“আমার কাছে তারকোভস্কি হচ্ছেন মহত্তম শিল্পী যিনি নতুন ভাষা আবিষ্কার করেছেন, আবিষ্কার করেছেন ফিল্মের সত্যিকার চরিত্র। যা জীবনকে ধরে প্রতিবিম্ব হিসেবে, স্বপ্নের মত।”
রাশিয়ান ফিল্ম নির্মাতা আন্দ্রে তারকোভস্কি বিষয়ে কথাটি বলেছেন আরেকজন বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ইংমার বার্গম্যান।
তারকোভস্কির স্টকার ফিল্মে দেখা যায় একজন স্টকার যে একটি অদ্ভুত জায়গায় মানুষদের নিয়ে যায়। জায়গাটাকে বলা হয় জোন। বলা হয় এখানে এলিয়েনরা এসেছিল অনেক আগে। তারপরে আশপাশের মানুষেরা অদৃশ্য হতে থাকে। এখন পরিত্যক্ত জায়গা। কিন্তু এটি কঠিন পাহাড়া দিয়ে রাখা হয়। কেউ এদিকে আসতে চাইলে কোন কিছু না ভেবেই গুলি করা হয়।
সেই জোনের ভিতরে একটা জায়গা আছে যাকে বলা হয় রুম। রুম জায়গাটিতে গিয়ে মানুষ কোন ইচ্ছা প্রকাশ করলে তা পূরণ হয়। স্টকার চরিত্রটি খুব অদ্ভুত। তাকে দেখে মনে হয় সব সময় সে একটা অশান্তিতে আছে। মনে হয় তার ভেতরটা নিয়মিত বিরতিতে ভেঙে পড়ছে।
যদিও সে টাকার বিনিময়ে জোনে লোকদের নিয়ে আসে তবুও ফিল্মের অগ্রগতির সাথে বুঝতে পারা যায় সে টাকার জন্য কাজটা করে না। সে এমনিই কাজটা করে। নিজের শান্তির জন্য।
একজন লেখক এবং একজন প্রফেসর স্টকারের সাথে যান জোনে। দেখা যায় স্টকার জোনে গিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে বারবার। মনে হয় সে সামান্য শান্তির জন্য কারো কাছে আশ্রয় নিচ্ছে। নিজেকে সমর্পন করে দিচ্ছে কারো কাছে।
একবার স্টকার যখন মাটিতে ঘুমিয়ে ছিল তখন তার পানির ধারায় ধীরে ধীরে ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে এক অসাধারণ স্বপ্ন-দৃশ্যের অবতাড়না করেছেন পরিচালক তারকোভস্কি। এটা তারকোভস্কির নিজস্ব স্টাইল মনে হয়। তার অন্য আরেকটি বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন ফিল্ম সোলারিসেও প্রায় একইধরনের কিছু দৃশ্য আছে। পানির ধারার মধ্যে বিভিন্ন প্রাচীন মেশিনারি যন্ত্রাংশ দেখা যায়। এটা স্টকারের মনের অবস্থা প্রকাশ করছে যেন।
এছাড়া পুরো ছবিতে যে ভাঙাচুরা শহরের প্রতিচ্ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে সেটাও আধ্যাত্বিকতাহীন মানুষের মনের অবস্থা নির্দেশক।
জোনে স্টকার নিজেকে সমর্পন করে দেয় এটা স্পিরিচুয়ালিটির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়া।
জোনে চলার সময় বিভিন্ন লোহার নাটে কাপড় বেঁধে ঢিল ছুঁড়ে মারে স্টকার। তারপর সেদিক দিয়ে হেটে যায়। সে বলে এবং বিশ্বাস করে এভাবেই যেতে হবে রুমে। সরাসরি হেটে যাওয়া যাবে না, গেলে বিপদ হবে। সে অযৌক্তিক এবং কুসংস্কার মূলক এই কাজ করে। এর দ্বারা স্পিরিচুয়াল কর্মকান্ড অযৌক্তিক হলেও তার প্রতি স্টকারের আস্থা এবং বিশ্বাস প্রকাশ পায়।
লেখক এবং প্রফেসর এতে বিরক্তি প্রকাশ করেন।
শেষ পর্যন্ত রুমে পৌঁছার পর জানা গেল সাধারণ ইচ্ছা রুম পূরণ করে না, ইনারমোস্ট ইচ্ছা পূরণ করে। এবং আগে এতে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে জেনে লেখক বিব্রত হন। এছাড়া রুম থেকে ইচ্ছা পূরণ করে গিয়ে কেউ সুখী হয়েছে এমন কথাও স্টকার বলতে পারল না। কারণ জোন থেকে চলে যাবার পর তাদের সাথে তার আর কখনো দেখা হয় না।
অর্থাৎ জোনের ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। এমনকী জোন থেকে ফিরে আসার পরও যখন লেখক ও প্রফেসরের অবিশ্বাস রয়ে গেল, তখনো জানা গেল না জোনের ক্ষমতা সত্যি কী না।
শেষে ক্লান্ত স্টকার তার ঘরে গিয়ে লোকদের অবিশ্বাস নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে। কেউ যে জোনের ব্যাপারে বিশ্বাস করছে না এই নিয়ে তার দুঃখ। জগতের লোকদের বিশ্বাসহীনতায় দুঃখ ভারাক্রান্ত হয় সে।
স্পিরিচুয়ালিটিহীন আধুনিক মানুষদের অবিশ্বাস বা র্যাশনালিটির জন্য দুঃখিত হতে দেখা গেল তাকে।
এই পর্যন্ত ফিল্মটাতে পরিচালকের কোন সরাসরি কোন মেসেজ ছিল না। অর্থাৎ স্টকারের পক্ষ থেকে তার দুঃখের কিছু কারণ ছিল। লেখক ও প্রফেসরেরও তাদের নিজেদের পক্ষে কিছু কারণ ছিল। যদিও স্টকারই মূল ভূমিকায় এবং তাকেই মূল প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এবং তাকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে ফিল্মের পরিবেশ।
কিন্তু শেষ দৃশ্যে স্টকারের বউয়ের কথোপকথনে উঠে এল সে কেন স্টকারকে বিয়ে করল ইত্যাদি বিষয়। প্রথম দৃশ্যে দেখা গিয়েছিল স্টকার যখন জোনে যেতে বের হয় তখন তার বউ বাঁধা দেয় এবং সে বাঁধা না মেনে চলে গেলে কাঁদে। মাটিতে পড়ে এমন কান্নার দৃশ্যও অভিনব।
কিন্তু শেষ দৃশ্যে তার বউ স্বীকার করে স্টকারের সব বিষয় জেনেই সে বিয়ে করেছে তাকে। স্টকার যে জোনে যায় এতে তাদের বাচ্চার উপর প্রভাব পড়তে পারে এটাও সে জানত।
তাদের মেয়েটাকে দেখা যায় শেষ দৃশ্যে। এর আগে অবশ্য একবার দেখা গিয়েছিল। তার সাথে ক্র্যাচ ছিল। তাই বলা যায় সে হাটতে পারে না। তার মাথাও অদ্ভুতভাবে কাপড়ে ঢাকা।
কিন্তু শেষ দৃশ্যে যখন দেখা গেল সে চোখ দিয়ে তাকিয়ে টেবিলে বিভিন্ন জিনিস সরিয়ে ফেলতে পারে। তার ক্ষমতাটা বুঝা গেল। দেখা গেল সে স্পর্শ না করে জিনিস সরাতে পারে।
একটা অযৌক্তিক বিষয়।
কিন্তু এর দ্বারা পরিচালক তার মেসেজ দিলেন। তিনি বুঝালেন জোনের ক্ষমতার ব্যাপারটা সত্যি।
অর্থাৎ যুক্তি ও বিশ্বাসের মধ্যে তিনি বিশ্বাসের দিকে চলে গেলেন। পুরো ফিল্মে যে স্পিরিচুয়ালিটির ইঙ্গিত আছে, সেই স্পিরিচুয়ালিটির পক্ষেই তিনি শেষ কথা বললেন।
বিশ্বাস এবং যুক্তির দ্বন্দ্ব নিয়ে আরেকটি সাই ফাই ফিল্ম কনটাক্ট। সেখানে এলি নামের একজন বিজ্ঞানী মেয়েকে দেখানো হয় যে ভীন গ্রহবাসীদের খোঁজে গবেষণা করে। সে ছিল র্যাশনালিস্ট। মানে তার গডে বিশ্বাস নাই। তার সাথে পরিচয় হয় পালমার নামের একটি ছেলের যে গডে বিশ্বাসী এবং একসময় ধর্ম প্রচারক হতে চেয়েছিল। যদিও সে যথেষ্ট উদার কিন্তু তার এবং এলির কথাবার্তায় উঠে আসে বিশ্বাস ও যুক্তির দ্বন্দ্ব।
একসময় এলি একটা যন্ত্রে করে ভেগান গ্রহে যায় এলিয়েনদের সাথে দেখা করতে। সে গ্রহের প্রানীর সাথে কথা বলে আসে। কিন্তু আসার পর শুনতে পায় যন্ত্রটা নাকী কাজ করে নি। অর্থাৎ যন্ত্র কোথাও যায় নি। সে সবাইকে বলে ভেগান গ্রহবাসীদের সাথে তার কথা হয়েছে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না। তারা প্রমাণ চায়। তখন এলি জানায় একমাত্র বিশ্বাস ছাড়া তার কাছে আর কোন প্রমান নাই।
অর্থাৎ যুক্তিবাদী এলি ফিরে আসে বিশ্বাসে। বিশ্বাসের সাথে তার বিরোধের অবসান হয়।
শেষ পর্যায়ে সরকারী উচ্চ পর্যায়ে জানা যায় এলি হয়ত সত্যি সত্যি এলিয়েনদের সাথে কথা বলেছে এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু রাজনৈতিক খাতিরে সেগুলো ধামাচাপা দেয়া হয়।
অর্থাৎ দেখানো হয় এলির বিশ্বাসের বিষয়টা সত্যি ছিল। বিজ্ঞান এবং বিশ্বাসের দ্বন্দ্বের এমন সমাধান দারুণ।
কনটাক্ট কার্ল স্যাগানের সায়েন ফিকশন উপন্যাস থেকে বানানো হয়েছে। আর স্টকার বানানো হয়েছে আর্কাদি স্টোগাটস্কি ও বরিস স্টোগাটস্কি ভ্রাতাদ্বয়ের রোডসাইড পিকনিক নামের একটি গল্প থেকে। এই ভ্রাতৃদ্বয় অসাধারণ কিছু সাই ফাই লিখে গেছেন।
নির্মানের দিক থেকে স্টোকারের সাথে কনটাক্টের তুলনা হয় না। কিন্তু যেই দ্বন্দ্ব নিয়ে কাজ করা হয়েছে ফিল্মদুটিতে সেখানে স্টোকারে সরাসরি অবস্থান নেয়া হয়েছে স্পিরিচুয়ালিটির পক্ষে, কনটাক্টে এমন নেয়া হয় নি। কনটাক্টে বিজ্ঞান এবং বিশ্বাসের একটা সামঞ্জস্য বিধান করার চেষ্টা করা হয়েছে।
কনটাক্টে দেখা যায় একটার পর একটা ওয়ার্মহোলের ভিতর দিয়ে যায় এলি ভেগান গ্রহের বাসিন্দাদের সাথে দেখা করতে। তেমনি স্টোকারে দেখা যায় একটা সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে লেখক, প্রফেসর এবং স্টোকার যান রুমের ভেতরে। এই ওয়ার্মহোল বা সুড়ঙ্গ আসলে কী?
হয়ত বুঝানো হয়েছে মানুষের নিজের ভেতরের কোন সূড়ঙ্গ যার ভেতর দিয়ে সে প্রবেশ করতে পারে তার ইনার সেলফে।