ভাষা
আমরা যখন কোন গোলাপ দেখি, সাথে সাথেই বলে ফেলি এটা গোলাপ। আমরা বলি না যে, আমরা গোলাকৃতির একটি বস্তু দেখছি লাল এবং পিংক বর্নের। আমরা এভাবে বলি না, আমরা সাথে সাথেই আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কনসেপ্টে নিয়ে যাই।
[…]
আমরা কনসেপ্ট ছাড়া বাঁচতে পারি না। কারণ বাস্তব অভিজ্ঞতা এত বিশৃঙ্খল ও এত এত সমৃদ্ধ যে আমাদের মস্তিষ্ক তা বুঝে ভাষার মাধ্যমে, ভাষার মাধ্যমেই আমরা বুঝি যে আসলে কী ঘটছে। আমরা অনেক কিছু বাদ দেই, খুবই জেনারালাইজ করি বুঝার জন্য, এই বুঝাটা আমরা কখনোই পারতাম না যদি ভাষা না থাকত।
অলডাস হাক্সলী- দ্য ডিভাইন উইথিনঃ সিলেক্টেড রাইটিংস অন এনলাইটনমেন্ট
ভাষার গুরুত্ব এই, আমাদের বাস্তব জীবনে যেসব বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতা তাদের কনসেপ্টে নিয়ে বুঝতে সাহায্য করে। যেমন, মাটির উপরে এক কান্ড দাঁড়িয়ে আছে, তার থেকে আরো কান্ড বেরিয়েছে, এবং আরো অনেক কিছু, খুবই বিস্তৃত সে। আমরা দেখেই বুঝে নেই সে আসলে গাছ। তাই তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য, কী কী আছে তার মধ্যে, সবুজ সবুজ পাতা, শেকড় বাঁকড় ইত্যাদি, এগুলি নিয়ে আবার নতুন করে আমাদের বুঝতে হয় না সে গাছ না মাছ। আমাদের ভেতর প্রোগ্রাম করা আছে, ভাষা দিয়ে, দেখার সাথে সাথেই মিলে গেলে সাথে সাথে মস্তিষ্কে সিগনাল যায় বস্তুটি গাছ। কিন্তু এমন কোন জিনিস যদি আমরা দেখি যা আমাদের ভাষায় নাই, আমরা তাকে বুঝতে সমস্যায় পড়ব।
কবিতা
এখানে, আরেকটা জিনিস উল্লেখ করা যায় গাছের কথা যখন আসল। কবিতার কাজ কী? একটি কাজ মানুষের এমন অনুভূতিকে প্রকাশের ভাষা দেয়া যা সে প্রকাশ করতে পারে না। অথবা সে অনুভব করত যে এমন কিছু অনুভূতি তার ভেতরে আছে হয়ত, কিন্তু বস্তুটি যে আসলে কী, তা সে নিজেই জানত না।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় যখন লিখেন,
একটি নিষ্পাপ গাছ আমাদের মাটিতে বসে
বাস্তুর নিকটে আছে, বুকভরা মায়ার নিকটে
এই কবিতা পড়ে মনে হয়, এই কবিতাতে ব্যক্ত হওয়া অনুভূতি আমার ভেতরে ছিল, হয়ত ছিল, কিন্তু এটি পড়ার আগে জানতাম যে পুরোপুরি ছিল। ফলে, এই কবিতা আমাকে গাছ সংস্লিষ্ট এক অনুভূতি প্রকাশের ভাষা দিল। বড় কবিদের এই শক্তি থাকে, তাই তাদের বলা হয় ঈশ্বরের জিভ।
শব্দ, বস্তু ও তাদের সম্পর্ক
আবার একই জিনিসের দুই ভাষায় নাম ভিন্ন হয়। যেমন, বাংলায় কাগজে লেখা, বাঁধাই করা বস্তুটিকে বই বলে। ইংরাজিতে বলে বুক। এই বুক ও বই আসলে কনসেপ্ট, ঐ বাঁধাই করা বস্তুটিকে বুঝার জন্য একটা নাম দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাঁধাই করা ঐ বস্তুটির সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই।
অথবা আমাদের যার যার নাম। আমাদের নাম আমাদেরকে বুঝার জন্য দেয়া হয়েছে। যে অমুক কাজটি করেছে, তমুক ভালো লোক। মজিদ তিনজন থাকলে ক্লাসে এক এক মজিদের আগে আলাদা অংশ জুড়ে দিয়ে অন্যরা বুঝার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের নামের সাথে কনসেপ্টচুয়াল সম্পর্ক ছাড়া আর কোন সম্পর্ক নাই আমাদের সাথে।
যেমন, একটি শব্দ কম্যুনিজম। এটির অর্থ একজন কীভাবে বুঝবেন? তিনি বুঝবেন ক্যাপিটিলাজিম, ডিক্টেটরশীপ, ফ্যাসিবাদ, রাষ্ট্র, মানুষ ইত্যাদির সাপেক্ষে। সব শব্দের ক্ষেত্রেই এমন। যেমন বই, আমরা বুঝি কাগজ, তার উপরে লেখা, বাঁধাই, প্রচ্ছদ, প্রচ্ছদের ছবি, প্রকাশক, লেখক, প্রিন্টিং ইত্যাদির সাপেক্ষে। কেবল একক ও আলাদাভাবে শব্দের কোন অর্থ হয় না।
প্রমিত ভাষা ও মিশ্র ভাষা
প্রমিত ভাষার অর্থ একটা মানে নেয়া হয়েছে যে ভাষাকে। অর্থাৎ, আগে অঞ্চলের লোকেরা যে ভাষায় নিজেদের মধ্যে, বাইরের লোকদের মধ্যে কথা বলত তা মানমত ছিল না ধরে নেয়া হয়েছে। এই ভাষা পরিবর্তন করে, কাটছাঁট করে বানানো হয়েছে মান ভাষা। বলা হয়ে থাকে এর কারণ যাতে সবার বোধগম্য একটি ভাষা নির্মান করা যায়। এ কারণ ঠিক হতে পারে রাষ্ট্র শাসন ক্ষমতার সুচারু প্রয়োগের জন্য। শিল্প সাহিত্য চিন্তা এমনকী মানব সভ্যতার বিচারে এ যুক্তি ফালতু।
শিল্পে সাহিত্যে শৃঙ্খলা আনার কথা বলা হতে পারে তথাকথিত প্রমিত বা মান ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে। কিন্তু তা ভুল, কারণ এমন শৃঙ্খলা শিল্পের অন্তরায়। উপরন্তু, এটি প্রতারণা, যেমন মানববিধ্বংসী অস্ত্র ইরাকে আছে অজুহাতে আমেরিকা ইরাকে হামলা করেছিল তেমন বিষয়, কারণ বিধ্বংসী অস্ত্র ইরাকে ছিল না। শৃঙ্খলা দরকার রাষ্ট্রের, ক্ষমতা কাঠামোর, নিজেদের শাসন জারি রাখতে। সাহিত্যের নয়।
সব ভাষা মান ভাষায় রূপান্তর ভালো না খারাপ
একসময় মানুষ বন জঙ্গলে ছোট ছোট গ্রুপ করে থাকত। তাদের দলের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ভাষা ছিল। সাধারণত কিছুদূর পরপরই দেখা যেত দলগুলির ভাষা পরিবর্তন হয়ে গেছে। ভিন্ন ভাষায় কথা বলছে লোকে।
জ্যারেড ডায়মন্ড তার থার্ড শিম্পাঞ্জি বইতে ভাষা বিলুপ্তি নিয়ে লিখেছেনঃ
“সাংস্কৃতিক বৈচিত্র দেখা যায় ভাষার বৈচিত্রের মধ্যে। কিন্তু প্রচুর প্রচুর ভাষা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ইউরোপে এখন আছে প্রায় পঞ্চাশটি ভাষা। এদের বেশীরভাগ ইন্দো ইউরোপিয়ান নামের একটি ভাষা পরিবারেরই সদস্য। অন্যদিকে, নিউ গায়ানার আয়তন ইউরোপের দশ ভাগের একভাগ, জনসংখ্যায় ইউরোপের শতভাগের এক ভাগ, কিন্তু ওখানে ভাষা আছে শত শত। এদের অনেকগুলিই নিউ গায়ানা বা পৃথিবীর অন্য এলাকার ভাষা থেকে সম্পূর্ন আলাদা। নিউ গায়ানার একটি ভাষায় গড়ে প্রায় কয়েক হাজার লোক কথা বলেন, যারা প্রায় দশমাইলের ভেতরে পরস্পরের কাছাকাছি বসবাস করেন।
“পৃথিবী আসলে এরকমই ছিল। প্রতিটি একাকী ট্রাইবের ছিল আলাদা ভাষা। কৃষির উন্নতির সাথে সাথে এ অবস্থা বদলে যেতে শুরু করল, কিছু দল বড় হতে থাকল লাগল শক্তিতে, ক্ষমতায় আর তাদের ভাষা ছড়িয়ে দিতে লাগল বিস্তৃত এলাকায়। মাত্র ছয় হাজার বছর আগে ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষা পরিবার বিস্তৃত হতে শুরু করে, এবং বাড়তে বাড়তে ইউরোপের প্রায় সব ক’টি প্রধান ভাষার উৎসে পরিণত হয়। একই জিনিস গত কয়েক হাজার বছরে হয়েছে আফ্রিকায়, সেখানে বানতু ভাষা পরিবার বিস্তৃত হয়ে আফ্রিকা, দক্ষিণ সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন অন্য ভাষাগুলিকে গ্রাস করে ফেলেছে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়, শত শত ইন্ডিয়ান ভাষা গত কয়েক শতাব্দিতে বিলুপ্ত হয়েছে।
এই ভাষা হারানো কি ভালো জিনিস, কারণ কম ভাষা হলে তো যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুবিধা? হয়ত, কিন্তু এটা খারাপ জিনিস অন্য আরো অনেক দিক থেকে। ভাষাগুলি গঠনগত ও শব্দ ভান্ডারের দিক থেকে আলাদা হয়। তারা আলাদা হয় অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে, এবং ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের দিক থেকে। একেক ভাষা একেক ভাবে আমাদের চিন্তাকে আকৃতি দেয়, মানস কাঠামো গড়ে তুলে। কোথাও কোন “সবচাইতে সেরা” ভাষা নেই। প্রকৃতপক্ষে, ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য বেশী উপযুক্ত। যখন কোন ভাষা হারিয়ে যায় তখন আমরা আসলে যারা এই ভাষায় কথা বলত তাদের এই পৃথিবীকে দেখার এক ইউনিক জানলা হারিয়ে ফেলি।” – জ্যারেড ডায়মন্ড
বাংলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকেরা যখন একসাথে কথা বলেন, তখন একটি মিশ্র ভাষায় কথা বলেন। এই মিশ্র ভাষা বাংলা ভাষার এক রূপ। এই ভাষায় যেসব কার্য সমাধা হয়, যেসব আবেগ অনুভূতি প্রকাশের সু্যোগ থাকে, তথাকথিত প্রমিত ভাষায় তা সম্ভব নয়।
কারণ মানব সভ্যতার নিয়ম অনুযায়ী এখানে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার প্রচলন হবার কথা ছিল। কিন্তু হয় নাই কারণ আমরা কৃষিভিত্তিক সমাজে তথাকথিত উন্নতির একটা পর্যায়ে গিয়ে আছি জাতি রাষ্ট্রে।
কিন্তু যেহেতু প্রায় ৯৫ ভাগ সময় মানুষ বনে জঙ্গলে কাটিয়েছে, তাই তার ভেতরে সেই সময়ের প্রবণতা গুলি রয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। ভাষার ক্ষেত্রেও তাই হয়। কিছুদূর পর পর ভাষার উচ্চারণ, শব্দ ইত্যাদি পরিবর্তিত হতে থাকে।
এই যে মিশ্র ভাষা, বা বাংলা চলিত একটি রুপ, তা বিপুল সব জনমষ্টির পৃথিবীকে দেখার এক ইউনিক জানলা। সাহিত্যে যখন এর প্রয়োগ হয়, তখন সেই জানলা দিয়েই দেখার চেষ্টা করা হয়। এবং একে যখন ছেঁটে ফেলে তথাকথিত মান বা প্রমিত ভাষার জবরদস্তি চালানো হয় তখন আসলে এইসব লোকদের ভাষাকে বিলুপ্ত করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তাদের ভাব অনুভূতি ও চিন্তাকে খুন করার চেষ্টা করা হয়, তাদের মানসিক দাস বানানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়।
ভাষা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিষয়ক মোরাল প্যানিক
কেউ যখন মিশ্র বাংলা ভাষায় লেখেন বা ব্যাকরণের নিয়ম না মানেন, তখন মোরাল প্যানিক শুরু হয়ে যায়। ভাষা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সভ্যতা শেষ হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। মানুষ স্বাভাবিক ভাবে লস এভার্স প্রাণী। সে লস ভয় পায়। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয়, বেশীরভাগ মানুষই পরিবর্তনে অস্বস্থি অনুভব করে। পরিবর্তন মানেই তার কাছে বিশৃঙ্খলা। এইসব বিষয় ভাষা বিষয়ক নৈতিক আহাজারীতে প্রভাব ফেলে।
কগনিটিভ সাইন্টিস ও ভাষাবিদ স্টিভেন পিংকার তার সেন্স অব স্টাইল বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন লেখা শুরু হবার কাল থেকেই কিছু লোকের মধ্যে এমন নৈতিক আহাজারী ছিল। নিচের ছবিটি তার বই থেকে নেয়াঃ
ইংলিশ স্কলার রিচার্ড লয়েড জোনসের মতে, প্রাচীন সুমেরিয় সভ্যতার ট্যাবলেটেও দেখা গেছে লেখা তরুণেরা ভাষা অন্যভাবে লিখে ধ্বংস করে ফেলছে বলে অনেক আপত্তি আছে।
মানুষ যখন বুড়ো হতে থাকে, তখন তার ভেতরে আসা শারিরীক মানসিক পরিবর্তনগুলির সাথে মিলিয়ে সে অন্য পরিবর্তনগুলি দেখে, ও তার মনে হয় সব পরিবর্তনই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দিকে যাচ্ছে, তাদের মাথায় থাকে ফেলে আসা এক দারুণ দিনগুলির স্মৃতি। (এ আমার বানিয়ে বলা কথা নয়, গবেষকদের গবেষণার ভিত্তিতে পাওয়া জিনিস।)
তাই প্রতিটি জেনারেশন মনে করে তরুণেরা ভাষা ব্যাকরণের ব্যবহার জানে না, এই না জানা সভ্যতাকে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের পথে। স্টিভেন পিংকার ইংলিশ ভাষা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এমন কিছু আশংকা তুলে ধরেছেন সাল উল্লেখ করে।
The common language is disappearing. It is slowly being crushed to death under the weight of verbal conglomerate, a pseudospeech at once both pretentious and feeble, that is created daily by millions of blunders and inaccuracies in grammar, syntax, idiom, metaphor, logic, and common sense. . . . In the history of modern English there is no period in which such victory over thought-in-speech has been so widespread.—1978
Recent graduates, including those with university degrees, seem to have no mastery of the language at all. They cannot construct a simple declarative sentence, either orally or in writing. They cannot spell common, everyday words. Punctuation is apparently no longer taught. Grammar is a complete mystery to almost all recent graduates.—1961
From every college in the country goes up the cry, “Our freshmen can’t spell, can’t punctuate.” Every high school is in disrepair because its pupils are so ignorant of the merest rudiments.—1917
The vocabularies of the majority of high-school pupils are amazingly small. I always try to use simple English, and yet I have talked to classes when quite a minority of the pupils did not comprehend more than half of what I said.—1889
Unless the present progress of change [is] arrested . . . there can be no doubt that, in another century, the dialect of the Americans will become utterly unintelligible to an Englishman.—1833
Our language (I mean the English) is degenerating very fast. . . . I begin to fear that it will be impossible to check it.—1785
আচ্ছা, অনেককে আপনারা দেখে থাকবেন, বয়স কম কিন্তু সেও ভাষা বিষয়ক নৈতিক আহাজারীতে যুক্ত হয়েছে। জিজ্ঞেস করতে পারেন এর কারণ কী? এর কারণ সে ভাষা সম্পর্কে জানে না। সে বুড়োদের অনুসরণ করাই ভালো মনে করে এক্ষেত্রে, কারণ বুড়োরাই প্রতিষ্ঠান, তাদের দলে থাকা নিরাপদ। ফলে মূলত, বয়স কম হলেও এরা আসলে বুড়োই।