দেজা ভু বলে একটা ব্যাপার আছে। হয়ত কোথাও গিয়ে আপনার মনে হল সেখানে আপনি আগেও এসেছেন। কোন কাজ করতে গিয়ে মনে হল এই একই কাজ একইরকমভাবে আপনি আগেও করেছেন। কোন পরিবেশে গিয়ে মনে হল একই রকমের পরিবেশে আপনি আগেও ছিলেন। এই মনে হওয়াটাকে বলে দেজা ভু। মনে হয় প্রায় সব মানুষেরই এই অনুভূতি হয়।
কিন্তু এটা কেন হয়?
ধরেন এই পৃথিবী, আপনার এবং আমার চারপাশ একটি সিমুলেশন। কম্পিউটার সিমুলেশনের মত (যেমন, একটি গেম গ্র্যান্ড থেফট অটো) আমাদের যে বাস্তবতা সেটা একটা সিমুলেশন। আমাদের চিন্তা চেতনাও তার অংশ। ফলে আমরা কখনো সেটা ধরতে পারি না।
কিন্তু সিমুলেশন যতই উন্নত হোক না কেন তাতে কিছু ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। তাহলে আমাদের বাস্তবতার যে সিমুলেশন তাতেও ত্রুটি আছে। সেই ত্রুটিগুলোর কারণে আমরা কখনো কখনো ব্যাখ্যাতীত কোন বিষয় দেখে ফেলি। ধরা যাক, মানুষের প্যারানরমাল অভিজ্ঞতা কিংবা এই দেজা ভু এগুলো সেই সিমুলেশনের ত্রুটি, কিন্তু আমরা তা ধরতে পারি না। অথবা আমরা ভালোমত লক্ষ্য করি না।
সিমুলেশন হাইপোথিসিসের ব্যাপারে প্রথম বিস্তারিতভাবে তার ধারণা ব্যক্ত করেন দার্শনিক নিক বোস্ট্রম। মানুষেরা যে কম্পিউটার সিমুলেশন বানায় আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে সেগুলো আরো বেশি জীবন্ত ও শক্তিশালী হবে। তখন সেইসব সিমুলেশনে যদি কোন সত্তা থাকে তবে তার কাছে সেই সিমুলেশনের ত্রুটি ধরা পড়বে না। এভাবে আমরাও হয়ত একটা সিমুলেশনে আছি যা আমাদের পূর্বপুরুষেরা তৈরী করেছে। তারা আছে আরেকটা সিমুলেশনে যেটা তৈরী করেছে তাদের পূর্বপুরুষেরা।
অথবা এটা হতে পারে আমাদের সিমুলেশন তৈরী করেছে ভীনগ্রহবাসী কোন উচ্চ বুদ্ধিমত্তার এলিয়েন। এর সম্ভাবনা আছে। কারণ মহাবিশ্বে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ নক্ষত্র আছে। সেখানে অতি উচ্চ বুদ্ধিমত্তার প্রাণী থাকা স্বাভাবিক।
কার্ল স্যাগান লিখেছিলেন, এই দুনিয়ার সমস্ত সৈকতে যত বালুর দানা আছে, তার চেয়েও বেশি তারা আছে মহাকাশে।
স্যাগান একটা আন্দাজে বলছিলেন এক মুঠো বালুতে ১০ হাজার আলাদা কনা আছে ধরে নিয়ে। পরে বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে কাজ করেন এবং এস্টিমেট করেন ৭.৫ এর পরে ১৭টি জিরো দিলে যে সংখ্যা হবে ততোটা বালুর দানা আছে দুনিয়ায়। ৭.৫ বিলিয়ন বিলিয়ন।
স্যাগান তারার সংখ্যাটার কথা বলেছিলেন অনেক আগে। তারপর টেকনোলজিক্যাল বিভিন্ন উন্নতির সাথে সাথে নতুন নতুন তারা দেখার পদ্বতি আবিষ্কার হল। বিজ্ঞানীরা তারার সংখ্যাটা এস্টিমেট করলেন। এবং তা দাঁড়াল ৭০ হাজার মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন। ৭ দিয়ে ২২টি শূন্য। শুধু মাত্র হাবল প্রকল্পে দেখা যাওয়া অংশে তারার সংখ্যা।
স্যাগান বলেছিলেন দুনিয়ার সমস্ত বালুর দানার বেশি, বিজ্ঞানীরা দেখলেন প্রতিটি বালুর দানার বিপরীতে দশটি করে তারা ধরলেই শুধু মাত্র যেটুকু দেখা গেছে সেই অংশের তারার সংখ্যার সমান হবে। দুনিয়ায় যত সমুদ্রের পানি আছে সেগুলো যত কাপ হবে তার এগারো গুণ। দুনিয়ায় যত গমের দানা উৎপন্ন হয়েছে তার এগারো গুণ।
এটা খুব, খুব ছোট অংশের সংখ্যা। কারণ হাবল বিস্তৃত মহাবিশ্বের খুব ছোট অংশই দেখতে পারে। আরো কত কত ছায়াপথ রয়ে গেছে।
৮০ বিলিয়ন ছায়াপথ দেখেছে হাবলই।
আমাদের যে সূর্য, তার পাশের আট/নয়টা গ্রহ এরা মাত্র একটা ছায়াপথ। এর মাঝে আমাদের পৃথিবী একটা ক্ষুদ্র গ্রহ। আরো কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি ছায়াপথের মাঝে আছে অসংখ্য গ্রহ।
তাদের অনেকগুলোর মধ্যে প্রাণী থাকবে না এ হয় নাকী? যদি এই বিশালতার মধ্যে আমরাই মাত্র একা বুদ্ধিমান প্রাণী হয়ে থাকি তাহলে কার্ল স্যাগান কনটাক্টে যা বলেছিলেন সেটাই বলা যায়,
‘The universe is a pretty big place. If it’s just us, seems like an awful waste of space.’
ধরা যাক, সেই বুদ্ধিমান প্রাণীরা তৈরী করেছে আমাদের এই সিমুলেশন। যা আমরা দেখি, যাতে আমরা জীবন যাপন করি। আমাদের হিংস, বিদ্বেষ, ঘৃণা এবং ভালোবাসা সবই এই সিমুলেশনের মধ্যে। যাকে আমরা বাস্তব বলে ভূল করি। প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক শংকরাচার্যের মায়াবাদের কথা মনে হয়। শংকরাচার্জ বলেছিলেন ব্রহ্মই সত্য, জগত মিথ্যা। জগতের সবই মায়া। তার মতে ব্রহ্মই হয়ত ছিলেন সেই মহা প্রোগ্রামার।
আমাদের অস্তিত্ব কী কোন সিমুলেশন এ নিয়ে অর্থাৎ আমাদের অস্তিত্বের সমস্যা নিয়ে অনেক সায়েন্স ফিকশন ফিল্ম হয়েছে। এরমধ্যে অনেকগুলো আছে বিখ্যাত। তবে আমি যে মুভিটার কথা বলব সেটা বিখ্যাত নয়, আন্ডাররেটেড মুভি। নাম একজিসটেনজ। ১৯৯৯ সালে নির্মিত কানাডিয়ান সায়েন্স ফিকশন ফিল্ম। শুরু হয় একটা নিকঠ ভবিষ্যতে। যেখানে গেম পডের পরিবর্তে অর্গানিক ভার্চুয়াল রিয়ালিটি গেম কনসোল ব্যবহার করা হয় এবং যা যুক্ত করতে হয় একটি বায়ো পোর্টের মাধ্যমে। গেমে প্রবেশ করার পর কোনটা বাস্তব এবং কোনটা গেম তা খেলোয়াড়েরা পার্থক্য করতে পারে না।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুভিটি দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখতে সক্ষম। এবং শেষদিকে এসে দর্শককে ছুঁড়ে দেয় অস্তিত্বের প্রশ্ন।
প্রতিটা গেমের ক্ষেত্রে এক ধরনের অপটিমাইজেশন করা হয়। প্রধান চরিত্র যেদিকে যায় সেদিকটা ভালোমত চিত্রায়ন হয় আর বাকীটা একরকম করে দিলেই হয়। কারণ সেদিকে কেউ তাকাচ্ছে না। আমদের আলোর ক্ষেত্রে ডাবল-স্লিট এক্সপেরিমেন্ট নামে একটা পরীক্ষা করা হয়েছিল। সেখানে দেখা গেছে খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করলে আলো কনার মত আচরণ করে। এবং ভালো ভাবে লক্ষ্য না করলে আচরণ করে তরঙ্গের মত।
এটা কেন হয়? এটা কী কোন অপটিমাইজেশন, যেটা করেছে সিমুলেশন প্রোগ্রামের তৈরীকারকের। এটা সেই একটা ত্রুটি যা সিমুলেশনে রয়ে গেছে? এবং এটা যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আমাদের বাস্তব যে অস্তিত্ব তা একটি সিমুলেশন বলার মত অবস্থা তৈরী হয়ে যায়।
*সিমুলেশন হাইপোথিসিসের পক্ষে বিপক্ষে আরো বিভিন্ন মত বিদ্যমান।
*তারা, গ্যালাক্সি সংখ্যার রেফারেন্সঃ কসমোটোগ্রাফি