ডারউইনের বিবর্তনবাদ দিয়া সাহিত্যজগত বুঝা

চার্লস রবার্ট ডারউইন

বিবর্তন হচ্ছেন পরিবর্তন। সময়ের সাথে পরিবেশের লগে নানাবিদ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার দরুন যেসব শারিরিক, কাঠামোগত, আচরনগত পরিবর্তন সাধিত হয়। চার্লস রবার্ট ডারউন এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস আলাদাভাবে এই তত্ত্বে পৌছান। ডারউন তার ইনসাইট বা অন্তর্দৃষ্টি পেয়েছিলেন থমাস ম্যালথাসের প্রবন্ধ পড়ে। থমাস ম্যালথাস বিখ্যাত তার ম্যালথেশিয়ান পপুলেশন ট্র্যাপ এর জন্য। পপুলেশন বা জনসংখ্যা তত্ত্বের প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, মানুষের বাচ্চাকাচ্চা যে হারে বাড়ে, খাদ্য উৎপাদন সেই হারে বাড়ে না। ফলে একসময় খাদ্যের চাইতে মানবজাতির বাচ্চাদের সংখ্যা বেড়ে তারা কিলবিল করতে থাকে। তখন নানাবিদ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ ইত্যাদির উদ্ভব হয় এবং তা খাদ্যের সাথে মানবসংখ্যা বৃদ্ধিরে চেক দিয়ে রাখে। তা পড়ে ডারউইনের মাথা খোলে যায়। ইনসাইট কে কীভাবে পাবেন তা সঠিক বলা যায় না। ম্যালথাসের প্রবন্ধ এর আগে হাজার হাজার লোকে পড়েছে কিন্তু ডারউইনের মত করে কেউ ভাবে নাই। অন্যে যা দেখে না তা দেখার উপায় বইতে ইনসাইট বিষয়ে আলাপ আছে। এছাড়া, ম্যালথাসের বিষয়ে একটা দারুণ প্রবন্ধ আছে ডঃ আকবর আলী খানের পরার্থপরতার অর্থনীতি বইতে। আগ্রহীরা দেখলে দেখতে পারেন।

চার্লস রবার্ট ডারউইন
ছবি- রবার্ট ডারউইন

এই লেখায় সাহিত্যজগতকে দেখা হবে ডারউইনের বিবর্তনবাদের দৃষ্টিতে। বিবর্তনবাদ যেহেতু মানুষ নিয়াও এবং যেহেতু মানুষই এই সাহিত্য করে তথাপি বিবর্তনের মূলনীতি দিয়া সাহিত্যজগত বুঝা যাইতেই পারে।

ডারউইনের তিন অবজার্ভেশন ছিল।

(ক) প্রায় প্রত্যেক প্রজাতিতেই যত সংখ্যক বাচ্চা টিকে থাকে (টিকে থাকা বলতে সারভাইভ বা যৌবনে উত্তীর্ন এবং পুনরোৎপাদন বুঝানো হচ্ছে) তার চেয়ে বেশী বাচ্চার জন্ম হয়। প্রজাতি বলতে যারা উৎপাদনশালী সন্তান তৈরীতে সক্ষম। যেমন, কুত্তা, শেয়াল, চামচিকা, ছাগল, মানুষ ইত্যাদি।

ডারউইন দেখলেন এর কারণ দুইটা বা দুই জিনিশ হয় এর জন্য-

[star_list]

  • যেহেতু খাদ্য কম তাই তাদের মধ্যে প্রতিযোগীতা শুরু হয়। বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে এবং প্রজাতির ভিতরের প্রানীদের মধ্যে।
  • যেহেতু সময়ের সাথে পরিবেশ পরিবর্তন হয় তাই নানা ধরনের বিপদের সম্ভাবনা থাকে। দুর্যোগ, হিংস্র প্রাণী ইত্যাদি। ফলে বাচ্চাদের বেঁচে থাকার উপরে একটা থ্রেট থাকে সব সময়।

[/star_list]

(খ) একই প্রজাতির ভিতরের প্রাণীগুলোর মধ্যে বড় ভিন্নতা বিদ্যমান। তাদের কোষের স্ট্র্যাকচার, যুদ্ধ ক্ষমতা, সামাজিক দক্ষতা ইত্যাদিতে পার্থক্য থাকে। এই ভিন্নতার কারণে তারা ইউনিক হয় এবং এটা তারা বংশান্তরে স্থানান্তর করতে পারে বাচ্চাদের মধ্যে। কিন্তু বাচ্চারাও ইউনিক হয়, পুরো মা বাবার মত হয় না।

(গ) পৃথিবী নিয়ত পরিবর্তনশীল। প্রজাতি পরিবর্তিত হয়, পুরাতন প্রজাতি চলে যায়, নতুনেরা আসে।

ডারউইনের এই মূলনীতিগুলো বা মূল তিন অবজার্ভেশন দিয়ে সাহিত্যজগত বুঝা যাক।

সাহিত্যে বিভিন্ন প্রজাতি আছে। যেমন, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি। এই প্রত্যেক প্রজাতিতেই অসংখ্য কবি লেখক তৈরী হতে থাকেন প্রতিনিয়ত। তারা লেখছেন, কবিখ্যাতি বা লেখকখ্যাতি পাইতে চাচ্ছেন। কিন্তু এদের মধ্যে অতি অল্পরাই টিকে থাকেন।

টিকে থাকার অর্থ প্রভাব বিস্তারী হওয়া। যার লেখা বা চিন্তা থেকে আরো নানা লেখা ও চিন্তার উৎপাদন হয়। যেমন, বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এনারা।

যেহেতু অল্পরাই টিকে, যেহেতু স্বীকৃতি পাবার জায়গা অল্প তাই বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে পারস্পারিক প্রতিযোগীতা বিদ্যমান থাকে। এর পেছনে কাজ করে হিংসা এবং টিকে থাকার প্রতিযোগিতা। [হিংসার পেছনেও খাদ্য বা খাদ্যের রিসোর্স নিয়ে প্রতিযোগীতার ধারণা বিদ্যমান, তা এখানে পড়তে পারেন।]

স্বীকৃতি পাবার সুযোগ অল্প, সাহিত্যের জগতে টিকে থাকা কঠিন, সময়ের সাথে পরিবেশের পরিবর্তন এবং মানবজীবনের নানাবিদ দৈব ঘটনা (যেগুলোর উপর মানুষের কোন হাত নাই) থাকার দরুণ সবসময়ই কিলবিল করতে থাকা লেখক কবিদের লেখক হিসেবে বেঁচে থাকার উপরে একটা থ্রেট বা হুমকি বর্তমান থাকে।

ডারউইনের দ্বিতীয় অবজার্ভেশনের মতো, এখানেও একই প্রজাতির ভিতরের প্রাণীদের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। সব কবিরা একরকম নন। প্রতিষ্ঠিত লেখক কবিদের আলাদা আলাদা লেখার ধরন, ভাব বা বিষয় থাকে। এমনকী একজন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পুরাপুরি তার মত হওয়া যায় না, ভিন্নতা থাকে।  রবীন্দ্র প্রভাবিত কবিরাও পুরা রবীন্দ্রনাথের মতো লেখতে পারবেন না।

পৃথিবী নিয়ত পরিবর্তনশীল। এর মত সাহিত্যের জগতও। বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদ ও তার সান্ধ্যভাষা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব কবিতা, মঙ্গলকাব্য, কবিগান, আধুনিক গদ্য ইত্যাদি নানা পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে গেছে সময়ের সাথে সাথে। পরিবেশ পরিবর্তিত হয়েছে। লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গী, লেখার ধরন বদলেছে। নতুনেরা আসিয়াছেন, পুরাতনেরা চলে গেছেন। এইমত হয়ে আসছে। এবং হবে।

পৃথিবী নিয়ত পরিবর্তনশীল। এর মত সাহিত্যের জগতও। Share on X

ডারউইনের তত্ত্বের নাম প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন। কিন্তু এই যে নির্বাচন, এতে প্রকৃতির কোন মাথাব্যথা নাই। কে টিকে যাবার জন্য নির্বাচিত হইলেন বা কে না; এটা সে দেখে না। বিবর্তনের কোন লক্ষ্য নাই। যেসব প্রাণী টিকে যান কারণ তারা টিকে যাবার জন্য শারিরিক, কাঠামোগত, আচরনগত ইত্যাদি এমনসব বৈশিষ্ঠ্য অর্জন করেন যা তাদের ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচায়। এবং তারা পরিবেশগত কিছু সুবিধাও পান।

সাহিত্যজগতে টিকে থাকার ক্ষেত্রেও যারা নিজ চেষ্টায় সেই শক্তি অর্জন করতে পারেন, তাতে টিকে যাবার সম্ভাবনা বাড়ে। সেই শক্তি অর্জনের উপায়, পূর্ববর্তী শক্তিশালী লেখকদের পড়া, সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ন চিন্তকদের চিন্তার সাথে পরিচিত হওয়া, চিন্তা, পৃথিবীর শক্তিশালী চিন্তা সম্পর্কে জানা এবং নিষ্কাম জ্ঞানসাধনা। আর বাকীটা প্রতিভা।

সাহিত্য জগতের টিকে থাকারে অবশ্য পুরা বিবর্তনের টিকে থাকার সাথে মিলানো যাবে না। সাহিত্যের টিকে থাকা মানে শিল্প-সাহিত্যে প্রভাবে, শিল্পগুণে স্বমহিমায় টিকে থাকা। যা জীবিত থাকারই মতো। আর বিবর্তনে টিকে থাকা বলতে টিকে থাকারেই বুঝায়, পুনরোৎপাদন করতে করতে বেঁচে থাকা। যেমন, আমাদের রান্নাঘরের পরিচিত তেলাপোকা ভাইয়ারা। ৩২৫ মিলিয়ন বছর আগেও তারা ছিলেন, এখনো আছেন; সেই চিরচেনা। কিন্তু তারে কেউ পুছে না। আর ডাইনোসরেরা পৃথিবীতে অল্পকালই ছিলেন। কিন্তু তাদের নিয়া মানুষের কী উৎসাহ! মানুষের কথাই ধরা যাক। মানুষের পূর্বপুরুষ বলতে যাদের ধরা হয় এরা এই ছয় মিলিয়ন বছর আগের। আর মানবসভ্যতা বলতে আমরা যা বুঝি তা শুরু হইছে মাত্র ৬ হাজার বছর আগে। তেলাপোকাদের বয়সের তুলনায় মানুষেরা বাচ্চাও না। কিন্তু জ্ঞানে বিজ্ঞানে মানুষেরা তাদের চাইতে কতো আগাইয়া গেলো! তেলাপোকারা রইয়া গেল রান্নাঘরেই।