বিভিন্ন ছোট ছোট গল্প আছে যেগুলারে শিক্ষামূলক বা মোরাল স্টোরি বলা হয়। অনেকটা ঈশপের গল্পের মত। সেরকমই একটা গল্পে একজন দর্শনের শিক্ষক ক্লাসভর্তি উজ্জ্বল ছাত্র ছাত্রীদের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
তিনি একটি কাচের জারে বেশ বড় বড় পাথর ভরলেন। তারপর ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করলেন, “জার কি পূর্ন?”
ছাত্রছাত্রীরা বলল, “জি। পূর্ন।”
তখন শিক্ষক ছোট ছোট গুঁড়াগাড়া পাথর জারে ভরলেন। বড় পাথরের ফাঁকগুলোতে ছোট পাথরগুলো জায়গা করে নিল।
শিক্ষক বললেন, “এইবার কী?”
ছাত্রছাত্রীরা বলল, “এবারও পূর্ন।”
শিক্ষক এবার বালি ঢাললেন জারে। একটু ঝাঁকালেন। বড় পাথর এবং ছোট পাথরের ফাঁকগুলোতে বালিগুলো গিয়ে জমা হল।
শিক্ষক বললেন, “এইবারও জার পূর্ন। কিন্তু যখন বালিগুলা সরিয়ে নিলেও জার পূর্ন থাকবে। ছোট পাথরগুল সরিয়ে নিলেও জার পূর্ন থাকবে। এই জার আসলে আমাদের জীবনের মত।
জারের বড় পাথরগুলো হল আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন জিনিস। পরিবার, স্বাস্থ্য, সম্পর্ক ইত্যাদি। বাকী সবগুলো না থাকলে এবং শুধু এই জিনিসগুলো থাকলেও জীবন পূর্ন থাকে।
ছোট পাথর বা গুঁড়াগাড়া পাথর হচ্ছে কাজ, স্কুল বা একাডেমিক শিক্ষা ইত্যাদি।
আর বালি হচ্ছে আরো ছোট জিনিস যেমন, বস্তুগত অর্জন।
আমরা যদি বালি দিয়ে প্রথমে জার পূর্ন করতাম তাহলে বড় পাথর বা ছোট পাথর রাখার জায়গা থাকত না।
সুতরাং, আগে বড় পাথর অর্থাৎ তোমাদের স্বাস্থ্য, পরিবার, পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্ককে গুরুত্ব দাও। বালি এবং গুঁড়াগাড়া পাথরের দিকের ছুটতে গিয়ে বড় পাথর তথা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন জিনিসকে অবজ্ঞা করো না।”
সাধারণভাবে দেখলে দার্শনিক প্রফেসরের এই গল্পের মূলকথাকেই ডেভিড লিঞ্চের দ্য স্ট্রেইট স্টোরির মূলকথা বলে মনে হবে।
ডেভিড লিঞ্চ দুনিয়ার বড় ফিল্ম নির্মাতাদের একজন। এবং তার ফিল্মে অনেক দূর্বোধ্যতা থাকে বলে মজা করে বলা হয় ডেভিড লিঞ্চের ফিল্ম একমাত্র তিনিই হয়ত পুরোপুরি বুঝতে পারেন। লিঞ্চ মনে করেন একটা রহস্য যত বেশি অজানা, তত বেশি সুন্দর। তিনি বলেন, জীবন অনেক অনেক কনফিউজিং তাই ফিল্মকেও কনফিউজিং হতে দেয়া উচিত।
তবে স্ট্রেইট স্টোরির গল্প সাধারণভাবে দেখলে একেবারেই স্ট্রেইট। সহজ এবং সাধারণ গল্প। বেশি চরিত্রও নেই, ঘটনার ঘনঘটাও নেই।
ফিল্মের শুরুর দিকে দেখা যায় বৃদ্ধ এলভিন স্ট্রেইটকে ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করেন তার এক বন্ধু। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার তার নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যার কথা বলেন। দেখা যায় এলভিন স্ট্রেইট ঠিকমত দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। তাকে দুইটা লাঠির সাহায্যে চলাচল করতে হয়।
এই বৃদ্ধ রাতে খবর পান তার ভাই স্ট্রোক করেছে। এলভিন ঠিক করেন তিনি তার ভাইকে দেখতে যাবেন। তার ভাই থাকেন ২৪০ মাইল দূরে। এলভিন চোখে ভালো দেখতে পান না বলে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অন্য কেউ তাকে চালিয়ে নিয়ে যাবে সেটা তিনি চান না। তাই একটি লন মাওয়ারে চড়ে তিনি তার যাত্রা শুরু করেন। গতি ঘন্টায় মাত্র পাঁচ মাইল।
এলভিন যে ২৪০ মাইল দূরে যেতে পারবেন এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কারণ তার শারিরিক অবস্থা খারাপ। এবং লন মাওয়ারে চড়ে এত দীর্ঘ যাত্রা সম্ভব না।
এলভিন চলতে শুরু করলে সবাই অবাক হয় বুড়োর কান্ড দেখে। কিন্তু সেদিকে দৃষ্টি দেবার সময় বৃদ্ধের ছিল না। তিনি তার যাত্রা চালিয়ে গেলেন।
পথে এক তরুণীর দেখা পান তিনি। যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। সে রাতে আগুনের কাছে বসে তার সাথে কথাবার্তা বলে। তাকে তিনি পরিবারের গুরুত্ব বুঝাতে একটি খেলার কথা বললেন যেটা তিনি তার সন্তানদের সাথে খেলতেন যখন তারা ছোট ছিল। তিনি তাদের আলাদাভাবে একেকটা কাঠি দিয়ে ভাঙতে বলতেন। তারা ভেঙে ফেলত। তারপর তিনি কাঠিগুলো আঁটি বেঁধে দিতেন। সন্তানেরা ভাঙতে পারত না। তখন তিনি তাদের বলতেন, “এটাই পরিবার।”
পরদিন সকালে সেই মেয়েটা চলে যায়। এলভিন স্ট্রেইট উঠে দেখতে পান সে কয়েকটা কাঠি আঁটি বেঁধে রেখে চলে গেছে। সুতরাং, বুঝা গেল বৃদ্ধের গল্পে কাজ হয়েছে। ধারণা করা যায় মেয়েটা ফিরে গেছে তার পরিবারের কাছে।
পথে কিছু যুবক সাইক্লিস্টদের সাথে একবার যাত্রাবিরতি করেছিলেন এলভিন। তিনি রাতে চলতেন না। রাতে বিশ্রাম নিয়ে দিনে চলতেন তার ভাইয়ের বাসস্থান মাউন্ট জায়নের উদ্দেশ্যে।
যুবকেরা তাকে একবার জিজ্ঞেস করল, “বৃদ্ধ হবার সবচেয়ে বাজে জিনিস কী?”
এলভিন স্ট্রেইট উত্তর দেন, “তুমি যুবক ছিলে সেই স্মৃতি মনে হওয়া।”
ফিল্মের কথোপকথন গুলো অসাধারণ। চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট যাকে বলেছেন হেমিংওয়ের ডায়লগের মত। এবং পুরো ফিল্মে আছে অসাধারণ সব ক্যামেরার কাজ।
এলভিন স্ট্রেইট এর স্ট্রেইট স্টোরি সাধারণভাবে এই। শেষপর্যন্ত তিনি তার ভাই লায়েল স্ট্রেইট এর সাথে দেখা করেন।
তবে যেহেতু ডেভিড লিঞ্চের ফিল্মে অনেক রূপক বিষয়াদি থাকে তাই এই ফিল্মকেও একটু গভীরভাবে দেখা যায়।
এলভিন স্ট্রেইটের জীবন নিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন করা যায়। যেমন, কেন এলভিন স্ট্রেইট একা তার মেয়েকে নিয়ে থাকেন? তার চৌদ্ধ সন্তানদের বাকীরা কোথায়? তাদের সাথে তার যোগাযোগ নেই কেন? তার মেয়ের সন্তানদের একজন আগুনে পুড়ে যায়, এরপর স্টেট মেয়েটার বাকী সন্তানদের নিয়ে নেয়। এলভিন স্ট্রেইট বলেন, একজন লোকের তাদের দেখে রাখার কথা ছিল। কিন্তু সেই একজন লোক মাতাল হয়ে পড়েন। আগুন লেগে যায়। তার মেয়ের সন্তানদের একজন পুড়ে যায়। মেয়ের সুখের সংসার ভেঙে যায়। সেই একজন লোক বলতে এলভিন স্ট্রেইট কী নিজেকে বুঝিয়েছেন?
তার ভাইয়ের সাথে তার কী হয়েছে যার জন্য দশ বছর তিনি কোন যোগাযোগ করেন নি এটা পুরো ফিল্মেও জানা যায় না।
এইসব প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ন। মনে হয় ফিল্মের মধ্যে এর উত্তর কিছুটা আছে। যেমন, এক দৃশ্যে দেখা যায় একজন মহিলা হরিণ চাপা দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত প্রলাপ বকতে থাকেন। এলভিন স্ট্রেইট তার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। মহিলাটি বলেন, তিনি তার কাজের জন্য এই রাস্তায় যাওয়া আসা করেন। গত এক সপ্তাহে তেরোটি হরিণ তিনি চাপা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি হরিণ ভালোবাসেন।
মহিলাটি প্রলাপের মত এসব কথা বলেন। তারপর চারিদিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের সাথে বলেন, হরিণেরা আসে কোথা থেকে?
ভদ্রমহিলা এরপর চলে যান। তার চলে যাওয়া দেখে বুঝা যায় তিনি খুব বাজে ভাবে গাড়ি চালান। তাতে হরিণ চাপা দেয়া অস্বাভাবিক না মনে হয়। কিন্তু ভদ্রমহিলার শেষের উক্তি হরিণ আসে কোথা থেকে কথার মাধ্যমে তিনি নিজের দোষের চাইতে হরিণের আসাটাকে গুরুত্ব দিতে চাইলেন। কিন্তু তিনি সত্যি সত্যি হরিণ ভালোবাসেন। সত্যিই হরিণ মারা গেলে তিনি উদ্ভ্রান্তের মত কাঁদেন। কিন্তু হরিণ চাপা দেয়ার পিছনে তার স্পিডে বা বেখেয়ালি গাড়ি চালানোকে তিনি হিসাবে ধরেন না।
এই মহিলা বা ডার্ক স্যাটায়ারটি যেন এলভিন স্ট্রেইটের জীবনের সারকথা। এলভিন স্ট্রেইট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের সময় তাদের হয়ে কাজ করত এক তরুণ ছেলে। এলভিন ছিলেন দক্ষ স্নাইপার। একদিন তিনি ভুল বুঝে গুলি করে সেই ছেলেটাকে মেরে ফেলেন।
এই ঘটনা তার মনোজগতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কারণ একমাত্র তিনিই জানতেন ছেলেটা মারা গেছে তার গুলিতে। দলের অন্যরা জানত ছেলেটা মারা গেছে জার্মানদের হাতে।
যুদ্ধ থেকে তিনি ফিরেন এলকোহলিক হয়ে। তার এলকোহল আসক্তির পিছনে এই ঘটনা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু আবার সেই একই এলকোহল আসক্তির কারণে তার এক নাতি পুড়ে যায় এবং তার মেয়ে সন্তানদের হারায়।
জেদী এবং একরোখা এলভিন স্ট্রেইট সারাজীবন তার কাজগুলোর পিছনে হরিণ চাপা দেয়া মহিলাটির মত বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে এসেছেন। সম্ভবত তার ভাইয়ের সাথে বিরোধের কারণও তার জেদী এবং একরোখা মনোভাব। শেষের দিকে তিনি এক পাদ্রীকে বলেন ভাইয়ের সাথে বিরোধের কারণ রাগ, দম্ভ, এলকোহল ইত্যাদি। শেষের দিকে তার এই স্বীকারোক্তি দেখা যায়। অবশ্য এলভিন স্ট্রেইটের পুরো জার্নিটাই এক ধরনের স্বীকারোক্তি। বলা যায় এক তীর্থযাত্রা।
তিনি জীবনে ভুল করেছেন। এখন তিনি শান্তি চান।
তার এই শেষোজীবনে এসে মীমাংসার যাত্রা ভাইয়ের প্রতি মমতা থেকে নয়। তার পুরো যাত্রায় বিভিন্ন কথোপকথনে উঠে এসে তার অপরাধবোধাক্রান্ত বিবেক। মানুষ কীভাবে তার অপরাধ বোধ আক্রান্ত বিবেক নিয়ে জীবন যাপন করে এটা একটা গুরুত্বপূর্ন বিষয় এবং এ নিয়ে চমৎকার কাজ করেছেন আরেকজন বড় নির্মাতা মিখায়েল হানেকে তার হিডেন ফিল্মে।
নিজের শান্তির জন্যই এলভিন স্ট্রেইটের যাত্রা। ভদ্রলোকের জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা না গেলেও এটা বুঝা গেছে তার বাকী সন্তানদের সাথে দেখা করার কোন আগ্রহ নেই তার। ভাইয়ের প্রতি মীমাংসার আগ্রহ এই জন্য যে তিনি বলেন, “তুমি কে এবং কী তা তোমার ভাই অন্য সবার চেয়ে ভালো জানে।”
হয়ত এটা সত্যি। তাই শেষ দৃশ্যে দুই ভাইয়ের দেখা হওয়ার দৃশ্যে তাদের খুব বেশি উল্লসিত হতে দেখা যায় না। দুজনের চোখেই দেখা যায় যুগপৎ আনন্দ-বেদনার প্রকাশ। যাকে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।