মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » সামাজিক প্রমাণ এবং ভীড়ের প্রজ্ঞা

সামাজিক প্রমাণ এবং ভীড়ের প্রজ্ঞা

সামাজিক প্রমান

মানুষের মধ্যে একটি সহজাত প্রবনতা আছে, অন্য বেশীরভাগ লোক যা করছে তাই সে অনুকরণ করতে চায়। এটার কারণ হচ্ছে সে মনে করে সবাই যেহেতু করছে অতএব এতে হারাবার ঝুঁকি কম। এটা তাকে একটি নিরাপদ অনুভূতি দেয়। এই প্রবণতা নানা ক্ষেত্রে কাজ করে। ফেইসবুকে যখন কোন পোস্ট বেশী লাইক এবং শেয়ার পেয়ে ভাইরাল হতে থাকে, তখন সেই পোস্ট আরো বেশী লাইক এবং শেয়ার পেতে থাকে। বা কমেডি সিরিয়ালে হাসির ট্র্যাক বাজানো হয় হাস্যকর দৃশ্যে এবং এতে দর্শকেরা সেইসব দৃশ্যে বেশী হাসেন বা হাসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ।

মানুষ যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে তখন সে জনপ্রিয় জিনিসটা নিয়েই নিরাপদ বোধ করে। যেমন, কোন রেস্টুরেন্টের মেন্যুতে যদি অনেক খাবারের লিস্ট থাকে তবে ভোক্তা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে। সেই মেন্যুতে যদি একপাশে পপুলার আইটেম নামে কয়েকটা খাবারের তালিকা থাকে, তাহলে ভোক্তা সিদ্ধান্তহীনতা থেকে মুক্তি পেতে ঐ পপুলার আইটেমের একটি খাদ্যই পছন্দ করবে।

যারা বিজ্ঞাপন নিয়ে কাজ করেন, বড় কোম্পানির মার্কেটার, তারা বিভিন্নভাবে এই “সামাজিক প্রমাণ (সোশ্যাল প্রুফ)” প্রবনতা ব্যবহার করে তাদের পন্যকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করে থাকেন।

অবশ্যই অন্ধভাবে “সামাজিক প্রমাণ” প্রবণতায় বাহীত হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক নয়।

সামাজিক প্রমাণের ব্যাপারটি সাইকোলজিস্ট রবার্ট চিয়ালদিনি তার ইনফ্লুয়েন্স বইয়ে আলোচনা করেছিলেন। রেস্টুরেন্টের মেন্যুতে অতিরিক্ত খাবারের তালিকা বা অন্য কোথায় খুবই বেশী পছন্দের অপশন থাকা ভোক্তার সিদ্ধান্তহীনতার জন্ম দেয়, তিনি তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, এ নিয়ে লিখেছেন সাইকোলজিস্ট ব্যারী শোয়ার্জ তার প্যারাডক্স অব চয়েজ বইতে। একই নামে তার একটি টেড লেকচার আছে। আর রেস্টুরেন্টের মেন্যুতে অতিরিক্তি খাবারের তালিকা থাকলে মানুষ তালিকার একপাশে থাকা পপুলার আইটেমগুলি থেকে বেশী পছন্দ করে সিদ্ধান্তহীনতা থেকে বাঁচতে, এটা নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেছেন মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ দিলীপ সোমান এবং অন্যরা।

মানুষের মধ্যেকার “সামাজিক প্রমাণ” প্রবণতা বা অধিকাংশ লোক বা ভীড়ের সিদ্ধান্তকেই ঠিক মনে করা অবশ্যই সব ক্ষেত্রে ভালো ফল বয়ে আনে না। কিছুক্ষেত্রে তা মারাত্মক হয়। যেমন, স্টক মার্কেটে, দাঙ্গার ক্ষেত্রে বা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের দল সোশ্যাল প্রুফ প্রবণতার কারণে উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

রবার্ট চিয়ালদিনি একবার একটা পরীক্ষা করেছিলেন। আমেরিকার আরিজোনা অঙ্গরাজ্যের একটি সংরক্ষিত বন পার্কে গাছ চুরি হচ্ছিল। তিনি এই চুরি কমানোর জন্য গাছে একটি মেসেজ লিখে দিলেনঃ

“অতীতে অনেকে এই পার্কের সংরক্ষিত গাছ কেটে নিয়েছেন যা পার্কের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করেছে।”

এর ফল হলো উলটা। গাছ কাটা কমার পরিবর্তে বেড়ে গেল শতকরা ৮ ভাগ। গাছ যারা চুরি করছিলেন তাদের জন্য এটি সামাজিক প্রমান হিসেবে কাজ করল।

 

ভীড়ের প্রজ্ঞা

 

কিন্তু, কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের দল আসলে সমন্বিতভাবে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। ভীড়ের সকল সদস্য যদি নিজেরা স্বাধীন ভাবে মত দেয়, তাহলে তাদের সমন্বিত গড় সিদ্ধান্তটি অনেক ক্ষেত্রে ভালো হতে পারে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত জরিপের ক্ষেত্রে ভীড় নিজেরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এমনটা বলা যায় না। দূর্বল গণতন্ত্রের দেশে পয়সা দিয়ে ভোট কেনা হয়, ভয় দেখিয়ে ভোট নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে প্রকৃতভাবে ভীড়ের সমন্বিত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় না। আবার তথাকথিত সব গনতন্ত্রের দেশগুলিতে মিডিয়া দ্বারা ম্যানিপুলেট করা হয় সাধারণ মানুষদের।

মানুষের ভীড় যে সমন্বিতভাবে কিছু বিষয়ে গড়ে তুলনামূলক সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এর সপক্ষে একটি গল্প নেয়া যায়, জেমস সুরোউইকি’র ‘উইজডম অব ক্রাউডস’ বইটি থেকে।

ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এবং পলিম্যাথ ফ্রান্সিস গালটন ১৯০৬ সালের এক শীতকালে প্লেমাউথের এক গ্রাম্য মেলায় গিয়েছিলেন। গালটনের বয়স তখন ৮৫ বছর। তিনি কাজ করে যাচ্ছেন পরিসংখ্যান আর উত্তরাধিকারের বিজ্ঞান বা সুপ্রজননবিদ্যা নিয়ে। ইউজেনিকস বা সুপ্রজননবিদ্যা বিতর্কিত একটি বিষয়, গালটনই এই শাখার অগ্রণী ব্যক্তি। তিনি মনে করতেন “ভালো জাতের” কিছু মানুষের মধ্যেই “ভালো” বৈশিষ্ট্যাবলী আছে এবং তাদের প্রজনন ঘটিয়ে “ভালো মানব সমাজ” তৈরী করা সম্ভব। “ভালো” এইসব মানুষের সাথে যদি ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণ থাকে তাহলে মানুষের সমাজ ভালোভাবে কাজ করবে এমনই মনে করতেন বিজ্ঞানী গালটন। অনেকটা আমাদের উচ্চজাতের ঘরে ভালো মানুষ হয়, নিচু জাতের ঘরে খারাপ মানুষ হয় এমন ধারণা।

তা যাই হোক, গালটন গিয়েছিলেন গ্রাম্য মেলায়। সেখানে কৃষকেরা নিয়ে আসছে তাদের সুন্দর সব গৃহপালিত পশু, একে অন্যের পশুদের দেখে প্রশংসা করছে ইত্যাদি। গালটন এগুলি দেখতে দেখতে তার “ভালো জাতের” বৈশিষ্ট্যাবলী নিয়ে ভাবছিলেন। তখন এক জায়গায় দেখা গেল এক স্বাস্থ্যবান ষাঁড় রাখা হয়েছে। সেখানে চলছে এক মজার প্রতিযোগীতা। কেউ টিকেট কেটে তার নাম ঠিকানা লিখে অনুমান করতে পারবে এই ষাঁড়টি জবাই করা হলে এর মাংস কতটুকু হবে। যার অনুমান ঠিক হবে সে পাবে পুরস্কার।

প্রায় আটশো মানুষ এতে অংশ নিল। এদের কেউ ষাঁড় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যেমন কসাই, কৃষক। আবার কেউ কেউ একেবারেই অনভিজ্ঞ। তারা সবাই টিকেট কেটে অনুমান করল।

গালটন প্রতিযোগীতা এবং ফলাফল প্রকাশ শেষ হলে প্রতিযোগীতার টিকেট গুলি নিয়ে বাসায় ফিরে এলেন। ৮০০ এর মধ্যে ৭৮৪ টিকেট তিনি রাখলেন, বাকীগুলি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ৭৮৪ টা টিকেটের অনুমান নিয়ে তিনি নানা পরিসংখ্যানিক পরীক্ষা করলেন। তার ধারণা ছিল, এই সাধারণ লোকদের ভীড়ের সমন্বিত সিদ্ধান্ত খুবই খারাপ হবে, কারণ এখানে আছে কিছু বিশেষজ্ঞ আর বেশীরভাগই ছিল ষাঁড় বিষয়ে বিশেষভভাবে অজ্ঞ। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফলে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। ষাড়ের ওজন হয়েছিল ১১৯৮ পাউন্ডস। আর সাধারণ লোকদের এই ভীড়ের অনুমানের সমন্বিত সিদ্ধান্ত দাঁড়িয়েছে ১১৯৭ পাউন্ডস!

 

বিহেভিওরাল ইকনোমিক্স বা মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতি উপদেশ নেয়া বিষয়ে যা বলেঃ

সোশ্যাল প্রুফ টেন্ডেন্সির কারণে মানুষ বাজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আবার আমরা দেখলাম যে যখন একটি মানুষের দল স্বাধীনভাবে মত জানায় তখন তাদের গড় মত খুবই ভালো হয়। মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতি এই গড় মত গ্রহণ করার পক্ষে মত দেয়।

ডিউক ইউনিভার্সিটির জ্যাক সল এবং রিক ল্যারিক তাদের গবেষনায় দেখেছেন, মানুষ গড় করাতে বিশ্বাস করে না। তাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থাকে এবং তারা ভুলভাবে চিন্তা করে যে গড় মানে গড় পারফরমেন্সই হবে।

 

দুইটি দৃশ্য ভাবুন।

 

দৃশ্য -এক

জনাব এক্স সাহেবঃ উনার পড়ালেখা আপনার ফিল্ডে এবং একই ট্রেইনিং নিয়েছেন।

জনাব ওয়াই সাহেবঃ উনার পড়ালেখা ও ট্রেইনিং ভিন্ন।

 

দৃশ্য-দুই

জনাব এ সাহেবঃ আপনার কাছে যেসব তথ্য উপাত্ত আছে উনার কাছেও একই তথ্য উপাত্ত আছে।

জনাব বি সাহেবঃ উনার কাছে ভিন্ন তথ্য উপাত্ত আছে।

 

গবেষকেরা দেখেছেন যে মানুষ উপদেশ নেবার সময় জনাব এক্স এবং জনাব এ সাহেব এর উপদেশ নিতে পছন্দ করে। কিন্তু জনাব ওয়াই ও জনাব বি সাহেবের উপদেশ অধিক কার্যকরী হয়।

এখানে সহজ জিনিস, উনাদের পড়ালেখা, ট্রেইনিং ও তথ্য উপাত্ত ভিন্ন তাই তারা আপনার সিদ্ধান্তের দূর্বলতা দেখতে পান, বা এমন কিছু দেখতে পান সহজে যা আপনার চোখে পড়ে নি।

 

মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতির গবেষকেরা তাই বলেনঃ

১। গড় করা একটি ভালো পদ্বতি। দুই মাথা এক মাথার চাইতে ভালো, বিশেষত যখন তাদের তথ্য উপাত্ত ও পদ্বতি ভিন্ন হয়।

২। এমন লোকদের কাছ থেকে উপদেশ নিন যার জানাশোনা (নলেজ বেইজ) আপনার থেকে ভিন্ন।

৩। তাদের উপদেশ এবং আপনার মত সমান সমান ভাবে বিচার বিবেচনা করে দেখুন। এটা করা কঠিন কারণ নিজের মতকে বেশী গুরুত্বপূর্ন মনে হয়। কিন্তু যেহেতু আপনি ভালো সিদ্ধান্ত নেবার টুল হিসেবে তা নিজের জন্যই ব্যবহার করছেন, তাই নিরপেক্ষভাবে বিচার করলেই আপনি তুলনামূলক ভালো সিদ্ধান্তের কাছাকাছি যেতে পারবেন।

৪। যত বেশী পারা যায় উপদেশ সংগ্রহ করুন।

৫। সবই যদি ব্যর্থ হয় তাহলে নিজেকে সময়ের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণে রেখে ভাবুন।

1 thought on “সামাজিক প্রমাণ এবং ভীড়ের প্রজ্ঞা”

  1. সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যে ব্যাপারগুলা সবসময় মিস হয়ে যায় সেগুলাই এই আর্টিকেলে সেগুলাই খুঁজে পেয়েছি। সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সবসময় আমরা সুবিধাজনক এরিয়ার লোকদের থেকেই বেশি মতামত নেই, ভিড়ের দিকে দৌড়াই, বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না আর।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং