্ছন্দে চলতে থাকা বৈশ্বিক পুঁজিবাদ।

এখন আমরা আমাদের দেশগুলিতে তীব্র পলিটিকালি কারেক্ট নারীবাদি আইন আরোপ করতে পারি, আবার একইসাথে ইসলামের অন্ধকার দিককে নব্য উপনিবেশবাদী (নিও-কলোনিয়ালিস্ট) উগ্রতা বলে পরিত্যাগ করতে পারি, দ্বিচারিতার দোষে আর দুষ্ট হতে হচ্ছে না আমাদের।

এই পদ্বতির অশ্লীল দিকটি হলো, এটি নিজেকে উপনিবেশবাদ বিরোধীতার যুদ্ধে এক উন্নতি হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবেঃ উদার পশ্চিম তার উদার নীতি আদর্শ আর প্রয়োগ করতে পারবে না অন্যদের উপর, এবং সব জীবন বিধানই দেখা হবে সমান হিসেবে। কোনটা কারোটা থেকে ভালো নয়।

এটা মাথায় রেখেই হয়ত রবার্ট মুগাবে ট্রাম্পের স্লোগানের প্রতি সহমর্মী হয়েই বলেছিলেন, “আমেরিকা প্রথম তোমার জন্য, ঠিক আছে। কিন্তু, জিম্বাবুয়ে প্রথম আমার জন্য। ঠিক তেমনি, ইন্ডিয়া প্রথম বা উত্তর কোরিয়া প্রথম তাদের জন্য।”

ভবিষ্যতে ফেরা

অবশ্যই এভাবে প্রথম গ্লোবাল সাম্রাজ্য বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কাজ করতো। তারা বিভিন্ন ধরণের জাতি-ধর্মীয় গোষ্ঠিকে নিজেদের জীবন বিধান অনুসারে চলতে দিত। ভারতে হিন্দুরা নিরাপদে বিধবাদের আগুনে পুড়াতে পারত। স্থানীয় নিয়ম নীতিগুলি তাদের আধুনিকতাপূর্ব প্রজ্ঞার বিচারে প্রশংসিত হতো বা বর্বর বলে নিন্দিত হতো, কিন্তু তবুও এগুলি সহ্য করা হতো। কারণ যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ন ছিল তা হলো, সব কিছুই সাম্রাজ্যের অর্থনীতির সাথে যুক্ত।

তাই আপনাকে স্বাগতম নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় যেখানে সৌদি আরব উপনিবেশবাদ বিরোধী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছে।

লিবারেলরা আমেরিকা ফার্স্ট স্লোগানের যে সমালোচনা করেন, এখানে তাদের হিপোক্রিসি আছে। সব দেশই তো এই কাজ করছে, নিজের স্বার্থ দেখছে। আর আমেরিকা নিজের স্বার্থ না দেখে, বৈশ্বিক নেতার যে দায়িত্ব পালন করলেও তা নিজের স্বার্থেই করেছে।

আসলে আমেরিকা ফার্স্ট স্লোগানের ভেতরের বার্তাটি আমেরিকার জন্য খারাপঃ যে আমেরিকান শতকের পরিসমাপ্তি হয়েছে। আমেরিকা সবচাইতে শক্তিশালী দেশসমূহের আসন থেকে পদত্যাগ করেছে। ঘটনা হচ্ছে, আমেরিকা যে বৈশ্বিক পুলিশের ভূমিকায় সারা বিশ্বে কাজ করতো, তার গণতান্ত্রিক আদর্শ আরোপ করার জন্য, এর সমালোচনায় মুখর থাকা বাম লিবারেলরা আমেরিকা ফার্স্টের সমালোচনাও করছেন, হিপোক্রিসির পূর্নমাত্রার প্রকাশ ঘটিয়ে।

মুক্ত মানবতার জন্য বৈশ্বিক পুঁজিবাদ একটি আশাব্যঞ্জক স্বপ্নও দেখাতে পারছে না, আদর্শগত স্বপ্নও নয়। ফলে এই “টলারেন্স” নামের নতুন বিষয়টির উদ্ভব। ফুকুইয়ামাইস্ট উদার-গণতান্ত্রিক ইউনিভার্সালিজম ব্যর্থ হয়েছে তার ভেতরের সীমাবদ্বতার জন্য, অসংগতির জন্য। পপুলিজম বা লোকরঞ্জনবাদ হচ্ছে এই ব্যর্থতার লক্ষণ। এটাই হন্টিংটনের রোগ, যেমন এটাই ছিল।

কিন্তু সমাধান কখনোই পপুলিস্ট জাতীয়তাবাদ নয়, এটা বাম বা ডান যে পন্থারই হোক না কেন। এর পরিবর্তে একমাত্র সমাধান হলো, এক নতুন ইউনিভার্সালিজম – যা মানবতা এখন যে সমস্যাগুলির সম্মুখীন- পরিবেশগত হুমকি থেকে শুরু করে অভিবাসী সমস্যা – তার মোকাবেলা করবে।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং