অথরিটি কি?
অথরিটি হচ্ছে কোন ক্ষমতা ব্যবহারের অধিকার বা ন্যাযতা। ধরেন কোন সরকার চাইল তার জনগণ ১০% আয়কর দিবে। এমনিতে জনগণ আয়কর দিতে ইচ্ছুক হবে না। ফলে সে আইন প্রণয়ন করে এই ট্যাক্স নিতে পারে। এইটা তার অথরিটি।
সরকারের ক্ষমতার সাথে সমার্থক হিসেবেও অথরিটি ব্যবহার হয়।
অথরিটি অর্থাৎ ক্ষমতা ব্যবহারের ন্যায্যতা সরকারকে দেয় জনগণ। এর বিনিময়ে সরকার তাদের নিরাপত্তা দিবে। এই তাদের সামাজিক চুক্তি। আধুনিক গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় এই সামাজিক চুক্তির পিছনে অবদান পলিটিক্যাল দার্শনিক থমাস হবসের।
অথরিটির আরো বিভিন্ন প্রকার আছে। যেমন, জঙ্গলে ছুটছে শিকারির দল। দলের সর্দার বললেন ডানদিকে আছে শিকার। দল সর্দারের পিছে পিছে ডানদিকে ছুটল। এখানে সর্দার তাদের অথরিটি।
একজন ইকোনোমিস্ট। তিনি দাবী করলেন তিনি একজন বড় এক্সপার্ট। তার ডিগ্রী দেখালেন। গবেষণামূলক কাজ দেখালেন। একদল শেয়ার বাজারে ইনভেস্টকারী তা দেখে তাকে বিশ্বাস করলেন। ইকোনমিস্ট তাদের নির্দিষ্টভাবে ইনভেস্ট করতে বললেন। তারা তা মানলেন। এখানে এই ইকোনোমিস্ট তাদের অথরিটি হিসেবে কাজ করেছেন।
টিভি বিজ্ঞাপনে আপনি দেখলেন ডাক্তারের পোষাক পড়া এক লোক বলছে হরলিক্স খেলে বাচ্চারা টলার শার্পার হয়। গবেষনায় প্রমাণিত। আপনি তা দেখে বাজার থেকে ছেলের জন্য হরলিক্স কিনে আনলেন। আপনার হরলিক্স কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহনে ইনফ্লুয়েন্স করেছে বিজ্ঞাপনের ডাক্তার, সেই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সে ছিল আপনার অথরিটি।
পোস্ট মডার্ন অথরিটি
স্লোভানিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেক তার লেকচারে পোস্ট মডার্ন অথরিটির কীরকম হয় তা ব্যাখ্যা করেছিলেন। ধরুন কোন আগেকার আমলের বাবা। তার অথরিটি হবে এমন যে তিনি তার সন্তানকে সরাসরি আদেশ দিবেন। তিনি বলবেন, “তোমার দাদী অসুস্থ। আজ বিকেলে তাকে দেখতে যাবে।”
কিন্তু পোস্ট মডার্ন অথরিটিয়ান বাবা এমন বলবেন না। তিনি ছেলেকে বলবেন, “দেখো বাবা, তোমার দাদী তোমাকে কত ভালোবাসেন। আজ তিনি অসুস্থ। তাকে তোমার দেখতে যাওয়া কি উচিত না?”
এই ক্ষেত্রে বাবা তাকে দেখতে যাওয়ার কথা বলছেন এবং এও বলছেন ব্যাপারটা তার ভালো লাগতে হবে। জিজেকের মত এটা আরো বেশী অথোরিটিয়ান। কারণ পূর্ববর্তী অবস্থায় পুত্রের বিদ্রোহ করার বা নাখোশ হবার একটা সুযোগ ছিল। কিন্তু পোস্ট মডার্ন অথোরিটি কাজ করাতে বাধ্য করে এবং তার সাথে তাতে নাখোশ হওয়া যাবে না এমন অবস্থা তৈরী করে দেয়।
মানুষের অথরিটি মানা
মানবের দীর্ঘ ও প্রায় অধারাচ্ছন্ন ইতিহাসে্র দিকে যদি তাকান দেখবেন অথরিটিকে মানার প্রবণতায় যত অতি কুৎসিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, অথরিটির বিরোদ্ধে বিদ্রোহ তথা বিপ্লবে সংঘটিত হওয়া অপরাধ এর তুলনায় নগন্য।- টু কালচারস এন্ড সাইন্টিফিক রেভ্যলুশন, চার্লস পার্সি স্নো। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও বিজ্ঞানী।
মানুষের ইতিহাসে বেশীরভাগ মানুষই নেতাকে মেনে এসেছে। অল্প কিছু লোক হয়েছে নেতা। এই নেতাকে মানার প্রবণতা মানুষের সেই জঙ্গলে থাকার সময়কালের। মানুষের সমাজ নেতৃত্ব আর আনুগত্যের একটা হায়ারার্কির মধ্য দিয়ে তৈরী হয়েছে।
এই নেতা বা অথরিটি অথবা এক্সপার্ট বিভিন্ন ভাবে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে থাকেন সাধারণ লোকদের, যাতে তারা তাকে মানে। আমরা পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা পাব যেখানে একজন নেতা বা এক্সপার্ট তার নেতৃত্ব বা যোগ্যতা দিয়ে জনগণের অশেষ উপকার করেছেন। কিন্তু যে জিনিস আমরা সহজে পাই না তা হচ্ছে নেতৃত্ব অনুসরন করতে গিয়ে কত লোকের জীবন বিপন্ন হয়েছে, জীবনে নেমে এসেছে অসহনীয় দূর্ভোগ।
গ্যালিলিও যখন কেপারনিকাসের মত অনুযায়ী বলতে লাগলেন সূর্য নয় পৃথিবী ঘোরে, তখন তার মতকে গ্রহণ করেনি চার্চ অথরিটি তা সবাই জানেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিক অথরিটিও তার মত গ্রহণ করে নি। টলেমির মত অনুসারী বিজ্ঞানীরা গ্যালিলিও’র মত খন্ডন করে বৈজ্ঞানিক বইও লিখেছিলেন।
গ্যালিলিও হয়ত এজন্যই বলেছিলেন, “বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, কোন এক ব্যক্তির যুক্তির বিপরীতে হাজার জনের অথরিটিও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ”
বিভিন্ন জ্ঞানের একাডেমিক ফিল্ডে নতুন বা ভিন্ন চিন্তার কোন তত্ত্ব উপস্থাপিত হলে তা সহজে গ্রহণ করতে চায় না একাডেমিক অথরিটি। ( সিয়িং হোয়াট আদার’জ ডোনট বইয়ে সাইকোলজিস্ট গ্যারী ক্লেইন এ নিয়ে অনেক কথা বলেছেন, অনেক উদাহরণ দিয়েছেন।) পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাংক দুঃখ করে বলেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের মত জায়গা, যেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একটা ফলাফল পাওয়ার প্রচলন, সেখানেও নতুন কোন মতের বিরুদ্ধে থাকে একাডেমি।
ইকোনোমিকসের একটি বড় তত্ত্ব ইনফরমেশন এসিমেট্রি, যাকে বলা হয় ইনফরমেশন ইকোনোমিকসের এক ভিত্তি প্রস্তর। এর জন্য অর্থনীতিবিদ জর্জ কার্লফ (পিডিএফ লিংক) যুগ্নভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন পরবর্তীতে। কিন্তু ১৯৬০ এর শেষ দিকে তিনি যখন তার পেপার “দ্য মার্কেট ফর লেমনস” প্রকাশ করতে দেন তখন অর্থনীতির তিনটি প্রথম স্থানীয় জার্নাল তা প্রত্যাখ্যান করে।
এরকম আরো অনেক অনেক বড় আইডিয়া, তত্ত্ব গ্রহণ করতে চায় নি একাডেমি। যেগুলো তাদের প্রত্যাখানের পরেও পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়ে একাডেমীদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বিজয়ী হতে পেরেছে, তাদের আমরা দেখতে পারছি। কিন্তু হয়ত এমন অনেক আইডিয়া একাডেমিক অথরিটির অগ্রহণমূলক মনোভাবের কারণে হারিয়ে গেছে তাদের কথা আমরা জানি না। এই সংখ্যা নিশ্চয়ই কম না।
মানুষের অথরিটি মানার প্রবণতা – স্ট্যানলি মিলগ্রামের পরীক্ষা
স্ট্যানলি মিলগ্রাম নামে একজন সাইকোলজিস্ট বেশ কিছু পরীক্ষা করেছিলেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হলো, শাস্তি এবং স্মৃতিশক্তির উপরে এর প্রভাব জানতে পরীক্ষা করা হবে, ভলান্টিয়ার আবশ্যক।
পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে ভলান্টিয়ার এলেন। মিলগ্রাম তাদের দুজনকে বুঝিয়ে দিলেন পদ্বতি। একজন হবেন ছাত্র, একজন শিক্ষক। ছাত্র কিছু শব্দ মুখস্ত করবেন। তারপর তাদের দুইটা জায়গায় নেয়া হবে। ছাত্রকে চেয়ারে আটকে দেয়া হবে। তার হাতের আঙুলে রাখা হবে ইলেক্ট্রিক শকের ব্যবস্থা।
আরেকটি কক্ষে থাকবেন শিক্ষক। তিনি ছাত্রকে দেখতে পারবেন। এবং ইন্টারকমে তিনি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে। ছাত্র বলতে পারলে ঠিক আছে। বলতে না পারলে শাস্তিস্বরূপ তিনি সুইচ টিপে তাঁকে ইলেক্ট্রিক শক দিবেন। প্রতি শকে ইলেট্রিসিটির মাত্রা পাঁচ ভোল্ট করে বাড়বে।
এভাবে পরীক্ষা শুরু হলো। দেখা গেল ইলেক্ট্রিক শকের মাত্রা বাড়ছে, ছাত্র শক খেয়ে কাতরাচ্ছেন আর এদিকে শিক্ষক শক দিয়ে চলেছেন। শক দিতে গিয়ে ছাত্রের কষ্ট দেখে তার মানসিক অবস্থাও খারাপ হয়ে উঠেছে। কিন্তু পরীক্ষক না বলা পর্যন্ত তিনি থামলেন না। এভাবে প্রায় চল্লিশটির মত পরীক্ষা করেছিলেন মিলগ্রাম। মানুষ কীভাবে অথরিটি মানে তা দেখার জন্যই এই পরীক্ষা। দেখা গেছে মাত্র, ছাত্র যখন চিৎকার করছে ব্যথায়, তাকে ছেড়ে দেবার জন্য বলছে তখনো কোন লোক তার শিক্ষকের পজিশন অর্থাৎ ব্যথা দেয়ার অবস্থান ছাড়ে নি।
যখন শকের মাত্রা ৩০০ ভোল্টে পৌছে এবং ভিক্টিমের চিৎকার আতংকজনক অবস্থায় যায়; তখনো অল্প সংখ্যাগরিষ্ট লোক শক থামায়। বাকীরা ঠিকই শক দিতেই থাকে। ৪০ টা স্যাম্পলের তিন ভাগের দুই ভাগই যত ভোল্ট ছিল তার সব সম্পন্ন করে এবং সর্বশেষ ৪৫০ ভোল্টের শক চাপতে যায়।
মানুষের এই অথরিটি মানার প্রবণতা মিলগ্রাম ও তার সহযোগীদের পর্যন্ত বিস্মিত করে।
(এই পরীক্ষায় শক খেতে থাকা ছাত্ররা ছিলেন প্রফেশনাল অভিনেতা। তাদের সত্যি সত্যি শক দেয়া হয় নি।)
ব্রায়ান উইলসন ও তার পা
ব্রায়ান উইলসন একজন আমেরিকান ভেটেরান। তিনি ভিয়েতনামে আমেরিকান এয়ার ফোর্স কম্ব্যাট সিক্যুরিটি অফিসার হিসেবে চার বছর যুদ্ধ করেন। ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন। পরবর্তীতে তার অবস্থান হয় যুদ্ধবিরোধী।
১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখে নিকারাগুয়ায় আমেরিকান আর্মির অস্ত্র ইত্যাদির শিপমেন্ট যাওয়ার কথা ছিল ট্রেইনে করে। উইলসন এর প্রতিবাদ করেন। তিনি এবং আরো দু’জন লোক ঠিক করলেন রেল লাইনে শুয়ে থেকে তারা ট্রেন আটকাবেন। তিন দিন আগে তারা নেভি এবং রেল কর্তৃপক্ষকে তাদের পরিকল্পনার কথা জানান। তাদের ধারণা ছিল তাদের শুয়ে থাকতে দেখে ট্রেইন থামাবে যেহেতু আগেই তারা প্রতিবাদের কথা জানিয়ে রেখেছেন।
কিন্তু ট্রেইনের লোকদের থামার নির্দেশ দেয় নি কতৃপক্ষ। সুতরাং, সিভিলিয়ান ক্রুরা ট্রেইন থামাল না, যদিও প্রায় ছয় শত ফিট দূর থেকে তারা প্রতিবাদকারীদের দেখতে পাচ্ছিল। অন্য দুজন লোক সরতে পেরেছিলেন। উইলসন দ্রুত সরতে পারেন নি। তাই ট্রেইনে তার পা কাটা পড়ে।
নেভির এম্বুলেন্স আহত উইলসনকে হাসপাতালেও নিয়ে যায় নি। প্রায় ৪৫ মিনিট রক্তের মধ্যে ভিজে থাকেন উইলসন। পাশে স্ত্রী পুত্র। ৪৫ মিনিট পরে একটি প্রাইভেট এম্বুলেন্স আসে এবং তাতে করে উইলসনকে হাসপাতালে নেয়া হয়।
উইলসন এই সমস্ত ঘটনায় ট্রেনের ক্রু বা নেভির এম্বুলেন্সের লোকজনদের দায়ী করেন নি। তিনি তার অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন অথরিটির বিরুদ্ধে। ভিয়েতনামে যুদ্ধ করা উইলসন জানতেন অথরিটি আনুগত্যের কথা। তিনি বলেছিলেন, “তারা তাই করেছে যা আমি করেছিলাম ভিয়েতনামে। তারা যাদের নির্দেশ মেনেছে তারা একটি উন্মাদ পলিসির অংশ। তারা দূর্ভাগা।”
ট্রেনের ক্রুরা উলটা উইলসনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। তারা অভিযোগ করে তিনি তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে মানসিক চাপ, ফিজিক্যাল স্ট্রেস ইত্যাদি তৈরী করে বাঁধা দিয়েছেন।
এইরকম আরো অনেক বাস্তব ঘটনা পাওয়া যাবে মানুষের অথরিটি মানার। বিভিন্ন যুদ্ধে অথরিটির নির্দেশে মানুষ হত্যা এক মূর্তমান প্রমান অথরিটি মানার। যে যাকে মারছে, তারা দুজনের একে অন্যের সাথে কোন শত্রুতাই নেই। এই দুই ঘটনার আরো বিস্তারিত জানার আগ্রহ থাকলে পড়তে পারেন প্রফেসর রবার্ট চিয়ালদিনির বই ইনফ্লুয়েন্স।
হত্যারহস্য বা এক্সপার্টদের ভুল বিত্তান্ত
ইনভেস্টর পিটার বেভেলিনের সিকিং উইজডমে এই ঘটনা আছে। ১৯৭৭ সালে স্কটল্যান্ডে একটি খুনের মামলার তদন্ত শুরু হয়। একজন মহিলা পুলিশ অফিসারের উপর ন্যস্ত হয়েছিল সেই দায়িত্ব। তিনি তদন্ত করতে গেলেন। কিন্তু ফরেনসিক তদন্তে বেরিয়ে এলো বিস্ময়কর তথ্য। খুন হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে যে ঘরে পাওয়া গিয়েছিল ঐ ঘরে পুলিশ অফিসার ভদ্রমহিলার বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ।
ভদ্রমহিলা শপথ করে বললেন, তিনি খুন করেন নি। তিনি ঐ ঘরেই ঢুকেন নি।
স্কটিশ ক্রিমিনাল রেকর্ডের চারজন এক্সপার্টকে আনা হলো। তারা বেশ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানালেন, এই আঙ্গুলের ছাপ ভদ্রমহিলারই।
ভদ্রমহিলাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। মামলা করা হলো তার বিরুদ্ধে।
এবং শেষ পর্যন্ত বের হলো, আঙ্গুলের ছাপ ভদ্রমহিলার ছিল না। ওটা বুড়ো আঙ্গুলের ছাপই নয়। তর্জনীর ছাপ।
এক্সপার্টেরাও ভুল করেন। এবং তাদের ভুল বিশ্বাস করে জনতা পতিত হয় মহাভূলে। এক্সপার্টদের কথাকে মানুষ প্রশ্ন করে না। আমেরিকান মেডিক্যাল সিস্টেমে অথরিটির হায়ারার্কি মানার প্রবণতা নানা ভুলের তৈরী করে সেসবের বিস্তারিত নিয়ে বই লিখেছেন দুজন ফার্মাকোলজি প্রফেসর মাইকেল কোহেন এবং নীল ডেভিস। প্রফেসর কোহেন একটা কাহিনী উল্লেখ করেছেন যা থেকে শুধু মেডিক্যাল নয়, সব ধরনের এক্সপার্টকে মানুষ বুঝে কিংবা না বুঝে কতো অন্ধভাবে অনুকরণ করতে পারে, তা বুঝা যেতে পারে।
এক রোগী এসেছে কানের সমস্যা নিয়ে। ডাক্তার রোগী দেখে একটা কানের ড্রপ দিলেন। প্রেসক্রিপশনে লিখলেন, “প্লেইস ইন “আর” ইয়ার।”
রাইট ইয়ার অর্থাৎ ডান কান বুঝাতে তিনি আর লিখেছিলেন। পুরা রাইট লিখেন নি।
নার্স ভাবল এই “আর” মানে রেকটাম।
তাই সে ড্রপ রোগীর পায়ুপথেই দিয়ে দিল। কানের ব্যথায় পায়পথে ড্রপ কেন দিচ্ছে নার্সের মনে এই প্রশ্ন আসে নি, রোগীর মনেও আসে নি ওখানে কেন সে ড্রপ নিচ্ছে।
এক্সপার্টদের অন্ধভাবে মানার আগে এই ঘটনা মনে করতে পারেন।
ভবিষ্যতবানী ও এক্সপার্ট
মানুষকে বিশ্বাস করানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের অথরিটি তৈরী করে অন্য মানুষেরা। যেমন, এক্সপার্টদের নামের সাথে লেজ হিসেবে তারা কোন বিষয়ে এক্সপার্ট তা বুঝাতে লেজ যুক্ত করে। এর উদাহরণ হিসেবে শেয়ার বাজার কেন্দ্রিক একটা চিন্তামূলক উদাহরন দেয়া যায়, তা আমি জানতে পেরেছি প্রফেসর সঞ্জয় বক্সীর লেখা পড়ে।
অথরিটি তৈরীর কারণ হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরী। ধরেন আপনি একজন শেয়ার বাজারের ইনভেস্টর। একদিন সকালে ইমেইল পেলেন আগামী মাসে “এক্স” কোম্পানির শেয়ারের দাম শতকরা ৫ ভাগ বাড়বে। খুব সুন্দর করে ইমেল লেখা হয়েছে, যিনি পাঠিয়েছেন তার নামের শেষের ডিগ্রী দেখে আপনি বুঝলেন তিনি একজন বড় অর্থনীতিবিদ। নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বললেন, ট্র্যাডিশনাল ইকোনমিক ফোরকাস্টে তিনি বিশ্বাস করেন না। তাই চাকরী ছেড়ে দিয়েছেন। এবং নিজস্ব পদ্বতি বের করেছেন প্রেডিকশনের।
তবুও আপনি বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু মাসশেষে দেখলেন সত্যিই ঐ কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে, ৭%।
পরের মাসে আবারও ইমেল পেলেন। এবার একটু মনযোগ দিয়ে পড়লেন। সেই একইরকম লেখা। যিনি পাঠিয়েছেন তিনি কোন টাকাও দাবী করছেন না। তার এবারের প্রেডিকশন “এক্স” কোম্পানির শেয়ারের দাম মাসের শেষে শতকরা ৫ ভাগ কমবে।
এই মাসেও আপনার বিশ্বাস হল না। কিন্তু দেখলেন সত্যিই ঐ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে, ৬%।
এইভাবে প্রায় প্রতিমাসেই ইমেইল পেতে লাগলেন। প্রতিমাসেই প্রেডিকশন মিলে যেতে লাগলো। আপনি ঐ ভদ্রলোকের প্রেডিকশনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং তাকে বিশ্বাস করে ফেললেন।
এখন ঐ ইমেল পাঠানো লোকটার কাছে যাওয়া যাক। সে এক ধান্দাবাজ। সে প্রথমে শেয়ার বাজারে নিয়মিত ইনভেস্ট করে এমন লাখ তিনেক ইমেল সংগ্রহ করেছে। এরপর কোন এক কোম্পানি বের করেছে যার শেয়ার মাসে উঠানামা করে এবং সে আইডিয়া করে নিতে পেরেছে হয়ত তা ৫% কমবে বা ৫% বাড়বে অথবা ৫% কমা আর ৫% বাড়ার মাঝামাঝিতে অবস্থান করবে।
সে তার সংগ্রহ করা ইমেইলকে ভাগ করেছে তিনভাগে।
একভাগে – ৫% কমা
একভাগে – ৫% বাড়া
একভাগে – ৫% কমা ও ৫% বাড়ার মাঝামাঝি
এই তিন প্রেডিকশন করে সে তিনটা ইমেইল তৈরী করেছে। আর তিনভাগ লোককে পাঠিয়ে দিয়েছে। তার একটা প্রেডিকশন ঠিক হবে। অর্থাৎ তিন লাখের তিন ভাগের এক ভাগ লোক ঠিক প্রেডিকশন পাবে।
পরবর্তীতে মাসে সে এই ঠিক প্রেডিকশন পাওয়া লোকদের মাঝে তিনভাগ করে তাদের তিনটা প্রেডিকশন পাঠিয়ে দেবে।
এর এক ভাগ ঠিক প্রেডিকশন পাবে।
এই এক ভাগকে তিনটা প্রেডিকশন করে সে আবার পাঠিয়ে দেবে পরের মাসে।
এখন কথা হচ্ছে তার লাভ কী?
প্রথম মাসে তিন লাখে ঠিক প্রেডিকশন পেল – ৩০০০০০/৩ = ১ লাখ
দ্বিতীয় মাসে ঠিক প্রেডিকশন পেল – ১ লাখ/৩ = প্রায় ৩৩ হাজার
তৃতীয় মাসে ঠিক প্রেডিকশন পেল – ৩৩ হাজার/৩ = প্রায় ১১ হাজার
চতুর্থ মাসে ঠিক প্রেডিকশন পেল – ১১ হাজার/৩ = প্রায় ৩৫০০
পঞ্চম মাসে ঠিক প্রেডিকশন পেল – ৩৫০০/৩ = প্রায় ১ হাজার
এখন এই পঞ্চম মাস পর্যন্ত ঠিক প্রেডিকশন পেয়ে এসেছেন একজন লোক। তিনি এই প্রেডিকশনকে বিশ্বাস করে ফেলেছেন। পঞ্চম মাসের পরে ইমেইল এলো পরবর্তী মাসে আছে বিশাল অফার। আঠারোটি কোম্পানির এনালাইসিস। আমার দীর্ঘদিনের গবেষনার ফসল। আগামী সংখ্যার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন। দাম মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা।
পঞ্চম মাস পর্যন্ত ঠিক প্রেডিকশন পেয়ে আসা অধিকাংশ মানুষই তা বিশ্বাস করে ফেলবে। যদি অর্ধেক অর্থাৎ ৫০০ জনও সাবস্ক্রাইব করে তাহলে তার লাভ ১৫০০০০০০!
অনেকে সাবস্ক্রাইব করে ত্রিশ হাজার লস করবেন তো ঠিক আছে, আবার তার প্রেডিকশন মত ইনভেস্ট করেও বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
এভাবে অথরিটি তৈরী করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষেরা অন্য মানুষদের বোকা বানাতে পারে।
এসব ক্ষেত্রে কমন সেন্স কাজ করে না। কেউ প্রশ্ন করে না যে সে যদি জানে ভবিষ্যতে কী হবে তাহলে নিজে কেন ইনভেস্ট করে না? অথবা পৃথিবীতে যে বড় বড় পিইচডিওয়ালা ইকোনমিস্টেরা আছেন, তাদের ফোরকাস্ট যদি কাজ করত তাহলে তারা সবাই নিশ্চয়ই মিলিওনিয়ার হয়ে যেতেন।
অনলাইনে অথরিটি – এক্সপার্ট
অনলাইনেও অনেক জায়গায় দেখবেন এফিলিয়েট মার্কেটিং করে অনেকে কাড়ি কাড়ি টাকা কামাচ্ছে। তার স্ক্রিণশট আপনাকে দেখাচ্ছে। কতো লাখ ডলারে ওয়েবসাইট বিক্রি করল তা দেখাচ্ছে। এবং চালু করেছে একটি এফিলিয়েট মার্কেটিং কোর্স, যা আপনি ধরেন দশ হাজার টাকা দিয়ে করতে পারবেন।
এখন প্রশ্ন হলো, যে লোক নিজে এতো এতো টাকা উপার্জন করছে এফিলিয়েট মার্কেটিং করে, সে কেন তার মূল্যবান সময় ব্যয় করে অল্প টাকায় কোর্স করাতে যাচ্ছে?
আরো দেখবেন নানা ধরনের প্লাগিন যার দাম ধরেন দশ ডলার থেকে একশো, এরকম প্রোডাক্ট সে তার সাইটে লিংকে লিংকে জুড়ে দিচ্ছে। প্রশ্ন হল, পঞ্চাশ ষাট হাজার টাকায় নিত্য সাইট বিক্রি করা লোক এরকম প্রোডাক্ট লিংক তার পার্সোনাল সাইটে রাখবে কি? এইসব অল্প টাকার এফিলিয়েট লিংক যুক্ত করার সময় দিয়ে সে আরেকটা সাইট বানিয়ে লাখ ডলারে বেঁচে না কেন?
যারা নিজেদের এক্সপার্ট বলে দাবী করে এরা প্রথমে তা প্রমাণ করতে চায়। এজন্য সে টাইটেল, পোষাক ব্যবহার করে, অনলাইনে ব্যবহার করে স্ক্রিনশট, নানা ধরনের প্রুফ।
সে প্রথমতো আপনারে বুঝাতে চায় আপনার যে সে উপকার করছে এতে তার কোন উপকার নাই। যখন মানুষ দেখে এখানে এক্সপার্টের কোন লাভ নাই অথবা তার বরং কিছু ক্ষতি হচ্ছে, সময় ব্যয় হচ্ছে তখন মানুষ তার অথরিটিকে বিশ্বাস করে ফেলে। অথরিটি বা এক্সপার্ট বলে দাবী করা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই টেকনিক ব্যবহার করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে নেয়। এবং এর পরে সে ঠিকই তার প্রফিট বের করে থাকে যারা তাকে বিশ্বাস করেছে তাদের কাছ থেকে।
ডিজিটাল মার্কেটিং এর দুনিয়ায় একটা কথাই প্রচলিত আছে ফেইক ইট বিফোর ইউ মেইক ইট। অর্থাৎ প্রথমে ফেইকভাবে দেখান আপনার সাকসেস। এতে লোকে আপনাকে বিশ্বাস করবে এবং আপনি সত্যি সাকসেস পেয়ে যাবেন। সফল ডিজিটাল মার্কেটার নীল প্যাটেলের মূলমন্ত্রও এটাই। অর্থাৎ, একটা ধোঁকা সিস্টেম এখানে আছে। সান জু তার আর্ট অব ওয়ারে যেমন বলেছিলেন প্রত্যেক যুদ্ধ জয়ই ধোঁকার উপরে নির্ভর করে। ক্যাপিটালিস্ট দুনিয়ায় মার্কেটিং এ সান জু’র বইকে গুরুত্ব দেবার একটা ব্যাপার আছে, বিজনেসকে তুলনা দেয়ার প্রচলন আছে যুদ্ধের সাথে, আমার ধারণা এই ধোঁকাবাজি সফলতার ধান্ধা এই বই থেকে অনুপ্রাণিত। তবে সবাই যে এই পদ্বতি অনুসরন করেন এমন নয়।
অথরিটির ভুল প্রভাব থেকে বাঁচবেন কী প্রকারে
মানুষের অথরিটি বিশ্বাস ও মানা আলোচনা করা হল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অথরিটির ভুল প্রভাব থেকে বাঁচবেন কী ভাবে?
অথরিটিকে না বলুন। সাধারণ এবং সরল বুদ্ধি ব্যবহার করে দেখার চেষ্টা করুন, অথরিটি আপনাকে যা করতে বলছেন তা নৈতিক কী না, তিনি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য অথরিটি কী না।
যে কেউ নিজেরে দাবী করতে পারে এক্সপার্ট। বিশেষত অনলাইনে এটা আরো সহজ। এটা যে কতো সহজ আপনি একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন। তার ফেইসবুক প্রোফাইলে ডিগ্রী টিগ্রী লাগাতে পারবে কয়েক ক্লিকে। দশ জন ভাই বেরাদার তার প্রশংসা করে যাবে নিয়মিত। তারা বলবে তার অমুক কোর্স করে সে এই উন্নতি করেছে। তারা স্ক্রিণশট বানাতে পারবে। ফলে, কেউ এক্সপার্ট দাবী করলেই তাকে বিশ্বাস করার কোন কারন নেই।
সত্যিকার এক্সপার্টরা অবশ্যই আছেন। তাদের ছোট করার কিছু নেই। কিন্তু ফেইক এক্সপার্ট আর সত্যিকার এক্সপার্টদের আলাদা করতে জানতে হবে।
কোন বক্তব্য, অবস্থান বা উপদেশ নিজে বিচার করে দেখুন। বড় এক্সপার্টও ভুল করতে পারেন। যেহেতু তিনি মানুষ। ফলে অন্ধ অনুকরণ না করে, তার ডিগ্রী ফিগ্রী বা স্ট্যাটাসের দিকে না তাকিয়ে তার বক্তব্যকে বিচার করা দরকার।
আপনাকে যা করতে বলছেন এক্সপার্ট তাতে তার কোন স্বার্থ আছে কী না ভেবে দেখতে হবে। এমনো হতে পারে প্রাথমিকভাবে দেখলে মনে হবে উনার কোন স্বার্থ নেই। কিন্তু তলিয়ে দেখলে তার স্বার্থটা ভেসে উঠবে। আর তখন আপনি এক্সপার্ট আপনাকে ঐ কাজ কেন করতে বলেছেন তা বুঝতে পারবেন।
মানসিক নকশাঃ অথরিটির ভুল প্রভাব থেকে বাঁচার কী উপায়?
এই লেখার তথ্যসূত্র বা যাদের কাছ থেকে এর বিভিন্ন উদাহরণ, আইডিয়া পাওয়া আছে তা স্থানে স্থানে উল্লেখ আছে। তবুও পুনরায় উল্লেখ। প্রথমত গ্রেট চার্লি মাঙ্গার। প্রফেসর রবার্ট চিয়ালদিনির ইনফ্লুয়েন্স। পিটার বেভেলিনের সিকিং উইজডম। প্রফেসর সঞ্জয় বক্সীর লেখা। দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেক। ফিচার ইমেজ হিশেবে জ্যাক নিকলসনের জোকার ইমেজের পেনসিল স্কেচ ব্যবহার করা হয়েছে, এটি এঁকেছেন র্যান্ডি এটউড।