ইতস্তত কয়েকটি ময়ূর

 


আতিকুল বারী ছাত্তার গালকাটা ছাত্তার নামে পরিচিত। সবজি ব্যবসা করে। বেশ বড় ব্যবসা। সে আজ কিছুটা চিন্তিত। সকাল থেকে এ পর্যন্ত তিনবার মোবাইলে মেসেজ এসেছে। সাধারন মেসেজ না, হত্যা হুমকিযুক্ত মেসেজ। কিন্তু প্রতিবারই কলব্যাক করতে গিয়ে দেখা গেছে নাম্বার বন্ধ। গালকাটা ছাত্তার ভেবে পাচ্ছে না কাজটা কে করতে পারে।
সে গম্ভীর গলায় ডাক দিল, সাইদুর, সাইদুর…
হয়ত আশেপাশেই ছিল সাইদুর। দৌড়ে এসে বলল, কী বড় ভাই?
আতিকুল বারী ছাত্তার বলল, শোন, আজ আর বাজারে যাবো না। ইলেকশনের টাইম। মোবাইলে আইজ তিনটা মেসেজ পাইছি, হুমকি।
সাইদুর ঘাড় কাত করে শুনল। ছাত্তারের সামনে বেশি কথা বলার সাহস তার নেই। ছাত্তারের সাথে সে কাজ করে আজ তেরো বছর হল। সাধারণ অবস্থা থেকে ছাত্তার আজ কীভাবে এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠল, তার সবের স্বাক্ষী সে। গালকাটা ছাত্তারের ভয়াবহ রাগের সাথে ভালোভাবেই পরিচিতি আছে তার।
আতিকুল বারী ছাত্তার বলল, আমি নদীর পাড়ে চক্কর দিতে যামু বিকালে। তুই দোকানে থাকবি।
সাইদুর ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল।
ছাত্তার বলল, আরেকটা কথা শোন।
ইশারা বুঝতে পারল সাইদুর। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। সে কান এগিয়ে দিল। ছাত্তার খুব আস্তে আস্তে তাকে কিছু বলল।
সাইদুর শুধু বলল, জ্বে আইচ্ছা।
সাইদুর এরকম অকাজ ছাত্তারের কথায় আরো অনেক করেছে। যেতে হবে পেশাদার খুনি আফজলের কাছে। এতে তার কোন অস্বস্থি হলো না, তবে আফজলকে তার ভয় লাগে।


রফিক মিয়া পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে শক্ত করে মানিব্যাগ ধরে আছেন। তিনি যখন ভয়ানক কোন দুশ্চিন্তা করে তখন যে কোন কিছু আঁকড়ে ধরেন। এখন ধরে আছেন মানিব্যাগ। রফিক মিয়া দুশ্চিন্তা করছেন। দুশ্চিন্তার কারণ দুইটা।
১। ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ইলেকশন থেকে গালকাটা ছাত্তার নাম প্রত্যাহার করবে না সাফ জানিয়ে দিয়েছে।
২। এখন গালকাটা ছাত্তারকে সরানোর পথ একটাই আছে। সমিতির সাবেক সদস্যদের যে গ্রুপ রফিক মিয়ার দলে আছে তারা এই পথ গ্রহণের পক্ষেই মত দিয়েছে।
রফিক মিয়া তাই চিন্তিত। যা ঘটার আজ ঘটে যাবে। তিনি তখন মানা করতে পারেন নি। কারন সমিতির সবার সাহায্য নিয়েই এতবার তিনি সভাপতি হয়ে এসেছেন। তার সভাপতি হওয়াতে সবার স্বার্থই এখন জড়িত। সুতরাং সবার মত উপেক্ষা করে কিছু বলা যায় না। তাই তখন তিনি কিছু বলতে পারেন নি। কিন্তু আজ তার খারাপ লাগছে। ছাত্তারকে তার খারাপ লাগত না। যদিও ছাত্তার তার বিরুদ্ধে ইলেকশন করার দুঃসাহস করেছে তবুও রফিক মিয়া গালকাটা ছাত্তারকে খুব একটা ঘৃণা করতে পারেন না।
রফিক মিয়া সামান্য অনুশোচনায় ভুগছেন। তাই একটা নতুন সিম দিয়ে তিনবার হুমকি দিয়ে মেসেজ দিয়েছেন গালকাটা ছাত্তারকে। সরাসরি কিছু বলা যাবে না। কারণ তাতে সবকিছু প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। আর প্রকাশ হলে বেরিয়ে আসবে তিনি নিজেও এর সাথে যুক্ত। সুতরাং, রফিক মিয়া কৌশলে হুমকি দিয়ে মেসেজ দিয়েছেন। ভাগ্য ভালো হলে গালকাটা ছাত্তার বের হবে না বাড়ি থেকে। রফিক মিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, “হায়াত মউত আল্লার হাতে”।


আফজল হোসেন ভুড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, আগে কাজ পরে টেকা।
সাইদুর ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে ছিল তার সামনে। আফজল হোসেনকে ভয় পায় না এমন কেউ নেই এলাকায়। তার সাথে দেখা করাও সহজ কথা না। অনেক গোপন ও ক্ষমতাধর সূত্রের মাধ্যমে তার কাছে যেতে হয়। তবে একটা ব্যাপার ভাল, তার কাছে পৌছাতে পারলে কাজ নিশ্চিত।
সাইদুর পৌছে গেছে। সুতরাং তার কাজও হয়ে যাবে। সে টাকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আফজল পেশাধার খুনী হলেও নিজস্ব কিছু নীতিতে চলে। সে কাজের আগে টাকা নেয় না।
সাইদুর আফলের ঘর থেকে বের হয়ে সরু গলিটা ধরে হাঁটতে থাকে। এরকমই গলির ধারে ভিক্ষা করতে করতে তাকে বড় করেছিলেন তার দাদা এবাদুর ফকির। এবাদুরের স্বপ্ন ছিল তার নাতি সাইদুর একদিন বিশাল কিছু হবে। কিন্তু সাইদুর কিছুই হতে পারে নি। হয়েছে কেবল একজন সন্ত্রাসীর চাকর শ্রেণীয় লোক। এটাকে নিশ্চয়ই কিছু হওয়া বলে না। সাইদুরের ভেতর একটা অপরাধবোধ কাজ করত। সে অনেক অপরাধ করেছে, গালকাটা ছাত্তারের কৃত অপরাধসমূহের রক্ত তার হাতেও লেগে আছে এজন্য নয়। দাদার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে নি, এজন্য।


সময় পাঁচটা বিশ। শেষ বিকেল। বাজারে শোরগোল শুরু হয়েছে। বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নির্বাচনের প্রার্থী আতিকুল বারী ছাত্তার বা গালকাটা ছাত্তার মারা গেছে। তার লাশ পড়ে ছিল নদীর পাড়ে। শরীরে বিদ্ধ হয়েছে পাঁচটি বুলেট। মাথা, মুখ ও পেটে গুলি লেগেছে।
পুলিশ লাশ নিয়ে এসেছে বাজারে। লোকজন জড়ো হয়েছে। সবার সন্দেহের তীর রফিক মিয়ার দিকে। ছাত্তারের মোবাইলে আসা এসএমএস গুলির সূত্রে সেই সন্দেহ আরো তীব্র হয়েছে। এরই মধ্যে পুলিশি জেরায় সমিতির সাবেক এক সদস্য রফিক মিয়ার নাম বলে দিয়েছে। পুলিশ এখন খুঁজছে রফিক মিয়া এবং তার গ্রুপের অনেককে। তারা অবস্থা আঁচ করে পেরে এলাকা থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তা সম্ভব হবে না। কারণ প্রচুর পুলিশ সদস্য নিয়োজিত আছে এই ঘটনায়। এলাকার লোকজনও আছে। এছাড়া যারা গালকাটা ছাত্তারকে খুনের প্ল্যান করেছিল তাদের সবারই বয়স চল্লিশের উপরে। তাদের পক্ষে দ্রুত পলায়ন অনেকটাই কঠিন। সবাইকেই সন্দেহের মধ্যে রেখে খোঁজা হচ্ছে। সুতরাং সবার একসাথে সরে যাওয়া অসম্ভব।


রাত আটটা। রফিক মিয়া সহ আরো তিনজন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে পালানোর সময়।
মুখ কাচুমাচু করে আফজল হোসেনের কাছে বসে আছে সাইদুর। হাতে একটি কাগজের প্যাকেট। আফজল ইশারা করলেই সে প্যাকেটটা দিবে। আফজল ফোনে কথা বলছে কারো সাথে। তার মুখের ভাষা অমায়িক।
সাইদুরের আনন্দময় অনুভূতি হবার কথা। কিন্তু সে কিছুটা ভয় পাচ্ছে। টাকার প্যাকেটটা দিয়ে এখান থেকে সরতে পারলেই তার শান্তি। আফজলকে তার ভয় লাগে। তার দাদা এবাদুর অনেক বছর আগে ছোট সাইদুরকে একবার বলেছিলেন, নাতিরে, যারা মানুষ খুন করবার পারে, এগো উপরে বিশ্বাস নাই। এগো থিকা দূরে থাকবি।