মুরাদুল ইসলাম » মানসিক নকশা » যে কারণে অল্পবুদ্ধিরা বুঝতে পারে না তারা অল্পবুদ্ধি

যে কারণে অল্পবুদ্ধিরা বুঝতে পারে না তারা অল্পবুদ্ধি

সাইকোলজিস্টেরা পরীক্ষা টরীক্ষা করে দেখেছেন যে, মানুষ তার নিজের সক্ষমতা বিষয়ে নিজে ঠিকঠাক বিচার করতে পারে না। মানুষ তার নিজের সক্ষমতার-অক্ষমতার খুব বাজে বিচারক।

সব মানুষেরাই নিজেদের মনে করে গড়ের চাইতে বেশী বুদ্ধিমান। আপনেও নিজেকে মনে করেন বেশী বুদ্ধিমান, আমিও। তাহলে অল্পবুদ্ধিরা কোথায়? আমি আপনে, আমরা সবাই বেশী বুদ্ধিমান হলে এতো আহাম্মকী, অযৌক্তিক আচরণ এসব করে কারা?

সাইকোলজিস্টেরা দেখতে পেয়েছেন আমরা আমাদের নিজের দূর্বলতা দেখতে পাই না। তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ফলাফল আমাদের দুইটা জিনিসের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে।

জিনিস নাম্বার এক- আমরা বুঝতে পারব কেন কিছু অল্পবুদ্ধিরা বিরক্তিকর হয়ে থাকে, যুক্তি ও নিজেদের দূর্বলতা দেখতে পায় না ও আজীবন অল্পবুদ্ধিই রয়ে যায়।

জিনিস নাম্বার দুই- আমাদের আত্মসম্মানের বা আত্মঅহংকারের দূর্গে এইসব গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল আঘাত করতে পারে, এবং নিজের বুদ্ধি বিষয়ে সন্দেহপ্রবণ ও আরো বিনয়ী করে তুলতে সাহায্য করতে পারে।

জাস্টিন ক্রুগার ও ড্যাবিড ডানিং; কর্নেল ইউনিভার্সিটি ইউ ইয়র্কের দুইজন সাইকোলজিস্ট ১৯৯৯ সালে পরীক্ষা করে দেখতে যান, যাদের দক্ষতা বা সক্ষমতা কম তারা কি জানে তাদের এই দক্ষতা বা সক্ষমতা কম থাকার ব্যাপারে? তারা কি এ সম্পর্কে সচেতন যে তারা কম দক্ষ? নাকী তারা তাদের অক্ষমতা ব্যাপারে জানে না ও নিজেদের বেশী সক্ষম মনে করে?

তাদের রিসার্চ পেপারের শুরুতে তারা পিটার্সবুর্গের এক বিখ্যাত ব্যাংক ডাকাতের কথা বলেন। ডাকাতের নাম ম্যাকআর্থার উইলার। ১৯৯৫ সালে এই ডাকাত দিনে দুপুরে কোন মুখোশ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংক ডাকাতি করে ও পুলিশের কাছে ধরা পড়ে।

পুলিশ তাকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, সে কি জানত না যে ক্যামেরা আছে, ও তাতে সব রেকর্ড হচ্ছে।

দস্যু বাহাদুর ম্যাকআর্থার অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছিল, আমি তো মুখে লেবুর রস মেখে ডাকাতি করতে গিয়েছিলাম!

অর্থাৎ, সে বিশ্বাস করত মুখে লেবুর রস মেখে গেলে সিসি ক্যামেরায় মুখ দেখা যায় না।

জাস্টিন ও ক্রুগার তাদের পরীক্ষার জন্য ৩০ টি কৌতুক নেন এবং পেশাদার কমেডিয়ানদের বিচারের মাধ্যমে এদের র‍্যাংক করেন। অতঃপর ৬২ জন আন্ডারগ্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীকে বলেন, কৌতুকগুলিকে কতটুকু ফানি তার ভিত্তিতে র‍্যাংক করতে।

এবং তাদের জিজ্ঞেস করেন, তারা গড় একজন মানুষের চাইতে ভালো না খারাপভাবে কৌতুকগুলির ফানিত্ব বিচার করতে পেরেছে, সে সম্পর্কে মত দিতে।

প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদেরকে বিচার করার সময় গড়ের চাইতে ভালো বলে রায় দিলো।

গবেষকেরা দেখলেন, যারা সবচাইতে ভালো করেছে তারা নিজেদের গড়ের চাইতে একটু ভালো হিসেবে বলেছিল।

আবার যারা গড়ের চাইতে সামান্য ভালো বিচার করতে পেরেছে, তারা নিজেদের সম্পর্কে যে বিচার করেছিল তা প্রায় ঠিক।

এবং যারা সবচাইতে খারাপ করেছে, নিজেকে বিচারের বেলায়ও তারা সবচাইতে খারাপ করেছে।

ক্রুগার ও ডানিং এরপর আরেক ধরণের পরীক্ষায় যান। এবারের পরীক্ষায় প্রশ্ন ছিল লজিক্যাল ও গ্রামারের। যেসব প্রশ্নের উত্তর ব্যক্তি নির্ভর নয়, সরাসরি উত্তর আছে।

এখানেও দেখা গেল একই বিষয়। যারা সবচাইতে খারাপ করেছে উত্তরে, তারা নিজেদের বিচারের বেলাতেও সবচাইতে বাজে করেছে।

যাদের পারফর্মেন্স সবচাইতে খারাপ তারা নিজের সক্ষমতাকে খুবই অভার এস্টিমেট করে থাকে।

আরো দেখা গেছে, তাদের ফীডব্যাক দেয়া হলেও নিজের সক্ষমতার ব্যাপারে ভুল ধারনার কোন পরিবর্তন হয় না।

জাস্টিন ও ক্রুগারের মতে, কোন বিষয়ে সক্ষমতার বা দক্ষতার জন্য সে বিষয়টা ব্যক্তি কেমন পারে তা সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরী, যেমন জরুরী কাজটা ঠিকমত করা। যারা কাজটিতে কম দক্ষ তারা কাজটি করতেও পারে না, আবার সে কাজটি নিজে কেমন পারে তা সম্পর্কে ভুল ধারনা নিয়ে বসে থাকে। অর্থাৎ, তাদের দুইদিক দিয়েই অবস্থা থাকে বাজে।

Instruct the Ignorant; © Tim Green

ক্রুগার ও ডানিং আবার পরীক্ষা করলেন। এবার যারা প্রশ্নগুলির বাজে উত্তর দিয়েছিল তাদের যুক্তি শিখিয়ে ট্রেনিং দিলেন। ট্রেনিং দেয়ার পর যখন তারা যৌক্তিক প্রশ্ন উত্তরে দক্ষ হয়ে উঠল তখন দেখা গেল নিজেদের সক্ষমতা বিচারে তারা আর অভার-এস্টিমেট করছে না।

অর্থাৎ, এটি তাদের দক্ষতাই বাড়ায় নি, নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে অহেতুক উচ্চ ধারনা দূর করেছে ও বাস্তবসম্মত ভাবে তারা বুঝতে শিখেছে নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে।

অন্য গবেষনায়, শুধু ল্যাবরেটরীতে নয় বাস্তব জীবনেও দেখা গেছে যারা কম জানে, তারা তাদের জানা নিয়ে উচ্চ ধারণা পোষণ করে। যেসব শিকারীর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে জ্ঞান কম তারা তাদের জ্ঞাণ যে কম তা বুঝতে পারে না। যেসব ডাক্তারের রোগীদের ইন্টারভিউ নেবার দক্ষতা বাজে, তারা তাদের এই অক্ষমতা দেখতে পায় না।

অর্থাৎ, মানুষ তার অল্পবুদ্ধি ব্যাপারে অসচেতন থাকে। অল্পবুদ্ধিরা নিজের বুদ্ধি নিয়ে উচ্চ ধারণা পোষন করে তাই আজীবনই অল্পবুদ্ধি রয়ে যায়।

অল্পবুদ্ধির নিজের অল্পবুদ্ধি বিষয়ে সচেতন হওয়াই তার অল্পবুদ্ধিত্ব থেকে মুক্তির প্রথম ধাপ।

এই লেখা থেকে, ডানিং-ক্রুগারের মারফতে জানা গেল, অল্পবুদ্ধিরা তাদের মূর্খতা সম্পর্কে মূর্খ থাকতে পারে। এবং এই মূর্খতার মারাত্মক অসুখ হতে পারে মানুষের। আমাদের পরিচিত মানুষের, ভাই বন্ধুর, ফেইসবুকে থাকা লোকদের।

এবং আমাদেরও, আমারও।

যেহেতু আমরাও মানুষ। হোমো ইরেক্টাস থেকে আগত হোমো স্যাপিয়েন্স।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং