একবার সাহিত্যিক আহমদ ছফা খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন। সেই গল্প অনেকেই জানেন।
এনজিও ব্যুরো থেকে ‘বাংলা জার্মান সম্প্রীতির’ রেজিস্ট্রেশন করতে তিনি ফোন দেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অফিসে। বেগম জিয়ার পিএস ফোন ধরেন।
ছফা বললেন ম্যাডামরে একটু দেয়া যাবে।
পিএস বললেন আপনি কে।
ছফা বললেন, আমি আহমদ ছফা। পিএস বললেন কোন আহমদ ছফা? এতে ছফা রেগে যান, এবং রাগলে তার মুখ দিয়ে যে গালি বের হত তা দেন। ও বলেন, বাংলাদেশে আহমদ ছফা দুজন আছে নাকি। বলে তিনি ফোন রেখে দেন।
একটু পরে বেগম জিয়া তারে ফোন দিয়েছিলেন।
ছফা প্রধামন্ত্রীকে বলেন, ম্যাডাম, কী সব অশিক্ষিত পিএস টিএস রাখেন আহমদ ছফার নাম জানে না।
বেগম জিয়া উত্তর দেন, আমি নিজে অশিক্ষিত; শিক্ষিত মানুষ পাব কোথায়? আপনারা কেউ তো এগিয়ে আসছেন না।
গল্পটা এইরকম।
এই গল্পে ছফার হিরোইজম প্রকাশ পায় না। তার আমিত্ম প্রকাশ পায় ও চূড়ান্ত অভদ্রতা প্রকাশ পায়।
কেউ একজন না চিনলেই গালি দিতে হবে? ও ছফা, এতো বই পড়ে, জ্ঞানার্জন করে, এই ধরল বৃক্ষে?
আরও দেখেন, পিএস, এর দিক থেকে, তিনি হয়ত নিশ্চিত হতে চাইছেন, ইনি সাহিত্যিক ছফা কি না। পিএস এর কাজই তো এই। যে কেউ ফোন করলেই বসরে নিয়া দিবেন না। আগে যাচাই করবেন।
ছফা ওই লোকটিকে তার কাজ ভালোভাবে করার জন্য রেগে গেলেন। রাগলে তার মুখ থেকে কোন গালি বের হত জানা নাই, খানকির পোলা টাইপের কিছু কী? ঐটা তিনি দিয়ে বসেন।
আমরা জানি পরে বেগম জিয়া ফোন দেন ছফারে। তাদের কথাবার্তা খেয়াল করেন, ছফার তখন এই পাওয়ার ছিল, প্রধানমন্ত্রী তারে চিনতেন ও সম্মান দিতেন। অনেক লেখকেরা, অভিনেতারা, স্টার খেলোয়াড়েরা এই সোশ্যাল ক্যাপিটাল সংগ্রহ করতে পারেন তাদের কাজ এবং গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে।
এই গল্পটার উৎপত্তি ছফার ভাতিজা নূরুল আনোয়ারের লেখা থেকে, ছফামৃত কিস্তি ৭। সেই লেখাতে দেখা যায়, তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাস প্রকাশের পর খালেদা জিয়া সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। এইসময়ে ছফা আনুপূর্বিক তসলিমা এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর বইটি লিখেন। এই বইতে তিনি তসলিমা নাসরিনের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। সেই বই ছফার বন্ধু, এবং খালেদা জিয়ার পরিচিত নাজিম উদ্দীন মোস্তান সাহেব খালেদা জিয়ার কাছে পৌঁছান। সেইখান থেকেই খালেদা জিয়া ছফাকে চিনতেন। খালেদা জিয়া খুশি হয়ে ছফাকে দাওয়াতও করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী দেশের যে লোকদের দাওয়াত করেন তারা পাওয়ারফুল, এই বাংলায়।
খালেদা জিয়ার এহেন তৎপরতা হচ্ছে বিএনপির জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অংশ। এটা সাহিত্যিক আগ্রহ না, বিএনপি চায় লিবারেল, ভারতবিরোধী, আওয়ামীলীগের সমালোচক, মুক্তিযুদ্ধের বিদ্যমান ন্যারেটিভকে প্রশ্ন করা বুদ্ধিজীবীদের।
এই পাওয়ারের তেজেই ছফা অন্যায়টা করেছিলেন, দূর্বলের প্রতি। ছফার এই অভদ্র বাজে আচরণরে মহান বানানোর কিছু নাই। এটা তার দূর্বলতা ছিল, ক্ষুদ্রতা ছিল।
কোন খারাপ জিনিশরে খারাপ না বলা খারাপ, কিন্তু একে মহান হিশাবে প্রমাণ করা ক্রাইমের সমতুল্য।
আপনি সাহিত্যিক হোন বা বৈজ্ঞানিক, আপনারে সব জায়গায় সবার চিনতে হবে, এমন বাচ্চাসুলভ মনোভাব ঠিক না। সবার যার যার লাইফ আছে, কাজ ঝামেলা আছে। এখন অনেকে বলতে পারেন এখন সাহিত্যিকেরা সরকারী কর্মকর্তাদের তেলায়, ছফা তো ঐটা করেন নাই।
এই কম্প্যারিজন বাজে। কারণ কোন খারাপ কাজ তার চাইতে খারাপ কাজের সাথে তুলনা দিলেই ভালো হয় না।
—–
কোন ঘটনা কীভাবে ঘটেছিল তা এক জিনিশ, এবং কীভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে তা আরেক জিনিশ। উপস্থাপিত ঘটনা ঐ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা না, উপস্থাপিত হতে থাকা নিজেই একটা ঘটনা। তাই কীভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, এর উদ্দেশ্য কী, ইমপ্যাক্ট কী হবে, এইসব বিবেচনায় নিতে হয় আলাপের সময়।
যেমন এই যে গল্প ছফার, নূরুল আনোয়ারের লেখায় আরেকটা অংশ ছিল ঠিক পরপরই, যেখানে তিনি খালেদা জিয়ার প্রশংসা করেছিলেন। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ফেসবুকে, ও নানা সাইটে এই গল্প যখন ভাইরাল হয়, তখন ঐ অংশটা বাদ দিয়ে হয়।
ওইখানে ছফার প্রতিক্রিয়া প্রকাশে নূরুল আনোয়ার লিখেছেন, “তিনি বেগম জিয়ার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে বারবার বলে যাচ্ছিলেন, ভদ্রমহিলার তারিফ না করে পারা যায় না। তিনি আশ্চর্য রকম বিনয়ী।”
—
ছফা বিষয়ে প্রশ্নোত্তর
একজন বাংলাদেশী লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী। ৩০ জুন ১৯৪৩ সালে জন্ম, মৃত্যু ২৮ জুলাই ২০০১ সালে।
যদ্যপি আমার গুরু, পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ, বাঙালি মুসলমানের মন, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, গাভী বিত্তান্ত, ওঙ্কার, শতবর্ষের ফেরারী: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । তিনি ইয়োহান ভোলফ্ গাঙ ফন গ্যোতের ফাউস্ট বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন।