উম্বের্তো একোর সাক্ষাৎকার: ড্যান ব্রাউনও আমার এক সৃষ্টি

উম্বের্তো একো

উম্বের্তো একোর সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ডেবোরাহ সলোমন

অনুবাদ: মুরাদুল ইসলাম

 

উম্বের্তো একো

২০০৭ সালের ২৫ নভেম্বর ইতালিয়ান লেখক ও দার্শনিক উম্বের্তো একো’র এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ হয় নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে। এখানে একো মিডিয়া পপুলিজম নিয়ে কথা বলেছেন এবং তিনি যে আশঙ্কা করেছিলেন তার এক প্রতিফলন হিসেবেও দেখা যেতে পারে ২০১৬ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সফল ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়কে।

উম্বের্তো একো জন্মেছিলেন ৫ জানুয়ারি ১৯৩২ সালে। তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্য সমালোচক, দার্শনিক, প্রতীকবিদ। তার সবচেয়ে বিখ্যাত বই ‘দ্য নেম অব দ্য রোজ’, একটি ঐতিহাসিক মার্ডার মিস্ট্রি উপন্যাস যার সময়কাল ১৩২৭ সাল। তার সংগ্রহে ছিল প্রায় ৫০ হাজারের বেশি বই। তিনি অধিক আগ্রহী ছিলেন অদ্ভুত, বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল প্রমাণিত জিনিসের প্রতি। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে উম্বের্তো একো মারা যান।

এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ডেবোরাহ সলোমন। তিনি একজন আমেরিকান শিল্প সমালোচক, সাংবাদিক এবং জীবনীকার। ২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে সাপ্তাহিক ‘কোয়েশ্চনস ফর’ সাক্ষাৎকার সিরিজটি তিনি পরিচালনা করতেন। তার টুইটার একাউন্ট লিংক – ডেবোরাহ সলোমন

ডেবোরাহ সলোমন
ডেবোরাহ সলোমন

 

ডেবোরাহ সলোমন

ইন্টেলেকচুয়াল মার্ডার মিস্ট্রি ‘দ্য নেইম অব দ্য রোজ’ এর লেখক হিসেবে যদিও আপনি বেশি পরিচিত, তথাপি আপনি একজন প্রচুর পরিমাণে সক্রিয় রাজনৈতিক ভাষ্যকার। আপনার প্রবন্ধগুলি টার্নিং ব্যাক দ্য ক্লক নামের বইতে সংকলিত হয়েছে। যাতে আপনি মিডিয়া পপুলিজমের বিপদ সম্পর্কে সাবধান করেছেন। এই শব্দবন্ধকে আপনি কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?

উম্বের্তো একো

মিডিয়া পপুলিজম মানে হলো মিডিয়ার মাধ্যমে সরাসরি মানুষের কাছে আবেদন তৈরি করা। একজন যদি রাজনীতিবিদ মিডিয়ার কৌশলগুলি রপ্ত করতে পারেন, তাহলে রাজনৈতিক বিষয়গুলি সংসদের বাইরেই তিনি বন্দোবস্ত করে নিতে পারবেন, এমনকী সংসদের মধ্যস্থতা তিনি দূর করে দিতে পারেন।

ডেবোরাহ

আপনার বইয়ের অধিকাংশই ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনির বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণ, যিনি রাজনৈতিক স্বার্থে তার মিডিয়া সাম্রাজ্য ব্যবহার করেছেন।

একো

১৯৯৪ থেকে ১৯৯৫, আর ২০০১ থেকে ২০০৬, এই সময়কালে বার্লুসকোনি ছিল ইতালির সবচেয়ে ধনী লোক, প্রধানমন্ত্রী, তিনটি টিভি চ্যানেলের মালিক এবং তিনটি রাজ্য চ্যানেলের নিয়ন্ত্রক। আমি যেই ঘটনার (ফেনোমেনন) কথা বলেছি বার্লুসকোনি সেই ঘটনা, যা ঘটতে পারে এবং হয়ত পৃথিবীর অন্যত্র ঘটছেও। এবং এর প্রক্রিয়াটা হবে একই রকম।

ডেবোরাহ

মিডিয়ার উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ, যা রাজনীতিবিদদের পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলগুলি নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ দেয় তা রোধ করার জন্য আমাদের এখানে এফসিসি (ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশন) এবং অন্যান্য ফেডারেল এজেন্সিগুলা আছে।

একো

আমেরিকায় মিডিয়া এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে এখনো বড় দূরত্ব আছে, মূলনীতিতে হলেও।

ডেবোরাহ

তাহলে ইতালি ছাড়া অন্য দেশ কেন এই মিডিয়া কর্তৃক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পড়ার ঝুঁকিতে আছে, যা আপনি উল্লেখ করেছেন?

একো

বিদেশীরা যেসব কারণে ইতালির ব্যাপারটি নিয়ে এত আগ্রহী, তার একটি হলো গত শতকে ইতালি ছিল এক ল্যাবরেটরি। ফিউচারিস্ট*দের দিয়ে এর শুরু। তাদের ইশতিহার ছিল ১৯০৯-এ। তারপরে এলো ফ্যাসিজম** – এটা ইতালিয়ান ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষিত হলো এবং তারপর গেল স্পেনে, বলকান অঞ্চলে, জার্মানিতে।

ডেবোরাহ

আপনি বলছেন জার্মানি ফ্যাসিজমের আইডিয়া ইতালি থেকে পেয়েছিল?

একো

অবশ্যই। ঐতিহাসিকদের মত এমনই।

ডেবোরাহ

হতে পারে কেবল ইতালিয়ান ঐতিহাসিকদের মত।

একো

আপনি পছন্দ না করলে, না বলেন। আমি নিরপেক্ষ।

 

উম্বের্তো একো

 

ডেবোরাহ

আপনি বলতে চাচ্ছেন ইতালি  ফ্যাশন বা আর্ট এবং ফ্যাসিজম উভয় ক্ষেত্রেই অগ্রণী ভূমিকায় ছিল?

একো

হ্যাঁ। কেন নয়?

ডেবোরাহ

বার্লুসকোনির উত্তরসুরী হিসেবে এসেছেন রোমানো প্রদি। তিনি গত বছর নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার পর সরকারকে বামাবর্তে নিয়ে গেছেন। তার সম্পর্কে আপনার মত কী?

একো

তিনি একজন বন্ধুমানুষ। আমি তাকে পছন্দ করি। কিন্তু আমার ধারণা নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠে র মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতায় নির্বাচনে জিতে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। বার্লুসকোনির সুবিধা তিনি একজন বড় অভিনেতা। প্রদি অভিনেতা নন, যা কোনো অপরাধ নয় কিন্তু দুর্বলতা।

ডেবোরাহ

প্রদি একজন বুদ্ধিজীবী, অপরদিকে আছে তার ব্যবসায়ী সত্তা?

একো

হ্যাঁ, তিনি অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৯০ এর শুরুর দিকে আমার একটি প্রোগ্রামে প্রদি শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন। হঠাৎ করেই রাজনীতিতে চলে যান।

ডেবোরাহ

ইউনিভার্সিটি অব বলোগ্নার কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টের কথা বলছেন, সেখানে প্রতীকবিদ্যা’র (সেমিওটিক্স***)  অধ্যাপক আপনি?

একো

আমি এই মাসে অবসর নিয়েছি। আমার বয়স ৭৫।

ডেবোরাহ

আপনি কখনো রাজনীতিতে যেতে চেয়েছিলেন?

একো

না কারণ আমি মনে করি প্রত্যেকের অবশ্যই নিজের কাজ করা উচিত।

ডেবোরাহ

আপনি কি নিজেকে প্রধানত একজন ঔপন্যাসিক মনে করেন?

একো

আমি মনে করি আমি একজন স্কলার যিনি কেবলমাত্র বাম হাত দিয়ে উপন্যাস লিখে থাকেন।

ডেবোরাহ

আপনি কি ড্যান ব্রাউনের ‘দা ভিন্চি কোড’ পড়েছেন, কিছু ক্রিটিক মনে করেন ওটা আপনার ‘নেইম অব দ্য রোজে’র পপ ভার্শন।

একো

আমি এটি পড়তে বাধ্য হয়েছি কারণ সবাই এর ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল। আমার উত্তর হল, ড্যান ব্রাউন আমার উপন্যাস ‘ফুকো’জ পেন্ডুলামে’র চরিত্রগুলির মধ্যে একটি চরিত্র। এই বইটি সেই সমস্ত লোকদের নিয়ে যারা অকাল্টের**** বিষয়গুলি বিশ্বাস করতে শুরু করে।

ডেবোরাহ

কিন্তু আপনি নিজেও কাব্বালাহ, আলকেমি এবং অন্যান্য অকাল্ট বিষয় নিয়ে আগ্রহী, যার কথা উপন্যাসে আছে।

একো

না, ‘ফুকো’জ পেন্ডুলামে’ আমি ওই সমস্ত লোকদের একটা গ্রথেস্ক উপস্থাপন করেছি। তাই, ড্যান ব্রাউনও আমার এক সৃষ্টি।

ডেবোরাহ

একশো বছর পরে আপনার বই লোকে পড়বে কি পড়বে না, এই নিয়ে আপনার মনোভাব কেমন?

একো

কেউ যদি একটা বই লেখে, এবং তা টিকবে কি টিকবে না এই নিয়ে তার কোনো চিন্তা বা মাথাব্যথা না থাকে, তাহলে সে নির্বোধ।

—-

*ফিউচারিজম – বিশ শতকের শুরুর দিকে ইতালিতে শুরু হওয়া একটি শিল্প ও সামাজিক আন্দোলন। গতি, প্রযুক্তি, তারুণ্য, হিংস্রতা, গাড়ি, এরোপ্লেন, শিল্পনগরী এসবকে তারা প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

**ফ্যাসিজম – ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ যা ইতালির বেনিতো মুসোলিনির ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত। ১৯২২ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত যা কিংডম অব ইতালির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। ইতালির ফ্যাসিজমের মূলে ছিল ইতালিয়ান জাতীয়তাবাদ।

***সেমিওটিক্স – প্রতীক, চিহ্ন বিষয়ক দর্শনবিদ্যা। ভাষাতত্ত্বের খুব কাছের বিষয়। কীভাবে অর্থ তৈরি হয় এবং কীভাবে অর্থের যোগাযোগ হয় তার এক ধরনের তদন্তই বলা যায়। কীভাবে প্রতীক বা চিহ্ন অর্থ তৈরি করে এই বিষয়ের একাডেমিক কিছু কাজকে এই শাখার মূল ধরা হয়।

****অকাল্ট – এর মূল ল্যাটিন শব্দের অর্থ গুপ্ত জ্ঞান বা লুক্কায়িত জ্ঞান। অতিপ্রাকৃতিক বা বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয়-স্পিরিচুয়াল, অযৌক্তিক যাদু বিদ্যা বিষয়ক গুপ্ত সংঘ, তাদের বিশ্বাস ও কার্যকলাপ ইত্যাদি বোঝায় সাধারণত।

 

ড্যান ব্রাউনের সাক্ষাৎকার পড়তে পারেনঃ আমার বইয়েরা সব অন্তঃসারশূণ্য থ্রিলার নয়

উম্বের্তো একো’র এন্টিলাইব্রেরী সম্পর্কে জানতে পড়তে পারেনঃ একো, হাস্যরস ও প্রকৃত আয়নাবাজি