“আমি” বা “সেলফ” কী

“আমি” বা “সেলফ” কী এ নিয়ে এক বিতর্ক বিদ্যমান। কেউ কেউ মনে করেন আমি বা সেলফ হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কে। নিজের সম্পর্কে আমাদের ধারনাই “আমি” তৈরী করে। এই ধরণের মত পন্থীদের প্রতি-বাস্তববাদী বা এন্টি রিয়ালিস্ট বলা যায়।

প্রতি-বাস্তববাদী মতে, সেলফ আসলে একটি ইল্যুশন বা বিভ্রান্তি। সেলফ বলতে আসলে কিছু নেই। আমাদের মস্তিষ্ক সেলফের বা আমির একটি ফিকশন তৈরী করে, ও আমরা তা বিশ্বাস করি।

ডেবিড হিউমের মতো বড় দার্শনিকের লেখায় অতি-বাস্তববাদী উপাদান আছে। তিনি “আমি” বা “সেলফ”কে মনে করতেন পারসেপশন। একইরকম ধারণা বুদ্ধ দর্শনে, জেন গল্পে দেখা যায়। জেন গল্প এক ধরণের ধাঁধা বা হেঁয়ালি তৈরী করে।

কিন্তু সাইন্টিফিক্যালি “সেলফ” বা “আমি”র অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা হয়। আমি বা সেলফ যে বর্তমান আছে তার উপলব্ধি, দুঃখ বা সুখের অনুভূতি, নিয়ন্ত্রণ, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সামাজিক ও বাইরের পৃথিবীর সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করা, নিজের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করা; ইত্যাদি বৈজ্ঞানিকভাবে সেলফের অস্তিত্বের পক্ষে যায়। এবং সেলফের সমস্যাযুক্ত অসুখ তথা মানসিক অসুস্থতা বিষয়ে গবেষণা সেলফের অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং প্রতি-বাস্তবতাকে খারিজ করে দেয়। কিন্তু সেলফ কোন একক সেলফ নয় বরং জটিল। কয়েক ধরণের সেলফ দিয়ে তৈরী এক সেলফ বা আমি। তাই মানুষের মধ্যে কন্ট্রাডিকশন থাকে।

সাইকোলজিস্ট উলরিক নেইসার পাঁচ ধরণের সেলফ নলেজের কথা উল্লেখ করেছিলেন তার বিখ্যাত পেপারে। এগুলি হলোঃ

১। ইকোলজিক্যাল সেলফ- যা বাস্তব পৃথিবীতে ব্যক্তির কাজকর্মের সাথে জড়িত।

২। ইন্টারপার্সনাল সেলফ – সামাজিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় জড়িত।

৩। টেম্পোরালি এক্সটেন্ডেড সেলফ – এই সেলফ অতীতে ও ভবিষ্যতে বিচরন করে, স্মৃতি।

৪। প্রাইভেট সেলফ- এটা ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত সেলফ। এর কিছু সে বাইরে অন্য কারো সাথে শেয়ার করে না।

৫। কনসেপচুয়াল সেলফ- এটা হচ্ছে সেলফের ধারনা। এই ধারনা তৈরী হয় ব্যক্তির সামগ্রিক কাজকর্ম ও পরিবেশ থেকে।

এই ধরণের ভিন্ন ভিন্ন সেলফ ব্যক্তির থাকে, এবং এগুলি মিলেই তার “আমি” গড়ে উঠে।

বুদ্ধিস্ট ধারণায় সেলফের ধারণা নেই, বা তারা চলমান আমি’র ধারনা মানেন না। তারা সেলফকে বিভ্রান্তি বা ইল্যুশন মনে করেন। এক ধরণের স্যুডো আধ্যাত্মিকতার প্রচলন আছে এই সেলফের ইল্যুশনতা নিয়ে, যা খুবই জনপ্রিয়।

আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শন নিকোলস ও তার কলিগ মিলে সম্প্রতি একটি গবেষণা করেছেন মৃত্যু বা চলমান সেলফের ধ্বংসের ভয় কেমন কাজ করে বৌদ্বিস্টদের মধ্যে তা জানতে। এজন্য তারা ইন্ডিয়ায় মোনাস্টারিতে থাকা কিছু তিব্বতী বৌদ্ধ ভিক্ষু, ভুটানের কিছু বুদ্ধিস্ট মোনকদের প্রশ্ন করেন। এবং একই প্রশ্ন করেন আমেরিকান ও নাস্তিক ইত্যাদি লোকদের, যাদের অনলাইনের মাধ্যমে দৈবচয়নে নির্বাচন করা হয়েছিল।

প্রথম সার্ভেতে দেখার চেষ্টা করা হয়েছিল চলমান সেলফ বা আমি’র ধারনা তাদের মধ্যে কেমন। যেমন আশা করা হয়েছিল তেমনই দেখা গেছে, আমেরিকান সাধারন লোকদের মধ্যে চলমান আমি’র ধারনা শক্ত।

কিন্তু, বৌদ্ধদের মধ্যে চলমান সেলফের ধারনা দূর্বল, যা স্বাভাবিক। যেহেতু তাদের বৌদ্ধ বিশ্বাস ও প্র্যাকটিস চলমান সেলফের ধারণা মানে না।

পরবর্তীতে, দেখার চেষ্টা করা হয় মৃত্যু বা চলমান সেলফের ধ্বংসের ভয় কেমন কাজ করে দুই দল লোকের মধ্যে। এখানে আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা গেছে বুদ্ধিস্টদের মধ্যে এই ভয় বেশী কাজ করছে।

যদিও তারা চলমান সেলফে বিশ্বাস করে না তাই এই ভয় তাদের কম থাকার কথা ছিল।

এরপর এক প্রশ্ন করা হয়, যদি তার জীবনের কিছু সময়ের বিনিময়ে আরেকজন ব্যক্তির আরো বেশী সময় বাড়ানো হয়, তাহলে তারা এতে রাজী হবেন কি না। অর্থাৎ, আপনাকে একটি ট্যাবলেট দেয়া হলো যা আপনার আয়ু ৬ মাস বাড়াবে এবং অপরিচিত আরেকজনের ৬ বছর বাড়াবে, আপনি এটি ঐ ব্যক্তিকে দিবেন কি না।

দেখা গেছে বুদ্ধিস্টরা এক্ষেত্রে কম স্যাক্রিফাইস করতে রাজী হয়েছেন। ৭২% ই বলেছেন ট্যাবলেট নিজের জন্য রেখে দিবেন।

এই গবেষণা প্রাপ্ত ফলাফল গবেষকদেরও অবাক করে দিয়েছে। যাদের চলমান আমি’র ধারণা নেই, যারা একে বিভ্রান্তি মনে করেন, তারা এই আমি’কে রক্ষায় এতো তৎপর কেন বা এই চলমান আমি’র ধ্বংসের (মৃত্যু) ব্যাপারে এত ভীত কেন।

গবেষকরা ধারণা করছেন, মোনাস্টিক বুদ্বিস্টরা যদিও বলে থাকেন তারা চলমান আমি’তে বিশ্বাস করেন না, তথাপি তাদের ভেতরে এই বিশ্বাস শক্তভাবেই থাকে।