শিশুদের একটা আলাদা জগত থাকে। যা বড়দের জগত থেকে আলাদা। এই দুই জগতের মধ্যে পার্থক্য বিশাল। শিশুরা পৃথিবীকে একভাবে কল্পণা করে। কিন্তু বাস্তব পৃথিবী তার চেয়ে অনেক ভিন্ন। অনেক বেশি ডার্ক।
সত্যজিৎ রায়ের কিশোর ক্লাসিক ফেলুদা সিরিজে দেখা যায় ফেলুদা সব কথা তোপসেকে বলে না। তার একটি ডায়রী থাকে। সে ডায়রীতে লিখে সাংকেতিক ভাষায়। ইংরেজিতে কিন্তু গ্রীক অক্ষরে। ফলে তোপসে তা বুঝতে পারে না। বাস্তবের ডার্ক দুনিয়া তাই তোপসের কাছে অনেকটাই অজানা থেকে যায়।
আয়াম নট স্কেয়ারড (I’m Not Scared, Italian: Io non ho paura) একটি ইতালিয়ান ফিল্ম। পরিচালনা করেছেন গ্যাব্রিয়েল সালভাতোর। ১৯৯২ সালে তার নির্মিত ফিল্ম মেডিটেররানিও অস্কার পেয়েছিল বেস্ট ফরেন ফিল্ম হিসেবে। গ্যাব্রিয়েল সালভাতোরের এই ফিল্ম শিশুদের মনস্তত্ব নিয়ে। যদিও সাদামাটাভাবে এটি একটি উত্তেজনাকর থ্রিলার।
সাউদার্ণ ইতালিতে একটি কাল্পনিক শহরে মিখেলে নামের দশ বছর বয়েসী এক বালকের বাস। সে এবং তার বোন তাদের বন্ধুদের সাথে গম ক্ষেতের পাশে খেলতে যায়। ফিল্ম শুরু হয়ে এই দৃশ্য দিয়ে যে তারা গম খেতের মধ্য দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক থাকে। জিজেক বলেন ফিল্মের দূর্বলতা ঢাকতে মিউজিকের ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এখানে সেটা করা হয়েছে শিশুদের উচ্ছলতা তুলে ধরতে। প্রথম দৃশ্যে এবং গম ক্ষেতে আরো কয়েকটি দৃশ্যের ক্যামেরাবাজি অসাধারণ।
মিখেলে একপর্যায়ে একটা গর্ত দেখতে পায়। সে গর্তের মুখ ঢাকা ছিল। সে ভেতরে তাকিয়ে দেখে এক অদ্ভুত প্রাণীর অংশ দেখা যাচ্ছে। রহস্যের শুরু মূলত এখান থেকেই। খুব ভয়ানকভাবে মাটির নিচে গর্তের অংশ দেখানোর একটা চেষ্টা করা হয়েছে। গর্তের ভীতির আবহ এবং অন্ধকারের কাজ বড়দের পৃথিবীর অন্ধকারতাকে নির্দেশ করে।
দশ বছর বয়েসী মিখেলের পরিচয় হয় এর সাথে। একপর্যায়ে মিখেলে বুঝতে পারে তার বাবা এবং বাবার বন্ধুরা এই গর্তের অন্ধকারের সাথে জড়িত। বুঝতে পারে একটি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
কিন্তু সে পুলিশের সাহায্য নিতে যায় নি। কিংবা তার বন্ধুদের নিয়ে সে অপরাধের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে নি, যেটা সাধারণ মানের কিশোর এডভেঞ্চার গল্পে দেখা যায়। শিশুসূলভ কৌতুহল এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সে ব্যাপারটাকে দেখেছে। ফিল্মের এটা একটা গুরুত্বপূর্ন দিক। যদি মিখেলে সাধারণভাবে পুলিশের সাহায্য নিত তাহলে এই ফিল্ম সাধারণ এক থ্রিলার ফিল্ম হিসেবেই গণ্য হত।
প্রতিবার মিখেলে যখন সাইকেল চালিয়ে লুকিয়ে গর্তের কাছে যায় তখন একটি কাটাতারের বেড়া দেখা যায়। সে এই কাটাতারের বেড়া টপকে গর্তের কাছে যায়। এই কাটাতারের বেড়া শিশুদের পৃথিবী এবং বড়দের অন্ধকার পৃথিবীর মধ্যবর্তী দেয়ালের রূপক।
মিখেলের বয়স দশ বছর। সাধারণত এই বয়স থেকেই শিশুরা বুঝতে শুরু করে বড়দের পৃথিবী সম্পর্কে। দুই পৃথিবীর মধ্যবর্তী কাটাতারের বেড়া এই শিশুরা এই বয়েসেই অতিক্রম করার চেষ্টা করতে থাকে। সেটা বয়ঃসন্ধিকাল বা তারো কিছু পর পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
কাটাতারের বেড়া, গর্ত, গর্তের অন্ধকার, সেই অন্ধকারের ভেতরে অপরাধের রহস্য ইত্যাদির মাধ্যমে ফিল্মটিতে শিশুর মনস্তত্ত্ব এবং বাস্তব তথা বড়দের দুনিয়ার সাথে তার প্রাথমিক বুঝাপড়া এবং সেই বুঝাপড়ার প্রতিক্রিয়া কী হয় তার মধ্যে সেটা দেখানো হয়েছে।
মিখেলের মা কে প্রথমদিকেই দেখা যায় অথোরিটিয়ান হিসেবে। সে ছেলেকে কড়া শাসন করে। মিখেলের বাবা প্রথমদিকে হাসিখুশি হলেও শেষে যখন সে জানতে পারে গর্তের কাছে মিখেলে যাতায়াত আছে তখন সে মিখেলের প্রতি কঠোর হয়। কড়াভাবে তাকে শাসন করে। অথোরিটিয়ান পিতামাতার এক সুন্দর উপস্থাপন এই দুই চরিত্রের মাধ্যমে উঠে এসেছে। তবে তাদের সন্তান বাৎসল্য প্রশ্নাতীত। তা দেখা যায় যখন মিখেলের বাবার ব্রাজিলিয়ান ক্রিমিনাল বন্ধু তাদের বাসায় থাকতে আসে তখন। তখন তার মা তাকে বুঝাতে চেষ্টা করে রুম শেয়ার করে থাকার জন্য। মিখেল এতে রেগে গেলেও তার মা এক্ষেত্রে মন খারাপ করে না। এছাড়া মিখেলকে গর্তের কাছে যাবার জন্য ধমকাচ্ছিল মিখেলের বাবার এক বন্ধু। তখন তার মা সেই লোকটির সাথে হাতাহাতিতে যুক্ত হয়। মিখেলের বাবার সন্তানপ্রীতিও কম না, যদিও সে অপরাধী। শেষের দিকের দৃশ্যে তার বেদনাক্রান্ত মুখ ছেলের প্রতি তার অপত্য স্নেহকেই ইঙ্গিত করে। এইসব বিষয় বিবেচনায় এটা নিঃসন্দেহ যে মিখেলের অথোরিটিয়ান পিতামাতার সন্তানদের প্রতি স্নেহ ভালোবাসার কমতি ছিল না।
কিন্তু তবুও তারা অপরাধের সাথে যুক্ত হয়। যে অপরাধ নিষ্ঠুর। কারণ তারা বাস করে বড়দের পৃথিবীতে।
মিখেলের বাবা মা ও তাদের বন্ধুরা রাতে যখন বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করে গর্ত নিয়ে তখন মিখেলে দরজার আড়ালে থেকে তা শোনে। তার ভয়াক্রান্ত কৌতুহলী মুখ এবং সতর্ক দৃষ্টি বড়দের পৃথিবীকে জানার ইচ্ছাকে প্রকাশ করে যায়। এখানেও দরজা কাজ করে দুই পৃথিবীর মধ্যেকার সীমারেখা হিসেবে।