ব্যোমকেশ ফিরে এলো (২০১৪) ফিল্মে একটা সময় দেখা গেল ব্যোমকেশের এক ভাই তার কাছ থেকে বই নিতে আসে। ট্রটস্কির বই। দেখানো হয় ব্যোমকেশের ঘর বই ভর্তি। সেই ভাই কাঁধে ঝোলা ঝুলিয়ে বই নিতে ও পড়তে আসে।
শুরুর দিকে দেখা যায় বেনীমাধবের নাতি মার্ক্সবাদী রাজনীতি করে গোল্লায় যাচ্ছে। (মূল শরদিন্দুর গল্পেও নাতি রাজনীতি করে কিন্তু কোনবাদী রাজনীতি করে তার উল্লেখ নাই।) দাদা বেনীমাধব নাতিকে এ নিয়ে কথা বলতে গেলে নাতি বেয়াদবের মত জবাব দেয়ঃ “তুমি কী বুঝবে, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস যদি পড়তে তাইলে বুঝতে।” এরকম একটা কিছু। বেনীমাধবের মাথায় রক্ত উঠে যায়। তিনি চড় দিয়ে নাতির মাথা থেকে মার্ক্স আর এঙ্গেলস দুজনকেই নামাতে যান। দুজনের কেউই নামেন নি, শুধু নাতির চশমা নেমে যায়।
যাইহোক, লেনিনের মৃত্যুর পরে স্ট্যালিন এবং ট্রটস্কির দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়েছিল। জোসেফ স্ট্যালিন ট্রটস্কিকে রুশ সমাজতন্ত্র এবং লেনিনবাদের শত্রু বলে অভিহিত করে পার্টি থেকে বহিষ্কার করেন। সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেয়া হয় তাকে। তিনি মেক্সিকোতে পলায়ন করেন। সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন এক গুপ্তঘাতক। সেই গুপ্তঘাতকের গুলিতে ট্রটস্কি প্রান হারান। এই হত্যার ব্যাপারে স্ট্যালিনের হাত ছিল বলে কথিত।
ব্যোমকেশের ফিল্মে ট্রটস্কি পড়া ভাইয়ের কোন ভূমিকা নেই। রহস্য নির্মান কিংবা উদঘাটনে সে কিছুই করে না। খালি দুই একবার তাকে দেখা যায় বই পড়তে।
এই পড়ুয়া ব্যোমকেশের ভাইয়ের উপস্থিতি এবং তার ট্রটস্কি ইত্যাদি পড়া উগ্র মার্ক্সবাদের তথা স্ট্যালিনিজমের ইঙ্গিত সমালোচনা।
আরেক দৃশ্যে দেখা যায় বেনীমাধবের নাতির সাথে ব্যোমকেশের কথোপকথন। বেনীমাধবের তখন স্বর্গপ্রাপ্তি বা নরকপ্রাপ্তি ঘটে গেছে।
ব্যোমকেশ নাতির ব্যাগে থাকা ছুরিটা চাইলে সে জানায় এই ছুরিখানার জন্যই সে ধরাধামে টিকে আছে। পার্টি ভেঙ্গে গেছে। বিভিন্ন দল উপদল হয়েছে। প্রতিবিপ্লবের এই কালে সৎ মার্ক্সবাদী তরুণ বেনীমাধবের নাতি ভিড়তে পারছে না কোন দলে। তাই সবাই তাকে শ্রেণীশত্রু বলে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চায়।
যারা তার বন্ধু ছিল এককালে তারাই হয়ে গেছে শত্রু। মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে প্রতিবিপ্লব বা এই ধরনের হানাহানি ঘটে ছিল। বাংলাদেশে স্বাধীনতা উত্তরকালে কম্যুনিস্ট আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি নিয়ে লেখা রইসুদ্দিন আরিফের আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন সমগ্রতে এর ভয়ংকর এক চিত্র রয়েছে।
যাইহোক, বেনীমাধবের নাতির এই অবস্থা দেখে ব্যোমকেশ তাকে কিছু কথা বলে। এর একটি এরকমঃ ‘তোমার ব্যাগের ঐ চটি বই ছাড়াও দুনিয়াতে আরো বই আছে।’
চটি বই মানে ছোট আকারের বই। নাতির ব্যাগে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এর বই ছিল। বেনিমাধবের নাতি জানতে চায় কী বই। ব্যোমকেশ বলে, আমার বাসায় এসো। দিব।
এরপরে যখন রহস্য উদঘাটন শেষ, ফিল্মের কাহিনী একেবারে শেষ হতে যাচ্ছে তখন দেখা যায় বেনিমাধবের নাতি সুবোধ বালক সেজে গেছে ব্যোমকেশের বাসায়। ব্যোমকেশ তারে দেয় টোটালিটারিয়ানিজম বিরোধী লেখক জর্জ ওরওয়েলের বই।
অঞ্জন দত্তের এই ব্যোমকেশ রহস্য অনুসন্ধানে সত্যান্বেষী এবং উদারপন্থী লোক। সে উগ্র মার্ক্সবাদে আক্রান্ত যুবক বেনিমাধবের নাতিকে পরিচয় করিয়ে দেয় এক বইয়ের বাইরে আরো অজস্র চিন্তারাজির সাথে।
এটা খালি উগ্র মার্ক্সবাদের ক্ষেত্রে নয়, অন্যসব উগ্রপন্থী আদর্শের ক্ষেত্রে সত্য। যখন মানুষ উগ্রভাবে এক পন্থায় গোঁয়ার হয়ে বসে থাকে, বিভিন্ন চিন্তা এবং আলোচনার সাথে পরিচিত হয় না তখন সে বিধ্বংশী হয়ে উঠে। যা তার জন্য ভালো না, সমাজের জন্যও নয়। অঞ্জন দত্তের সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ আমাদের এই শিক্ষাই দিতে চায়।
এছাড়া এই ব্যোমকেশের মানবিক দিক নিয়ে আগে আরেকটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। যেথায় স্পয়লার বিদ্যমান।
শরদিন্দু বেণীসংহারে মেদিনী চরিত্রটাকে নষ্টের মূলে রেখেছিলেন। গল্পে ব্যোমকেশ বলে, “শ্রীমৎ শংকরাচার্য বলেছেন নারী নরকের দ্বার। সনৎ নরকের অনেকগুলো দ্বার খুলেছিল, তাই শেষ পর্যন্ত তার নরক প্রবেশ অনিবার্য হয়ে পড়ল।”
অথবা “রাখাল, মেদিনীর মত মেয়েদের তুচ্ছজ্ঞান কোরো না। যুগে যুগে এই জাতের মেয়েরা জন্মগ্রহণ করেছে-কখনো ধনীর ঘরে কখনো দরিদ্রের ঘরে-পুরুষের সর্বনাশ করার জন্য।”
কিন্তু ফিল্মে মেদিনী চরিত্র অন্যভাবে চিত্রায়িত। অঞ্জন দত্ত সেই নারীবিদ্বেষী পথে না গিয়ে মানবিকভাবে এগিয়েছেন। দোষ দিলেও তার পিছনে সমাজের প্রভাব ইত্যাদি তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। ফিল্মের মেদিনী অপরাধী হলেও নিজেই অন্যভাবে একজন ভোক্তভোগী।
অঞ্জন দত্তের ব্যোমকেশ আবির বাবু মেদিনীর বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে শরদিন্দুর ব্যোমকেশের মত কোন কিছু বলেন নি। এটা দুই ব্যোমকেশের পার্থক্য।
শেষ করা যাক ট্রটস্কি এবং স্ট্যালিনকে নিয়ে একটি কৌতুকের মাধ্যমে,
ট্রটস্কিকে নির্বাসনে পাঠানোর পর জোসেফ স্ট্যালিন গেছেন জনসভায়। তিনি বললেন, “আপনারা জেনে প্রীত হবেন কমরেড ট্রটস্কি আমাকে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। বার্তায় তিনি বলেছেন, কমরেড স্ট্যালিন, আপনি ঠিক করেছেন, আমিই ভুল করেছি। আপনিই লেনিনের যোগ্য উত্তরসুরী।
উপস্থিত সবাই হাত নেড়ে উল্লাশ জানাল শুধু সামনের সারিতে থাকা একজন লোক ছাড়া। লোকটি বলল, “কিন্তু কমরেড, তারবার্তাটি ঠিক আবেগ দিয়ে পড়া হল না।
স্ট্যালিন খুশিমনে জনসাধারনকে লক্ষ্য করে বললেন, “বন্ধুগন, আমাদের একজন কমরেড বলছেন বার্তাটি আবেগ দিয়ে পড়া হয় নি। তাই আমি তাকে মাইকে এসে তারবার্তাটি যথার্থ আবেগ দিয়ে পড়তে অনুরোধ করছি।”
ভদ্রলোক উঠে গেলেন মাইকে। বার্তাটি নিয়ে পড়তে লাগলেন, “কমরেড স্ট্যালিন, আপনি ঠিক করেছেন? আমি ভুল করেছি? আপনিই লেনিনের যোগ্য উত্তরসুরী?” 😉