ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস এবং ভায়োলেন্ট গেইম

 

 ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস

জনপ্রিয় একটা গেইম ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস। ক্ল্যান শব্দের অর্থ বংশ, জাতি, দল, গোষ্টী। এই গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে মারামারিই হইতেছে ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে মারামারি আমাদের এখানে নতুন কিছু না। গ্রামে গঞ্জে এইটা হয়ে থাকে। আর বেশিরভাগ শহুরে লোকেরা কয়েকপুরুষ আগে তো গ্রামেই ছিল।

এই স্ট্র্যাটেজিক মোবাইল গেইমে (২০১২/২০১৩) কম্যুনিটি তৈরী করতে হয়, ট্রুপস বা সৈন্যদের ট্রেনিং দিতে হয়, অন্য প্লেয়াররে আক্রমণ কইরা গোল্ড এবং এলিকজা (Elixir –  স্পর্শমনি, ধাতুকে সোনায় পরিণত করিবার বা আয়ু বাড়াইবার ঔষধবিশেষ) সংগ্রহ করতে হয়। এই সোনা এবং স্পর্শমনি নিজের কম্যুনিটির ডিফেন্স বাড়াইতে ব্যবহৃত হয়, যাতে অন্যরা আক্রমণ করে হারাইতে না পারে।

এই হলো প্রাথমিক বিষয়। এছাড়া আরো বিভিন্ন জিনিস আছে এই গেইমখানার মধ্যে। এইরকম মাল্টি প্লেয়ার স্ট্র্যাটেজিক গেইম আরো অনেক আছে কিন্তু এইটার প্রতি আমার আগ্রহ হইল কারন আমার পাড়ার ছেলেরা এর ভীষন ভক্ত। তাদের একটা বড় ক্ল্যান আছে। সেই ক্ল্যান ব্যবহার করে তারা যুদ্ধ টুদ্ধ করে থাকে।

যে সাধারণ সহজ সরল নিরীহ একটা ছেলেকে দেখা যায়, বাইরে থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সে কত বড় যোদ্ধা।

Clash of Clans

এই গেইমের সবচেয়ে চমকপ্রদ জিনিস হইল এটি মানুষের আদিম প্রবৃত্তিকে ব্যবহার করে। একসময় মানুষের পূর্বপুরুষেরা বনে জঙ্গলে বাস করত। দলবদ্ধভাবে বাস করার প্রয়োজনীয়তা জন্মিল ভয়ংকর প্রাণীদের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার জন্য। এগ্রিকালচার সোসাইটি ডেভলপ করার পর বিবাহ প্রথা বা এই ধরনের কিছু একটা হইল উত্তরাধিকার সংস্লিষ্ট ঝামেলা বা উৎপাদনে সুবিধার জন্য।

এক দলের সাথে আরেকদলের যুদ্ধ প্রাচীন কাল থেকেই ছিল টিকে থাকার প্রয়োজনে, কর্তৃত্ব রক্ষার তাগিদে। বিবর্তনের এইসব বৈশিষ্ট্য অন্য প্রানীর মধ্যেও আছে। লক্ষ করে থাকবেন উলা তথা মরদ বিলাই মাঝে মাঝে বিড়ালের বাচ্চা মারে। একবার এইরকম এক উলা (মরদ) বিলাই কর্তৃক কয়েকটি নিষ্পাপ বিড়ালের বাচ্চা খুন হইতে দেখে খারাপ লাগছিল। পরে কী কারণে পুরুষ বিলাই বাচ্চা মারে জানতে প্রচন্ড কৌতুহল হইল। কয়েকটা নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইট থেকে জানলাম, এরা অন্য পুরুষ বিলাইয়ের বাচ্চা। তাই উলা এদের মেরে ফেলে। যাতে সে তাড়াতাড়ি স্ত্রী বিলাইয়ের সাথে একান্তে মিলিত হতে পারে এবং নিজের বাচ্চা পয়দা করতে পারে।
বিবর্তনের কারণে এই বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে রয়ে গেছে। যখন তারা হিংস্রতার স্তরে বনে জঙ্গলে ছিল তখন শত্রুর সন্তান হত্যার প্রবৃত্তি ছিল তাদের মধ্যে। তা না হলে শত্রু সংখ্যা বেড়ে যাবে। শত্রুর দল ভারী হবে। তখন এলাকার রাজত্ব চলে যাবে শত্রুর হাতে।

তাই শত্রুর সন্তান হত্যা করে স্ত্রী বিড়ালকে একান্তে ডাকার জন্য তৈরী করে নিয়ে নিজের সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে নিজস্ব জেনেটিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে উলা বিলাই।

বিলাইয়ের জন্য ক্ল্যাশ অব বিলাইজ তৈরী করলে এই বিষয়টাকে কোনভাবে তুলে আনতে হবে তাদের মধ্যে গেম জনপ্রিয় করতে হলে।

প্রাণীদের মধ্যে পূর্বপুরুষের স্মৃতি ফসিল মেমোরি আকারে সংরক্ষিত আছে। এজন্য মানুষেরা যখন ড্রাগনের কল্পনা করে তখন মুখ দেয় বিড়াল জাতীয় প্রাণীর মত আর পিঠে দেয় হিংস্র পাখির  ডানা। কারণ বিড়াল জাতীয় প্রাণী (টাইগার, লায়ন ইত্যাদি) এবং বড় হিংস্র পাখিদের ভয়ে তটস্থ থাকত মানুষের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা। এই ভয় এখনো মানুষের অন্তরের গোপন সব কক্ষে রয়ে গেছে।

ক্ল্যান বা দল তৈরী করা মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। আধুনিক পৃথিবীতে লোকে বিনোদনের জন্য দল তৈরী করে। খেলা নিয়ে দেখবেন কীরকম দল তৈরী হয়। কেউ বার্সা সাপোর্টার, কেউ রিয়াল। ফ্যানেরা দল তৈরী করে আলাদা আলাদা তাদের সমর্থনের ভিত্তিতে। এই ধরনের দল তৈরীর মাধ্যমে তারা তাদের প্রাচীন পূর্ব পুরুষদের দলগতভাবে থাকার অভ্যাসরেই অনুসরণ করে।

এছাড়া এই গেইম অন্য অনেক গেইমের মতো কিছু ভার্চুয়াল সম্পদ দেয় মানুষরে। এই ভার্চুয়াল সম্পদ কম কথা না। এগুলার মাধ্যমে আসলে ঐ খেলোয়াড় তার লাইফের একটা অর্থ খুঁজে পায়। যে তার অনেক কিছু আছে, দায়িত্ব আছে। যদিও তা ভার্চুয়াল তথাপি এই দায়িত্ব, এই সম্পদগুলা তারে জীবনের নয়া অর্থ দেখাইয়া দেয়। ফলে সে এর প্রতি আসক্ত হইয়া পড়ে।

এক্ষেত্রে অতিরিক্ত আসক্তিতে তার ব্যাক্তিগত লাইফ তথা যাকে বাস্তব জীবন বলা হয় তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে বাস্তব জীবন নামে পরিচিত বস্তুও যে ভার্চুয়াল নয়, তার নিশ্চয়তা কি?

 

 ভায়োলেন্ট গেইম

GTA Vice city

অনেক ভিডিও গেইমে ভায়োলেন্স থাকে এবং প্রশ্ন উঠে এইরকম ভায়োলেন্স থাকার কী কারণ। বিভিন্ন দিক থেকে দেখে এর উত্তর হইতে পারে।

‘মানুষের মাঝে জীবন আকাঙ্খা এবং মৃত্যু আকাঙ্খা পাশাপাশি কাজ করে।’ ফ্রয়েড যাকে বলেছেন ডেথ উইল। ‘সবাই তার অজৈব অস্তিত্বহীনতায় ফিরে যেতে যায়। প্রতিটি জীবন্ত শরীরে মৃত্যুর আকাঙ্খা সুপ্ত থাকে।’ ভিডিও গেইমে অন্যরে মারা, মৃত্যু এবং ভায়োলেন্সের মধ্য দিয়ে মানুষের সেই ইচ্ছা একরকম পুরণ হয়।

এইজন্যই প্রাচীনকালে লোকেরা মানুষে মানুষে ফাইট করাইত। প্রাচীন গ্রীক-রোমান (কলোসিয়াম) বা মায়ানরাও(বল গেইম) এই ধরনের যুদ্ধ করাইত এবং মায়ানদের বল গেইমে পরাজিতদের মাথা কেটে রাখা হইত। এরপরে মানুষ প্রাণী দিয়া ফাইট করানো শুরু করে। যেমন আমাদের সিলেটে বিছাল মাইর, মোরগ লড়াই হয় বা হইত। ইনারিতুর এমেরোস পেরোসে ওইদেশের কুত্তা মাইরের বিষয়টা দেখানো হইছে। এইরকম ফাইট দুনিয়ার নানা জায়গায় প্রচলিত।

এরপরের অবস্থা হল ভায়োলেন্ট ভিডিও গেইম। যখন প্রাণীদের দিয়ে ফাইট করানো আইন করে নিষিদ্ধ করা হল, যখন মানুষরে দিয়া ফাইট করানোটা সম্ভব না; তখন ভার্চুয়াল একটা রিয়ালিটিতে ফাইট এবং তাতে নিজে অংশগ্রহণ করে মানুষ তার ডেথ উইলের চাহিদা মেটায়।

সিগারেটের ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটে থাকে। সিগারেট এর প্যাকেটে এখন লেখা থাকে ধুমপান মৃত্যু ঘটায়। আমার মনে হয়, এই কথাটির কারণে এর বিক্রি আরো বেড়ে যাবে বা গেছে। এই কথা সিগারেট খাওয়া থেকে কাউকে বিরত রাখবে না। উলটা মানুষের মৃত্যু আকাঙ্খা তাকে প্ররোচিত করবে ধূমপানের দিকে।