উন্নতির দুই উপায় বিষয়ে মোতাহের হোসেন চৌধুরী

মোতাহের হোসেন চৌধুরী

পৃথিবীতে মানবজাতি যতদিন ধরে আছে তাকে যদি ২৪ ঘন্টার হিশাবে ধরা যায়, তাহলে ২৩ ঘন্টা ৫৪ মিনিটই মানুষ ছিল হান্টার-গেদারার সমাজে। তারা শিকার করত, ফলমূল সংগ্রহ করত। এর দ্বারাই জীবন ধারন করত। এরপরে কৃষিভিত্তিক সমাজের শুরু হয়। কৃষি উদ্ভিদ ডমেস্টিকেশন এবং প্রানী ডমেস্টিকেশন শুরু হয়। কৃষিভিত্তিক সমাজের সময়কাল এখন পর্যন্ত মাত্র ছয় মিনিটের মত, ২৪ ঘন্টার হিশাবে। এই ছয় মিনিটেই বদলে গেছে অনেক কিছু। কৃষিভিত্তিক সমাজের সাথে সাথে এসেছে লিঙ্গবৈষম্য, শ্রেণী বৈষম্য, বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক রোগ। এবং আধুনিককালে তীব্র পুঁজিবাদী প্রতিযোগীতা। এখানে উন্নতিই মূল কথা। সবার উন্নতি করতে হবে, হতে হবে অন্যের চাইতে সম্পদশালী ও খ্যাতিমান; এই তাড়না সমাজে।

যে করেই হোক উন্নতি করতে হবে, এই মানসিকতার বাস সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ফলে মানুষ অসৎ উপায় অবলম্বন করছে, যারা করতে আগ্রহী না তারাও বাধ্য হচ্ছে। বিদেশ থেকে গরীবদের দেয়ার কথা বলে টাকা এনে মেরে দিচ্ছে। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড থেকে টাকা মেরে দিচ্ছে। আবার সমাজ এই মেরে দেয়া লোকদের সম্মানও দিচ্ছে।

মানুষের বুদ্ধিমত্তার সর্বোচ্চ প্রকাশ যে আর্ট বা শিল্প, তাতেও অসদ উপায়ের আবির্ভাব হচ্ছে। সাধনার বিপরীতে শর্টকাট পন্থায় খ্যাতি পাওয়ার পন্থা হিশেবে আর্টকে দেখছে কিছু লোকে। এই ধরনের একটা সামগ্রিক বাজে অবস্থায়, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কথাটি স্মরণ করা যায়।

মোতাহের হোসেন চৌধুরী

পৃথিবীতে উন্নতি করিবার পথ দুইটি – একটি আত্মশক্তি আরেকটি চালিয়াতি। চালিয়াতিও এক প্রকার শক্তি বটে, তবে তাহা ধীরে ধীরে আত্মাকে ক্ষুদ্র ও নির্ব্বীর্য্য করিয়া চারিত্রিক অধোগতি সাধন করে বলিয়া সর্ব্বদা পরিত্যাজ্য।

যাহারা আত্মশক্তির সাধনা করে, তাহাদের বড় হইতে সময় লাগে, অথবা তাহাদের কেহ কেহ কোন সময় বড় হইতেই পারে না। তবু তাহাদের জীবন সার্থক এই জন্য যে, তাহারা একটি বড় রকমের আদর্শ দিয়া পৃথিবীকে ঋণী করিয়া যায়। সার্থক হইলে তো কথাই নাই, না হইলেও সাধনার একটি মূল্য আছেই। ভিতরের দিক হইতে দেখিতে গেলে তাহা আত্মশক্তিতে উদবুদ্ধ করিয়া মানুষকে সৃজনধর্ম্মী করিয়া তুলে, আর বাহিরের দিক হইতে দেখিতে গেলে তাহা প্রাত্যহিক জীবনের গ্লানি ও নীচতা হইতে রক্ষা করে

সার্থকতা সকল সময় সকলের ভাগ্যে ঘটেনা। কারণ তাহা শুধু চেষ্টার উপর নির্ভর না করিয়া বিধাতৃ-দত্ত শক্তির উপর নির্ভর করিতেছে। সে-শক্তির তারতম্য আছে। তাহার জন্য আমরা দায়ী নহি, দায়ী স্বয়ং বিধাতা। শক্তির অভাবের জন্য লাজ বোধ করিবার কিছুই নাই। সাধনার অভাবেই আমাদের লজ্জা। আমি চেষ্টা করিলেই রবীন্দ্রনাথ হইতে পারি না। কারণ রবীন্দ্রনাথের শক্তিতে আমার শক্তিতে আকাল-পাতাল প্রভেদ। কিন্তু সাধনায় তাঁহার সমকক্ষ হওয়া অসম্ভব নহে। না হইলে বিধাতার অপরাধ হইবে না, হইবে আমাদেরই।

– মোতাহের হোসেন চৌধুরী।

শিল্প- সাহিত্যের দুনিয়ায় ভাগ্যের ভূমিকা নিয়ে এই লেখাটিও দেখতে পারেন।