ক্ষমতার সামাজিক প্রতিষ্ঠা তত্ত্ব

সমাজের সর্বোচ্চ ক্ষমতাকেন্দ্র রাষ্ট্র। ক্ষমতাকেন্দ্র তাদেরই কাছে টানবে যারা অলরেডি ক্ষমতাবান।

এবং এই ক্ষমতা তাদের স্ট্র্যাকচারের অন্তর্গত ক্ষমতা হতে হবে। তাদের স্ট্র্যাকচারের বাইরের ক্ষমতা হলে, ওইটারে তারা গ্রাহ্য করবে না। কারণ স্ট্র্যাকচারই ক্ষমতা।

আমরা দেখলাম মোস্তফা সরয়ার ফারুকী উপদেষ্টা হইলেন। এর আগে এবাদুর রহমানরে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিল সরকার। কিন্তু তাদেরই সমসাময়িক ব্রাত্য রাইসুরে কেন নিল না?

গত পনের বছরের আওয়ামী শাসনের সময়ে ব্রাত্য রাইসু নিয়মিত কালচারাল ন্যারেটিভ তৈরি করে গেছেন ফেইসবুকে। বলা যায়, কালচারাল দিক থেকে, যে রাবীন্দ্রিক বা কলকাতার ভদ্রলোক প্রভাবিত কালচারের উপর দাঁড়াইয়া ছিল আওয়ামী শাসন, তিনি ওই কালচারাল ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে সবচাইতে বেশী ও শক্তিশালী ন্যারেটিভ তৈরি করে গেছেন।

কিন্তু তাও তারে তো ডাকলো না।

আবার রাজনৈতিক ন্যারেটিভের দিক, সবচাইতে শক্তিশালী ভয়েস ছিলেন পিনাকী ভট্টাচার্য। তিনি একাই শক্তিশালী মিডিয়া হইয়া ইউটিউবের মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে ফ্যাসিবাদ বিরোধী বয়ান তুলে দিছেন।

কিন্তু এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পরে তারেও প্রথমদিকে গুরুত্ব দেয় নাই, সেটা তার ভিডিওতে দেখা গেছে। এখনো কোন পদে নেয় নাই। কনসালটেন্ট হিশেবে তারে কোন পদে রাখতে পারতো। যেহেতু এই বিষয়ে তার সক্রিয়তা বেশী ছিল, রিসার্চ ছিল।

আবার খেয়াল করলে দেখবেন, নতুন সরকার গঠনের পরে টিভিতে ফাহাম আব্দুস সালামের স্বাক্ষাতকার দেখা গেল, এখনো হয়ত যায়, কিন্তু পিনাকীরে দেখা গেলো না কোন টিভিতে।

আমার ধারণা, এইটা হইছে সামাজিক ভাবে তাদের প্রতিষ্ঠা নাই এইজন্য।

ব্রাত্য রাইসু যদি কোন অধ্যাপক হইতেন, বা বই প্রকাশ, পত্রিকায় লেখালেখি করে মিডিয়ার বুদ্ধিজীবী হইতেন, তাইলে তার ডাক পড়তো। যেমন নাকি সলিমুল্লাহ খানের ডাক পড়ছিল।

পিনাকীর ডাক পড়ে নাই, কারণ তার ভাষ্য, উপস্থাপন মেইনস্ট্রিমের সাথে যায় না। উপস্থাপনও একটা পাওয়ার স্ট্র্যাকচারের ভেতরে থাকা জিনিশ, আপনি কীভাবে উপস্থাপন করবেন তার স্বীকৃত নিয়ম ঠিক করে দেয় সমাজ ও ক্ষমতাকেন্দ্র। এর ব্যতয় তারা লাইক করে না। উদাহরণ হিশেবে জাহেদ উর রহমানের প্রসঙ্গ আনা যায়, তিনিও ইউটিউবে পপুলার রাজনৈতিক অপিনিয়ন দাতা। তারে সরকার এক কমিটিতে নিছে, তার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, আবার তিনি টিভিরও বুদ্ধিজীবী।

পিনাকী যদি ফ্রান্সের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হইতেন, এবং তার উপস্থাপন যদি জাহেদ উর রহমানের মত হইত, তাইলে তারেও সরকার ডাক দিত, যেমন ডাক দিছে অধ্যাপক আলী রিয়াজরে।

সমাজে যেসব প্রতিষ্ঠান আছেন, যেমন বড় নামজাদা কম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি, এগুলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাওয়ার প্রতিষ্ঠান। আরেক ধরণের শক্তিশালী পাওয়ার প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মিডিয়া।

সামাজিক প্রতিষ্ঠা বলতে আমরা জানি, কোন ব্যক্তি যদি নামজাদা কোম্পানিতে ভালো পদে কাজ করেন। সাথে তিনি যদি টিভিতে নিয়মিত উপস্থিত হইয়া কথাবার্তা বলেন, অর্থাৎ টিভিরা তারে ঐখানে নেয়। অথবা, কোন ব্যক্তি বিখ্যাত ক্রিয়েটিভ কোন লোক।

তিনি এইগুলা থেকে পাওয়ার প্রাপ্ত হন। প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে পাওয়ারের তারতম্য হয়। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া পাওয়ার বেশী হবে কোন মার্কেটিং এজেন্সি থেকে।

দুইজন ক্যান্ডিডেট যদি থাকেন, দুইজনই শিক্ষিত, ভালো চাকরী করেন, সেইক্ষেত্রে তাদের মধ্যে যিনি স্বীকৃত প্রক্রিয়ায় বুদ্ধিজীবীতা করেন ও স্বীকৃত পাওয়ারফুল মিডিয়ায় লেখেন, তিনি বেশী পাওয়ার রাখেন। এই বিচারেই ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জিয়া হাসানের চাইতে বেশী পাওয়ারফুল হন, ও ডাক পান, কিন্তু জিয়া পান না। জিয়া যদি নিয়মিত প্রথম আলোতে লেখতেন তাহলে অর্থনীতির কোন এক কমিটিতে তারে দেখা যাইত।

সাধারণ ভাবে দেখলে মনে হবে, তার এমন কী পাওয়ার আছে। আমরা মনে করি না, সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্রের যে পাওয়ার, তার সাথে এই লোকের পাওয়ারের কোন মিল আছে।

কিন্তু, একটা পাওয়ার কেন্দ্র যখন মানুষরে দেখে, তখন তার কাছে কী পাওয়ার আছে ওইটাই দেখে।

পাওয়ার কেন্দ্র দেখতেছে, উনি বড় কোম্পানিতে কাজ করেন বা অধ্যাপক, টিভিতেও ডাক পান, তাইলে তার পাওয়ার ১০। যিনি এগুলা পান না তার পাওয়ার জিরো।

পাওয়ার কেন্দ্র আরেকজন পাওয়ারযুক্ত লোকরেই নেয়।

ইউটিউবে কোন লোক বিখ্যাত হইয়া গেল, খালি ইউটিউবেই, এতে তার তেমন ক্ষমতাবৃদ্ধি হয় না বিদ্যমান সামাজিক পাওয়ার স্ট্র্যাকচারে। কারণ মূল ক্ষমতাকেন্দ্র এইটারে পাওয়ার মাধ্যম হিশেবে গ্রাহ্যই করে না। পাওয়ারে আসতে হইলে তার স্বীকৃত মাধ্যমের ভেতর দিয়া, তারই নিয়মে আসতে হবে, তবেই সে পাওয়ারফুল মনে করবে, ও দরকার পড়লে ডাক দিবে।

এই পাওয়ার স্ট্র্যাকচারের কারণেই, যারেই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, প্রায়ই দেখা যাচ্ছে সে আগে ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষে ছিল। কারণ সে স্ট্র্যাকচারের ভিতরে ছিল, স্বীকৃত মিডিয়ার ভিতরে ছিল। অনেকে বলেন, রিকশাওলাদের প্রতিনিধি কেন নাই সরকারে, ইত্যাদি প্রশ্ন। নাই কারণ এই সরকার বিদ্যমান পাওয়ার স্ট্র্যাকচারের বাইরে যাইতে চায় নাই। যেটা বিপ্লবে হয়, বিপ্লবে পাওয়ার স্ট্র্যাকচার ভাঙ্গে, নতুন ভাবে গঠিত হয়। এখানে এটা হয় নাই। এখানে শুধুমাত্র যারা আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল, তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনরে নেয়া হইছে, বলা যায় আত্মীকরণ করা হইছে। এটাই ব্যতিক্রম।


এই লেখায় আমি কাউরে ছোট বা বড় করতে চাই নাই। ওই উদ্দেশ্য থাকলে বিস্তারিত ভাবে করা যাইত। এখানে আমার উদ্দেশ্য কেবল সামাজিক পাওয়ার স্ট্র্যাকচাররে বুঝা; এবং হয়ত, পাওয়ারে যাইতে আগ্রহীদের ইনসাইট দেয়া।