ট্রমা লইয়া

ট্রমা কীভাবে কাজ করে তা আমির খানের তালাশ ফিল্ম যারা দেখছেন, তারা স্ক্রিনে দেখতে পাইছেন।

ওই ফিল্মে আমির খান এক পুলিশ অফিসার। উনি রাতে ঘুমাইতে পারেন না, কারো সাথে কথা বলেন না, গম্ভীর এবং ট্রমাটাইজড ক্যারেক্টার হিশেবে তারে আমরা দেখি। তার স্ত্রী রাণী মুখার্জীরও একই দশা। ফিল্ম চলতে থাকলে আমরা জানতে পারি, একদিন আমির খান, যার ফিল্মের নাম শেখাওয়াত, গেছিলেন ফ্যামিলিরে নিয়া বেড়াইতে। তিনি ও তার স্ত্রী টায়ার্ড অবস্থায় শুইয়া ছিলেন পার্কের মাঠে, তখন তার বাচ্চা ছেলে আইসা বলে আমরা ঘুরে আসি। তারা বলেন, ঠিক আছে। বাচ্চা এবং তার বন্ধু স্পিডবোট নিয়া পানিতে চলে যায়। স্পিডবোট ডুবে যায়, আর চিৎকার শুনে জামাউ বউ দুইজনই পানিতে ঝাঁপ দেন। ছেলের বন্ধুরে বাঁচাইতে পারলেও ছেলে মারা যায়।

শেখাওয়াত এবং তার স্ত্রী দুইজনই এই ঘটনারে মেনে নিতে পারেন না। তাদের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়।

আমরা দেখি তাদের পরস্পরের মধ্যেও কথাবার্তা খুবই অল্প হয়। সম্পর্ক যেন নাই নাই।

দেখি আমির খান তথা অফিসার শেখাওয়াত ঘুমাইলেই স্বপ্নে দেখেন বা ভাবেন, ওই দিনের কথা, যেদিন তার ছেলে আইসা বলছিল আমরা ঘুইরা আসি। স্বপ্নে তিনি উত্তরে বলেন, ঠিক আছে, কিন্তু আমিও আসতেছি লগে।

অর্থাৎ, তার গিল্ট কাজ করতেছে অনবরত। তার ব্রেইনের এক অংশ ঘটনাটারে মেনে নিতে পারতেছে না। তিনি মনে করতেছেন ওইদিন আমি যদি তাদের একা যাইতে না দিতাম। ওইদিন যদি আমি না ঘুমাইতাম। ওইদিন আমি কেন ঘুমাইলাম। আমি ওদের সাথে গেলেই তো ছেলেটা মারা যাইত না। সব দোষ আমার।

তিনি ভাবেন, হয়ত তার স্ত্রীও এমন ভাবতেছেন, মনে মনে তারেই দোষ দিতেছেন। এইজন্য বউয়ের সাথেও দূরত্ব বাড়ে।

অর্থাৎ, তাদের দুইজনের সম্পর্কের মাঝে তখন ওই ট্রমা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার নাম যেমন, মধ্যবর্তী বিষণ্ণতা।

পরে আমরা দেখি তিনি একটা কেইস সমাধা করতে কারিনা কাপুরের লগে কথাবার্তা বলেন। তিনি তার কথাবার্তায় আকৃষ্ট হন, এবং তার গিল্টমুক্তির শুরু হয়। কারণ এই কথাবার্তাটা হইতেছে থেরাপির মত। অন্যদিকে, তার স্ত্রী রানী মুখার্জির লগে পরিচয় হয় এক সাইকিকের। যে বলে তোমরা তোমাদের ছেলের সাথে কথা বলতে পারবা। কুসংস্কারে বিশ্বাস না করলেও রানী ওইখানে যান, এবং সাইকিকের কর্মকাণ্ডে বিশ্বাস স্থাপন করেই ফেলেন। ওই খানে যাইতে যাইতেই তিনি স্বাভাবিক হইয়া উঠেন। এটা তার জন্য হয়ে যায় ট্রমারে ম্যানেজ করার স্ট্র্যাটেজি।

যারা ভিনল্যান্ড সাগা দেখছেন, তারা জানেন, দ্বিতীয় সিজনে আমার প্রিয় নায়ক থরফিন ট্রমায় প্রায় বোবা হইয়া যায়। সে তখন ফার্মে কাজ করে, কিন্তু তার কার্লসেফনি, যোদ্ধাজীবনের স্মৃতি তারে হন্ট করতে থাকে। সে প্রতিদিন দুঃস্বপ্ন দেখে, যাদের সে মারছে ওই মানুষগুলা তারে নরকে টেনে নিয়ে যাইতেছে। আইনার যখন কেটিলের ফার্মে কাজ করতে আসে, সে থরফিনের সাথে কথাবার্তা বলার ট্রাই করতে থাকে, তখন যত কথা বলতে থাকে ততো থরফিন তার ট্রমা থেকে বের হইয়া স্বাভাবিক হইতে থাকে।

শেখায়াতের তালাশে, শেখায়াতের ট্রমার যে রূপায়ণ ছিল, তার মূলে আছে, ওই রিয়ালিটিটা ভিন্ন হইতে পারতো। এই চিন্তা থেকে সে বের হতে পারে না। বেসিক্যালি ট্রমার ফাংশন এইরকম। ঘটনাটা বার বার তার ভিতরে ঘটতে থাকে, সে এটারে নানাভাবে সাজায়, এবং সাইকোলজিক্যাল স্ট্রেস অনুভব করে। বের হইতে না পারলে, এক্সট্রিম ফর্মে গেলে, মানুষ অস্বাভাবিক হয়ে যায়।

আগে এক লেখায় লেখছিলাম, শেখ হাসিনার এটা থাকার ভালো সম্ভাবনা আছে। অবশ্যই তার ফ্যামিলির প্রায় সবার নির্মম আকস্মিক হত্যা তারে মারাত্মক ভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি নিশ্চয়ই ওই ঘটনারে বার বার ঘটতে দেখেন। ফলে তার কাছে ওইটাই একটা রিয়ালিটি।

তার দুই ধরণের উপস্থাপন আমরা দেখি। তার বিরোধীরা তারে সাইকোপ্যাথিক হিশেবে দেখান। যেমন রেন্টু সাহেবের বইতে ছিল। আবার, আমরা তার হিংস্র হবার চিত্র সরাসরিও দেখলাম। সোহেল তাজও এইটা বললেন ইঙ্গিতে। অন্যদিকে, লীগের সমর্থকেরা আপা খুবই মানবিক ও ভালো, এমন চিত্র দেখাইতে চান।

তিনি খুবই মানবিক হবার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। তার কাজ এর প্রমাণ দেয় না। দ্বিতীয়ত, তিনিও মানুষ, ফলে তার ফ্যামিলির এত বড় হত্যাকাণ্ডের ট্রমা তার উপর কোন প্রভাব ফেলবে না, এটা বলা যায় না।

তিনি ক্যারিশম্যাটিক, লয়াল সমর্থক তৈরি করতে পারেন এতে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু জুলাইতে তিনি যেভাবে ছাত্র জনতারে হ্যান্ডেল করলেন তাতে এই প্রশ্ন অবশ্যই আসে, তার ট্রমাই কি তারে পরিচালিত করতেছিল?

আর দল হিশেবে আওয়ামীলীগের বর্তমান যে অবস্থা, সেটাও ট্রমাটাইজড। ডেনায়াল এবং ডিল্যুশনের মধ্য দিয়া তারা এর প্রকাশ করতেছেন। যেন কিছু হয় নাই ওইসময়, যেন তাদের কোন দোষ নাই। অবশ্যই তাদের মধ্যে এখন বার বার এই কথা উঠতেছে, এইটা যদি ওইরকম হইত, ওইটা যদি এইরকম করতাম, তাহলে এটা হইত না।

যদি তারা অনেস্ট কনভার্সেশনে যান নিজেদের মধ্যে, এবং বাইরের কোন এন্টিটির সাথে, তাহলে হয়ত তারা এটা থেকে বের হবার পথ পাবেন। ব্যক্তির জন্য বাইরের এন্টিটি হয় থেরাপিস্ট, বা অন্য কোন ব্যক্তি। কিন্তু দলের ক্ষেত্রে এটা হবে আবার রাজনীতিতে ব্যাক করা ও রাজনৈতিক একটিভিটিতে চলে যাওয়া। এইজন্য পূর্বের ধাপ হইল, কৃতকর্মের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া। যত তাড়াতাড়ি এটা তারা করতে পারবেন, নিজেদের মধ্যে, এবং জাতির সাথে সৎ কনভার্সেশনে যাইতে পারবেন, তত তাদের এই ট্রমা থেকে উত্তরণ সহজ হবে।