কীভাবে বই পড়তে হয়?

ইনসাইটফুল বা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন কোন কিছু শেখা সহজ ব্যাপার নয়। অধিকাংশ লোকে জানা এবং বুঝাকে গুলিয়ে ফেলেন। কোন কিছু সম্পর্কে জানা থাকার অর্থ এই না যে সম্পর্কে বুঝ থাকা। দোয়েল পাখির নাম বইয়ে পড়ে কেউ দোয়েল পাখি বুঝতে পারবে না। বুঝতে হলে দোয়েলকে তার সরাসরি পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন বা দোয়েল সম্পর্কে তথ্যাদিকে পর্যবেক্ষন প্রয়োজন।

ইনসাইটফুল কিছু শেখতে হলে আপনার বর্তমান লেভেলের উপরের কিছু পড়তে হবে। এমন লেখকের বই পড়তে হবে যে নির্দিষ্ট সেই বিষয় সম্পর্কে আপনার চাইতে ভালো জানেন।

তখন শুরু হবে বুঝার জন্য পড়া। বুঝার জন্য পড়া পাঠক এবং লেখকের দূরত্ব কমিয়ে দেয়।

মর্টিমার এডলার তার ১৯৪০ সালে প্রকাশিত ‘হাউ টু রীড’ বইয়ে চার ধরনের পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হল-

১। প্রাথমিক

২। পরীক্ষামূলক

৩। বিশ্লেষনাত্মক

৪। তুলনামূলক

বই পড়ার আপনার উদ্দেশ্য কি এর উপরে পাঠের ধরন নির্ধারিত হবে। ই এল জেমস পড়া আর কীর্কেগার্ড পড়া এক জিনিস নয়। বিনোদন বা তথ্যের জন্য যদি পড়তে চান তাহলে আপনাকে এই লেখায় যেভাবে আলোচনা করা হচ্ছে বা যেভাবে পড়ার কথা বলা হচ্ছে সেভাবে পড়তে হবে না। ঐ ধরনের পড়ার ধরন এবং পড়ার বইও ভিন্ন। বেশিরভাগ লোকে যদিও বিনোদন বা তথ্যের জন্য পড়েন, তথাপি কিছু লোক জ্ঞানের জন্য পড়ার দিকে তাদের ক্ষমতা বাড়ান।

boi porben
পড়ার দক্ষতার উন্নতির জন্য এই চার ধরনের পড়ার ধাপের পার্থক্য সম্পর্কে জানা দরকার। পিছনের ধাপ না জেনে পরের ধাপে যাওয়া সহজ হবে না।

প্রথমে আছে প্রাথমিক পাঠ। যা আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিখে থাকি।

পরীক্ষামূলক পাঠ হলো ভাসা ভাসা এবং ছাড়া ছাড়া পাঠ। পড়ে যাওয়া, কোন কিছু না বুঝতে পারলে সে নিয়ে চিন্তা না করা, না দাগানো। এর মাধ্যমে আপনি বইয়ের চিন্তার উপকরণের সাথে পরিচিত হলেন। বুঝতে পারলেন যে এই বইটা পুনঃপাঠ এর প্রয়োজন আছে কী না।

বিশ্লেষণাত্মক পাঠ হলো চর্বন এবং হজম। ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, কিছু বই টেইস্ট করতে হয়, কিছু বই গিলতে হয় আর কিছু বই চিবাইয়া হজম করতে হয়। এই চিবাইয়া হজম টাইপের পড়াই বিশ্লেষণাত্মক পাঠ। পরীক্ষামূলক পাঠ ছিল খুব দ্রুত কিন্তু বিশ্লেষণাত্মক পাঠ হবে পুঙ্খানুপুঙ্খ, তাই অনেক সময় নিয়ে। যত সময় ইচ্ছা আপনি নিতে পারেন।

বিশ্লেষণাত্মক পাঠের কিছু নিয়ম আছে, যেমন,

১। বইটা কোন বিষয়ে এবং কোন ধরণের তা আলাদা করা।

২। যত সংক্ষিপ্ত করে পারা যায় বইয়ের বিষয়বস্ত বর্ননা করা।

৩। এর মূল বিষয়গুলো পরপর সাজানো এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্নয় করা।

৪। যেসব সমস্যা লেখক আলোচনা করতে চেয়েছেন বা সমাধান করেছেন সেগুলো সংজ্ঞায়িত করা।

উপরের প্রক্রিয়াগুলো সহজ শোনালেও সহজ নয়। ঠিক একই ধরনের কথা আহমদ ছফাকে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন। আমরা তা দেখতে পাই আহমদ ছফার লেখা বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’তে। তিনি বলেছিলেন,

“আর পড়ার কাজটি অইল অন্য রকম। আপনে যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে – বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কি না। আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভাণ্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনেমনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইর‍্যা নিবেন, আপনের পড়া অয় নাই…”

এডগার এলান পো বইয়ে দাগানো নিয়ে বলেছেন দাগানোর মাধ্যমে লেখককে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন হয়। তার কথায়, “বইয়ে দাগানো হলো লেখকের সাথে একমত বা মত পার্থক্যের প্রতীক। এইভাবেই একজন লেখককে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া হয়।”

দাগানো/ নোট রাখা নিয়ে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের পরামর্শও এখানে উল্লেখ করা যায়। ‘যদ্যপি আমার গুরু’তে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আরেকবার আহমদ ছফাকে জিজ্ঞেস করেন তিনি পড়ার সময় নোট রাখছেন কি না। ছফা এতে না বোধক উত্তর দিলে আবদুর রাজ্জাক বলেন, “তাইলে ত কোনো কাম অইব না। ক্ষেত চষবার সময় জমির আইল বাইন্ধ্যা রাখতে অয়।”

বইয়ের সারকথা নিজের ভাষায় সংক্ষিপ্তকারে লেখাটাকে জার্মান চিত্র পরিচালক, লেখক মিখায়েল হানেকে অসম্ভব মনে করেন তার স্ক্রিপ্টের ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, সংক্ষিপ্তাকারে লেখতে পারলে আমি এত বড় গল্প লেখতাম না। এজন্য তিনি সিনোপসিসও লেখেন না।

যাইহোক, বিশ্লেষণাত্মক পাঠের ক্ষেত্রে কঠিন হলেও সংক্ষিপ্তাকারে মূলভাব লেখাটা দরকারী, বুঝার জন্য। আমার ফিল্ম আলোচনাগুলোকে ফিল্ম দেখার পর বুঝার প্রয়াস হিসেবেই দেখা যেতে পারে।

সর্বশেষ ধাপে আছে তুলনামূলক পড়া। সবচেয়ে কঠিন ধাপ। একই বিষয়ের বিভিন্ন বই পড়ে তাদের মধ্যে তুলনামুলক আলোচনা। একই বিষয়ের বিভিন্ন বই নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার ফলে বিষয়টি বুঝার উপরে উঠে বইগুলো ব্যবহার করার ধাপে চলে যাবে।

তুলনামূলক পড়ার জন্য সম্পর্কিত সঠিক বইগুলো খুঁজে বের করতে হবে। পরীক্ষামূলক পাঠের মাধ্যমে বইগুলোর একই সমস্যা/বিষয় সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ গুলো খুঁজে বের করতে হবে।

এরপর বিভিন্ন লেখক ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সমস্যাটিকে দেখেছেন বা সংজ্ঞায়িত করেছেন দেখতে পাবেন হয়ত। এগুলো পাঠ পূর্বক নিজের ভাষায় এর সমাধানটি লিখুন।

এরপর যে প্রশ্নের উত্তর লেখক দিতে চেয়েছেন তা নিয়ে ভাবুন। ভাবুন যে লেখক এর পূর্ন উত্তর দিতে পেরেছেন কী না। প্রশ্ন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা তৈরী করুন।

এখন দেখুন ভিন্ন ভিন্ন লেখকের দেয়া উত্তরগুলোর মধ্যে বৈসাদৃশ্য কেমন আছে। উত্তরগুলো একে অন্যের বিপরীত হলেও তা আপনাকে বুদ্ধিভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।

আপনার সিদ্ধান্ত বা উত্তর যে সঠিক হবে তা নয়, বিভিন্ন লেখকের উত্তর পর্যালোচনা আপনাকে সমস্যা এবং উত্তর সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিবে। এর অর্থ বিষয়টি নিয়ে আপনার বুদ্ধিভিত্তিক মতামত তৈরী হবে।

পাঠ হচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, নির্দিষ্ট ক্রমে এবং সেগুলোর উত্তর খোঁজা। ৪ টি মূল প্রশ্ন –

১। এই বইটি কি নিয়ে?

বইয়ের মিল থিম বা বিষয়বস্তু কি নিয়ে। লেখক কীভাবে এই থিম নির্মান করেছেন এবং কীভাবে এর সাথে সম্পর্কিত সহযোগী ছোট ছোট অন্যান্য থিমে চলে গেছেন।

২। কি বলা হয়েছে এবং কেমন বিস্তারিত?

বইয়ের মূল চিন্তা, লেখকের বিবৃতি এবং যুক্তিসমূহ বের করতে হবে।

৩। বইটি কি সত্য, পুরোপুরি না আংশিক?

প্রথম দুই প্রশ্নের উত্তর পাবার পর আপনি এই প্রশ্নের উত্তরে যাবেন। বই বুঝতে পারলে এর সত্য মিথ্যা কিংবা আংশিক সত্যতা সম্পর্কে আপন্র নিজস্ব ধারণা তৈরী হবে।

৪। কোন অংশ?

বই যদি কোন তথ্য দেয় তাহলে এর গুরুত্ব নিয়ে ভাবতে হবে। লেখক কেন মনে করলেন এই তথ্যগুলো আপনার জানা দরকার। এগুলো কি আপনার জানা দরকার? তথ্য ছাড়াও বইটি যদি বুদ্ধিভিত্তিকভাবে আপনাকে উদ্দীপ্ত করে তাহলে আরো প্রশ্ন করে বুদ্ধিভিত্তিক উত্তরনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

এতসব নিয়ম কঠিন মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই? মনে হবারই কথা। এই ঝামেলায় সবাই যেতে চাইবে না। সহজ হলে পৃথিবীর সব বই পাঠকই বুদ্ধিভিত্তিকভাবে সমান হয়ে যেত। যারা পাঠ থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশা করেন, বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তায় যাদের আগ্রহ তারা অবশ্যই কঠিন পথেই যাবেন।

ফারনাম স্ট্রিটে হাউ টু রিড এ বুক, দ্য আর্ট অব রিডিংঃ হাউ টু বি এ ডিমান্ডিং রিডার ইত্যাদি পোস্টের সূত্রে লেখা। ফারনাম স্ট্রিট সকালে ঘুম থেকে উঠে একজন যত স্মার্ট ছিল, ঘুমাতে যাবার সময় সে যেন সকাল থেকে বেশি স্মার্ট হয়ে ঘুমাইয়া যাইতে পারে; সেই ওছিলায় কাজ করে।