মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » কারভাজিওর ম্যাথিউ, অবন ঠাকুর ও শিল্পশাস্ত্রের নিয়ম ভাঙ্গা বিষয়ে

কারভাজিওর ম্যাথিউ, অবন ঠাকুর ও শিল্পশাস্ত্রের নিয়ম ভাঙ্গা বিষয়ে

ইতালিয়ান বারোক পিরিয়ডের একজন মাস্টার চিত্রকর ছিলেন কারভাজিও। রোমের একটি গীর্জার জন্য একবার তাকে ছবি আঁকার দায়িত্ব দেয়া হয়। আঁকতে হবে গসপেল লেখা অবস্থায় সেইন্ট ম্যাথিউকে, এবং দেখাতে হবে একজন দেবদূত বা এঞ্জেলকে।

প্রতিভাবান শিল্পী কারভাজিও ছবিটি কীরকম হবে তা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। প্রকৃত বড় শিল্পীরা পবিত্র গ্রন্থের গল্পসমূহ মনযোগের সাথে পড়তেন এবং তারা আগে যত ছবি দেখেছেন তার সব ভুলে সম্পূর্ন নতুন ভাবে কাহিনীগুলিকে দেখতে চেয়েছেন অনেক সময়। অসাধারণ কল্পণাশক্তির অধিকারী কারভাজিওর সেইন্ট ম্যাথিউর গল্পটি নিয়ে ভাবলেন।

একজন বয়স্ক, শ্রমজীবি, দরিদ্র, সাধারণ পুবলিসিয়ান লোক হঠাৎ করেই একটি পুস্তক লিখতে বসেছে। তাকে নির্দেশ দিচ্ছে একজন দেবদূত। তখন লোকটির মুখের অবস্থা কেমন হবে। কীভাবেই বা দেবদূত তাকে দিয়ে লেখাবে।

এসব ভেবে তিনি নিচের ছবিটির মত সেইন্ট ম্যাথিউ এর গসপেল লেখার কাহিনীর ছবি আঁকেনঃ

সেইন্ট ম্যাথিউ এন্ড দ্য এঞ্জেল (১৬০২)

টাক মাথা, খালি পা, ধূষর মলিন পোষাক পরিহিত একজন লোক, সেইন্ট ম্যাথিউ। লিখছেন গসপেল, তাকে হাত ধরে সাহায্য করে যাচ্ছে স্বয়ং ঈশ্বর প্রেরিত স্বর্গালোকের বাসিন্দা। ম্যাথিউ লেখায় অনভ্যস্ত, তার এই অনভ্যস্ততার ছাপ ফুটে উঠেছে মুখে, কপালে সৃষ্টি হয়েছে ভাঁজ।

অসাধারণ এই ছবিটি আঁকার পর কারভাজিও জমা দিলেন গীর্জার বেদীতে ঝুলানোর জন্য। কিন্তু দর্শকদের ছবিটি মনঃপুত হলো না। তাদের অভিযোগ এখানে সেইন্ট ম্যাথিউ এর প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হয় নি।

ছবিটি শিল্পীকে ফেরত দেয়া হলো। কারভাজিও আবার আঁকলেন। এবার প্রথাগত পথেই হাঁটলেন তিনি। সাধারণ দেবদূত ও সেইন্ট ম্যাথিউ দেখতে যেমন, সেরকমভাবে এঁকে দিলেন। ছবিটি গীর্জার জন্য গৃহীত হয়। এটিও দারুণ ছবি, কিন্তু প্রথমটির মত সৎ সৌন্দর্য এতে নেই।

দ্য ইন্সপিরেশন অব সেইন্ট ম্যাথিউ (১৬০২)

কারভাজিওর এই ঘটনা, দুইটি ছবি আমাদের দেখায় যে শিল্পের বা শিল্পীর স্বাধীনতা কত দরকারী একটি বিষয়। ধরাবাঁধা নিয়ম শিল্প সৌন্দর্যের হানি ঘটায়। আবার এটাও অনেকে বলবেন নিয়ম নীতির দরকার আছে শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রেও, অন্যথায় বিশৃঙ্খলা হবে, যা ঢেকে আনবে অসুন্দর। ফলে আমরা একটি সমস্যা পাই, শিল্পে নিয়ম মানা ও নিয়ম ভাঙ্গা’র ব্যাপারে আমাদের অবস্থান কী হবে।

ছবি আঁকার ব্যাপারে বলা হলেও অন্যসব শিল্প সৃষ্টি যেমন গল্প কবিতা উপন্যাস ইত্যাদির ক্ষেত্রেও একই সমস্যা বিদ্যমান। বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দ দিয়ে কবিতা হবে নাকী ছন্দ ছাড়া কবিতা হবে, এ নিয়ে দ্বন্দ্ব পর্যন্ত দেখা যায় কবি বা কবিযশপ্রার্থীদের মধ্যে।

এহেন সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে, মানবজাতির আদি নিয়ম অনুসারে প্রাথমিকভাবে আমাদের তাকাতে হবে এই জগতে আমাদের মুরুব্বী যারা আছেন, পন্ডিত নন্দনতাত্ত্বিক যারা আছেন, তাদের দিকে। দেখতে হবে তারা এ সম্পর্কে কী বলে গেছেন।

এক্ষেত্রে অতি অসাধারণ এবং অসাধারণ ভাবে লিখে গেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ভারতশিল্পে মূর্তি বইয়ের ভূমিকায়। ছোট এই ভূমিকাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ন, দিকনির্দেশনামূলক।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেন শেখার সময়ে নিয়ম জানার দরকার আছে, কিন্তু শিল্পীর জন্য তা যেন শেকল না হয়ঃ

উড়িতে শক্তি যতদিন না পাইয়াছি ততদিনই নীড় ও তাহার গণ্ডি। গণ্ডির ভিতরে বসিয়াই গণ্ডি পার হইবার শক্তি আমাদের লাভ করিতে হয়, তার পর একদিন বাধ ভাঙিয়া বাহির হইয়া পড়াতেই চেষ্টার সার্থকতা সম্পূর্ণ হইয়া উঠে। এটা মনে রাখা চাই যে আগে শিল্পী ও তাহার সৃষ্টি, পরে শিল্পশাস্ত্র ও শাস্ত্রকার—শাস্ত্রের জন্য শিল্প নয়, শিল্পের জন্য শাস্ত্র। আগে মূর্তি রচিত হয়; পরে মূর্তিলক্ষণ, মূর্তিবিচার, মূর্তিনির্মাণের মান-পরিমাণ নির্দিষ্ট ও শাস্ত্রাকারে নিবদ্ধ হয়। বাঁধন, চলিতে শিখিবার পূর্বে আমাদের বিপথ হইতে ফিরাইবার জন্য, দুই পায়ে নির্ভর করিয়া দাঁড়াইতে শিখিবার অবসর দিবার জন্য; চিরদিন ঘরের কোণে আমাদের অশক্ত অবস্থায় বাঁধিয়া রাখিবার জন্য নয়। মুক্তি ধাৰ্মিকের; আর ধর্মার্থীর জন্য ধর্মশাস্ত্রের নাগপাশ। তেমনি শিল্পশাস্ত্রের বাঁধাবাঁধি শিল্পশিক্ষার্থীর জন্য; আর শিল্পীর জন্য তাল, মান, অঙ্গুল, লাইট-শেড, পার্সপেক্‌টিভ আর অ্যানাটমির বন্ধনমুক্তি। – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

যারা কেবল নিয়ম দিয়েই শিল্প বিচার করতে যান, নিয়ম মুখস্ত করেই শিল্পী হবেন ভাবেন তাদের ধারণা ঠিক নয়, শিল্পের জন্য হানিকর। আমেরিকায় লেখালেখি শেখানোর কোর্স হয়, কিন্তু সেসব নিয়ম শিখে কয়জন আর বড় লেখক হতে পারে। শিল্পী হবার জন্য নিয়মই যথেষ্ট নয়। অবন ঠাকুর এ বিষয়ে বলেন,

ধর্মশাস্ত্র কণ্ঠস্থ করিয়া কেহ যেমন ধাৰ্মিক হয় না তেমনি শিল্পশাস্ত্র মুখস্থ করিয়া বা তাহার গণ্ডির ভিতরে আবদ্ধ রহিয়া কেহ শিল্পী হয় না। সে কী বিষম ভ্রান্ত যে মনে করে মাপিয়া-জুখিয়া শাস্ত্রসম্মত মূর্তি প্রস্তুত করিলেই শিল্পজগতের সিংহদ্বার অতিক্রম করিয়া শিল্পলোকের আনন্দবাজারে প্রবেশাধিকার লাভ করা যায়। – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

যারা কবিতার ছন্দ, গল্পের ফর্ম ইত্যাদির প্রতিষ্ঠিত রুপ শিক্ষা করেন, কেবল তদনুযায়ী গল্প কবিতা বিচার করতে যান এবং এগুলির ভিতরেই নিজেদের গল্প কবিতাকে আবদ্ধ রাখেন, তাদের এই গণ্ডীবদ্ধ শিল্প প্রয়াস কতটুকু শিল্প হতে পারে শেষতক, তা ভাবার বিষয়।

শিল্পী নিয়ম ভাঙেন নতুন শিল্প প্রকার প্রকরণ তৈরীর জন্যই, ফলে এ নিয়ম ভাঙা বিশৃঙ্খলা নয়।

নদী এক পাড় ভাঙে নূতন পাড় গড়িবার জন্য, শিল্পীও শিল্পশাস্ত্রের বাঁধ ভঙ্গ করেন সেই একই কারণে। – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং