গুজব তত্ত্ব

দেশে ব্জ্রপাতের কবলে পইড়া কিছু লোক মারা গেলেন। এরা বিশেষত ক্ষেত খামারে কাজ করতেছিলেন। খোলা মাঠে দাঁড়াইয়া থাকলে মাথায় বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশী থাকে। বা গাছ, ইলেক্ট্রিক খাম্বা এগুলার উপরে বজ্রপাত হইতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বজ্রপাত আধিক্যের কারণ হিসেবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কথা বলেন। বিবিসি বাংলায় দেখলাম কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন তাপমাত্রা এক ডিগ্রী বাড়ার হেতু বজ্রপাতের সম্ভাবনা দশ ভাগ বাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে বজ্রপাত বৃদ্ধি আদৌ হইছে কি না, হইলে কেন হইতেছে তা নিয়া কোন গবেষনা এখনো হয় নাই। ফলে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারতেছেন না বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু সাধারণ জনগন চায়ের দোকানে বইসা বইসা বাইর করতেছেন এই অধিক বজ্রপাতের পিছনে আছে ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়া সীমান্ত থেকে পিলার নিয়া গেছে। যে পিলার গুলা স্থাপন কইরা গেছিল ব্রিটিশেরা। এগুলা থাকার ফলে আগে বেশী বজ্রপাত হইত না।

আবার কোন কোন জায়গায় এমনো কথা উঠতেছে যে, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ার কারণে এক ধরনের জটিল রশ্মির নিঃসরন হইতেছে। এর ফলে বজ্রপাত বাড়ছে।

ভাবনাগুলা ক্রিয়েটিভ। কিন্তু এরা গুজব।

গুজব

মানুষ গুজব পছন্দ করে। প্রিন্ট পূর্ব ওরাল কালচারের মূলে ছিল এই গুজব। মুখে মুখে কথা ছড়াইত। প্রিন্টপূর্ব যুগে তথ্যের প্রবাহ এইরকমই ছিল মূলত।

ইউরোপে প্রিন্টিং এর প্রচলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি হইলেন জোহানেস  গুটেনবার্গ।

ড্যানিশ একাডেমিক থমাস পেটিট বলেন,  গুটেনবার্গের এই প্রিন্টিং প্রচলনের পরে, মানে পনের শতক থেকে প্রায় বিশ শতক পর্যন্ত এই সময়টা ছিল বৃহৎ পরিসরে মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক বাঁধা। এই পাঁচশ বছর যোগাযোগ  বাধাগ্রস্থ হইছে।

বাঁধাগ্রস্থ বলতে থমাস পেটিট বুঝাইতে চাইতেছেন মৌখিক কালচাররে হটাইয়া প্রিন্ট কালচারের চইলা আসারে। মৌখিক সংস্কৃতিতে মুখে মুখে কথা বা নানাবিদ গুজবের মাধ্যমে তথ্যের এক ধরনের প্রবাহমনতা থাকে। কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়ায় তথ্য থাকে ফিক্সড। এছাড়াও প্রিন্ট মিডিয়ায় বিভিন্ন স্তরের সেন্সর বেশী থাকে যা নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাবানেরা। [যেমন ১৯৮৩ থেকে আমেরিকার ৯০ ভাগ মিডিয়ার মালিক ছিল ৫০ টা কোম্পানি, আর ২০১৫ তে ৯০ ভাগ মিডিয়ার মালিক মাত্র ছয়টা কোম্পানি। প্রতি দশ মুভি, বই, টিভি প্রোগ্রাম, গানের মধ্যে নয়টাই এই ছয় কোম্পানি থেকে আসে।]

মানুষ যেসব গুজব তৈরী করে তা অন্যেরা পুরা গ্রহণ করে না সহজে। গুজব পালটা গুজবের তৈরী হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে গুজব সিংহভাগ মানুষ বিশ্বাস কইরা কোন ভয়ংকর কাজ কইরা ফেলতে পারে। এরকম অনেক ঘটনা পাওয়া যাইবে যে গুজবে কান দিয়া অনেকে বাজে কোন সিদ্ধান্ত নিয়া ফেলছেন। বিভূতিভূষনের উপন্যাস আরণ্যকে বুড়া নকছেদী ভকত গুজবে বিশ্বাস কইরা সরকারী লোক টিকা দিতে আইলে চাইর পয়সা ঘুষ দিয়া তারে বিদায় করে। এরপর তার সন্তান বসন্ত হইয়া মারা যায় এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী মঞ্চী কার সাথে যেন পালাইয়া যায়। গুজবের এইসব ক্ষতিকর দিক স্মরণে রাইখাও গুজবরে ভালোমত বুঝার চেষ্টা করতে হবে।

gujob

ইন্টারনেটের বিস্তারের ফলে আবার মানুষ গুটেনবার্গের আগেকার সময়ের মত  অবস্থায় চলে যাইতেছে। ডিজিটাল মাধ্যমের তথ্যগুলো ফিক্সড নয়, পরিবর্তনযোগ্য। অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদিতে তথ্য বিস্তারের বড় মাধ্যম গুজব  এবং সেই গুজবের পক্ষের বা বিপক্ষের কথাবার্তা তথা মন্তব্য। জনাব পেটিট একে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, উই আর গোয়িং ফরওয়ার্ড টু দি পাস্ট।

এর শুরু রেডিও টিভি ইত্যাদি আবিষ্কারের পর থেকে। কিন্তু ইন্টারনেট বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ার কালে এর বিস্ফোরণ হইছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাইরের নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলক কম থাকে। ফলে ইচ্ছামত গুজব তৈরীর ক্ষেত্র তৈরী হয়।

আবার বজ্রপাতের ইস্যুতে চলে যাওয়া যাক। ঐখানে যে ইন্ডিয়া পিলার নিয়া গেছে বা ইন্টারনেটের জন্য বাজ পড়তেছে বেশী এই গুজবগুলা তৈরী হইতেছে, এগুলার ক্ষেত্রে, ‘আপনি কই থেকে জানলেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে লোকেরা বলতেছে, “এইগুলা ফেইসবুকে আইছে বা ইন্টারনেটে আইছে।”

সাধারণ মানুষ, বয়স্ক মানুষ হয়ত তিনি ফেইসবুক বুঝেন না, ইন্টারনেট বুঝেন না। কিন্তু যেই গুজবটা তিনি প্রচার করছেন এর সত্যতার নিশ্চয়তা দিতে তিনি ইন্টারনেট-ফেইসবুকের রেফারেন্স দিতেছেন। কিন্তু আলটিমেটলি ঐগুলাও একই, এইসব মানুষদের মতো ডিজিটাল মিডিয়াতে কম্পিউটারের সামনে বইসা যারা গুজব বানাইতেছেন, তারা একই স্রোতের অংশ।

ডিজিটাল দুনিয়ার বাইরের পৃথিবীতে গুজব যারা রটান কোন ইস্যুতে তারা ডিজিটাল মিডিয়ার গুজব তৈরীর কারখানা গুলারে অথরিটি হিসেবে রেফারেন্স দেন, এই বিষয়টা ইন্টারেস্টিং। তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক হল গুজবের সম্পর্ক।

হঠাৎ কেউ একজন যদি ঠিক করেন গুজব বন্ধ কইরা দিবেন দেশে, পারবেন না। এমনকি সরকারও এইটা করতে পারবে না। এটা মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি। একইভাবে সোশ্যাল মিডিয়া বা ইন্টারনেটেও গুজব বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হবে না, সম্ভবও হবে না। বা এইভাবে এরে ডিল করে কোন লাভ নাই। গুজব চলবেই। এইটাই স্বাভাবিক।

gujob2

স্বাভাবিক গুজবের ফ্লো’রে বন্ধ করার চেষ্টা না কইরা এদের ডিল করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হবে তার অথরিটি ভাইঙ্গা দেয়া। অর্থাৎ, লোকদের বা ইন্টারনেট ইউজারদের মাথায় এইটা ঢুকাইয়া দেয়া যে ইন্টারনেট বা ফেইসবুকে যা দেখা যায় তার সবই বিশ্বাস করা ঠিক না। কোন ইমেজ বা তথ্যের অথেনসিটি কীভাবে সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে চেক করা যায় ইত্যাদির প্রচার করা বা তারে জানাইয়া দেওয়া। গুজবরে এইভাবে কাউন্টার করা যায়। ফেসবুক-ইন্টারনেট এর গুজব অথরিটি অবশ্য পুরা ভাঙ্গা যাবে না, কিন্তু দূর্বল করা সম্ভব। প্রিন্ট তথ্যের চাইতে ডিজিটাল মিডিয়ার তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ বেশী থাকে।

রিয়াল লাইফেও আপনে গুজব থেকে দূরে থাকতে পারবেন না, ওগুলা আপনার কাছে আসবে। দেখবেন নানা ইস্যুতে আপনার কাছের জনেরা নানা রকম গল্প বলতেছেন। একইভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও গুজব থেকে দূরে থাকার চিন্তা করা বাজে। একেবারে গুজবহীন খালি সত্য আর সত্যের ঝরনাধারায় ভাইসা যাওয়ার চিন্তা ভুল, তা সমাজে যেমন সম্ভব নয়, সোশ্যাল মিডিয়া/ইন্টারনেটেও সম্ভব নয়। গুজব যদি আপনে গুজব হিসেবে বুঝতে পারেন তাইলে একে ভয় পাবার কী আছে?

বরং, চিন্তকদের জন্য গুজবে চিন্তার অনেক উপাদান থাকে। গুজবগুলা মাঝে মাঝে অনেক ক্রিয়েটিভ হয় এবং তাতে কল্পণাশক্তির ভালো ব্যবহার থাকে। অনেক সময় তা মানুষের আচার আচরণ ও চিন্তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা দিক প্রকাশ করে।

পুনশ্চঃ রাজনৈতিক দলদের নির্বাচনের কালে ডিজিটাল মিডিয়ার গুজব ট্যাকল দেয়াকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। কারণ বিপক্ষ দল গুজব তৈরী এবং ব্যবহার করে ভোট পাইবার ধান্দায় থাকতে পারে। এবারের আমেরিকার ইলেকশনে (২০১৬) সোশ্যাল মিডিয়ার গুজব নিউজ বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিছেন।

 

অন্যান্য মানসিক নকশাগুলি সম্পর্কে জানুন।