ফেইসবুকে দেখবেন বিভিন্ন মতাদর্শীরা (যেমন উগ্র ধর্মবাদী বা উগ্র নাস্তেক ইত্যাদি) খুবই এগ্রেসিভ হইয়া থাকে। তারা অন্যরে উগ্রভাবে আক্রমণ করে ফেইসবুকে এবং একসাথে গ্রুপ হইয়া থাকে।
কিন্তু এগুলা করে কেন? তার লাভ কী? এই যে ঘৃণার আবেগ এগুলার উৎপত্তি কীভাবে হয় তাদের মধ্যে?
তাদের ইমোশন আসলে ফেইক না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সত্যিই সে ঐরকমভাবে অনুভব করে। সে তীব্র ঘৃণা অনুভব করে তার ঐ প্রতিপক্ষের বিপরীতে।।
ধরেন, কেউ ইসলাম বিদ্বেষী। সে ইসলাম বিদ্বেষ বা মুসলমান জঙ্গীদের নিয়া সার্চ দিল। কিছু ভালো লেখার সাথে সাথে অনেক খারাপ লেখাও তার সামনে আসবে।
ফেইসবুক, গুগল তার এই সার্চ এবং পড়া দেইখা তারে ঐ ধরনের কন্টেন্টই দেখাতে থাকবে। সে দেখবে ফেইসবুকের সাইডবারে, হোমপেজে জঙ্গীরা কীভাবে দুনিয়া ধ্বংস করে ফেলতেছে। গুগল এডে দেখাবে, সার্চ রেজাল্টে প্রাধান্য দিবে ঐসব নিউজ। সে সন্ত্রস্ত হইয়া উঠবে।
ফেইসবুক গুগল এইটা করে, উক্ত ব্যক্তিকে বেশী সময় সাইটে রাখার জন্য। আপনি যা লাইক করেন, তাই আপনারে সে দেখাবে।
একইভাবে যারা জঙ্গীদের প্রতি সহানুভূতিশীল তারা খালি দেখবে জঙ্গীদের প্রতি সহানুভূতি যুক্ত নিউজ, লিংক। যারা ইহুদি বিদ্বেষী তারা দেখবে ইহুদিরা কতো খারাপ সেইসব নিউজ আর লিংক।
গুগল, ফেইসবুকের এলগোরিদম নিয়ন্ত্রণ করে আপনি কী দেখবেন। তারা আপনার পছন্দ দেখেই আপনারে জিনিসপত্র দেখায়।
মানুষের সাইকোলজিক্যাল এক প্রবণতা আছে। সে যা বিশ্বাস করে তাই তার চোখে পড়ে। বিপরীত মতের অনেক লেখা থাকলেও ওইগুলা সহজে তার চোখে পড়ে না। আর ফেইসবুক, গুগল ইত্যাদি এখানে আবার ইচ্ছা করেই বিপরীত মত সরাইয়া রাখে।
ফলে ঐসব মানুষেরা তার মত এবং তার সমর্থনে নানাবিদ লেখা, ছবি, ভিডিও ইত্যাদিই খালি দেখতে থাকে, ঐসব ভেতরেই সে থাকে। তার মনে হয় ঐটাই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মত, যেহেতু সবাই এইটারে সমর্থন দিয়া যাচ্ছেন। অনেক বড় বড় জ্ঞানীরা সমর্থন দিচ্ছেন, এ থেকে তার অবস্থান আরো শক্ত হয়। ঐসব জ্ঞানী অথরিটি ফিগার হিশাবে কাজ করেন তার অবস্থানের সমর্থনে। এবং প্রতিপক্ষের প্রতি তার ঘৃণা আরো তীব্র হয়।
এখানেও আরেকটা সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার আছে, মানুষ যারে পছন্দ করে তার অনেক দোষ তার চোখে পড়ে না। যারে অপছন্দ করে তার অনেক গুণ সে দেখে না, দোষগুলাই দেখে বেশী। ফলে, ঘৃণা কমার কোন সম্ভাবনাই থাকে না ভার্চুয়াল জগতে।
প্রথমত, সে কনফার্মেশন বায়াসের {এই বায়াস থেকে বাঁচার উপায়) অনুকূল পরিবেশ পায়, যেহেতু ফেইসবুক গুগল এলগোরিদম বিপরীত মত সরাইয়া ফেলে।
দ্বিতীয়ত, সে দেখে অনেক অনেক শিক্ষিত মানুষ তার মতের সমর্থনে, সোশ্যাল প্রুফ পায় সে।
তৃতীয়ত, যখন বড় বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানীদের এই মতের সমর্থনে দেখে তখন অথরিটির ইনফ্লুয়েন্সও পায়।
এদের সমন্বিত ফল হিশেবে, তার পূর্বের ঘৃণার টেন্ডেসির আগুনে বাতাস লাগে। তার ঘৃণা আরো বাড়ে।
এই চার সাইকোলোজিক্যাল টেন্ডেসি মানুষের ডিসিশন মেকিং প্রভাবিত করে দারুণভাবে। যেসব জিনিস মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রভাবিত করে এদের মধ্যে কোর সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারগুলোর মধ্যে এগুলা অন্যতম।
এগুলা একজন ব্যাক্তিকে কেন্দ্র করে ভার্চুয়াল নিয়ন্ত্রকের (ফেইসবুক, গুগল ইত্যাদি) তৈরী পৃথিবীর কথা বলা হলো। মানুষেরা সাধারণত সেইসব মানুষের সাথে কথাবার্তা বলতে আরাম পায় যাদের সাথের তার মত বা চিন্তাধারার মিল হয়। তাই দেখা যায় একই মতের লোকেরা পরস্পর ফেইসবুকে যুক্ত থাকেন। বিপরীত মত বা বিপক্ষ মতের লোকদের অনেক ক্ষেত্রে ব্লক করে দেন।
সেই ক্ষেত্রে একই মতের লোকেরা একসাথে থাকেন, যাদেরকে কেন্দ্র করে ফেইসবুক, গুগল ইত্যাদি তাদের মতের একেকটা ভার্চুয়াল বিভ্রান্তি তৈরী করে দিয়েছে। ফলে তাদের সম্মিলিত ভার্চুয়াল বিভ্রান্তিকর পৃথিবী মিলে তৈরী হয় বড় বিভ্রান্তিকর কুকোন। যার থেকে বের হওয়া কোন ব্যাক্তির পক্ষে সহজ নয়, সচেতন চেষ্টা ছাড়া।
দিনশেষে এই ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড একটা বিভ্রান্তিকর কুকোন বিশেষ। কুকোন হচ্ছে রেশমপোকা বা প্রজাপতি জাতীয় পোকারা বাচ্চাকালে তার চারপাশে যে একটি খোলস তৈরী করে এবং তার ভিতরে অবস্থান করে। রেশম পোকার ক্ষেত্রে তা কবুতরের ডিম আকৃতির।
উপরে আমি উগ্র নাস্তেক এবং উগ্র ধর্মবাদীদের নিয়া উদাহরণ দিলাম। কিন্তু এই ব্যাপারটা অন্য যেকোন মতের জন্য সত্য। আপনি যদি নিয়মিত সার্চ দিতে থাকেন ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে, কয়েকদিনের মধ্যে ক্যাপিটালিজম বিরোধী যৌক্তিক অযৌক্তিক লেখায় ভরে যাবে আপনার ভার্চুয়াল পৃথিবী। যদি সার্চ দেন সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে, তাহলে গুলাগ আর সমাজতন্ত্রের বিভীষিকার নিউজ-লিংকে ছেয়ে আপনার কুকোন।
এইটাই ভার্চুয়াল ইল্যুশনের পৃথিবী, যেথায় হয়ত আপনার বাস।
কুকোনের ভিতরে গুটিপোকার জীবন যাপন।
অবশ্য এটি আপনি ভাঙতে পারবেন। কিন্তু তার আগে আপনারে বুঝতে হবে আপনার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অনুভব করে নিজের মতরে চ্যালেঞ্জ করে যান। নিজের মত, নিজের আইডিয়া প্রিয় হইতে পারে, ভাঙতে খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু কুকোন থেকে মুক্তি পাইতে হলে এর কোন বিকল্প নাই।