দ্য ট্রুমান শো – সত্য বাস্তবতা, মিথ্যা বাস্তবতা

দ্য ট্রুমান শো ১৯৯৮ সালে নির্মিত একটি ডার্ক কমেডি ফিল্ম। ছবিটির কাহিনী ট্রুমান বুরবাঙ্ক নামের একজন লোককে নিয়ে যাকে জন্ম থেকে কিনে নিয়েছে একটি বড় কর্পোরেট সংস্থা। সে নিজেই জানেনা তার পুরো জীবন একটা শো, তার চারপাশের বাস্তবতা একটি বড় টেলিভিশন সেট, তার আত্মীয় স্বজন-বন্ধু, স্ত্রী সবাই সেই শো এর একেকটা চরিত্র। ট্রুমানের প্রতিদিনের জীবন যাপন, তার আবেগ অনুভূতি, স্বপ্ন এবং ভয় – সবই সরাসরি সম্প্রচারিত হয় বিশ্বজুড়ে। লাখ লাখ দর্শকেরা জান্তব এই শো দেখে বিনোদিত হন, আবেগে আপ্লুত হন।

ট্রুমান শো

এই শো এর মূল পরিকল্পণাকারী ক্রিস্টফ নামের এক ভদ্রলোক। তার পরিকল্পণাতেই তৈরী ট্রুমান শো এবং সি হেভেন আইল্যান্ড, যেখানে ট্রুমানের জীবন যাপন।

পৃথিবীর সব আধুনিক মানুষের জীবনের সাথে ট্রুমান বুরবাঙ্কের জীবনের মিল আছে। ট্রুমান বুঝতে পারে না আসলে সত্যিকারভাবে কী হচ্ছে। সে তার চারপাশের বাস্তবতাকে সত্যি ভেবে জীবন যাপন করে। অবশ্য সে যাতে বুঝতে না পারে এজন্য সেই বড় কর্পোরেট সংস্থা থেকে নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়। তার চিন্তাভাবনাকে ম্যানিপুলেট করা হয় প্রতিনিয়ত।

যেটা আধুনিক দুনিয়ায় প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেও হয়। রাষ্ট্র অথবা বৃহৎ শক্তি এই কাজ করে থাকে। নানাভাবে মানুষের চিন্তা চেতনাকে প্রভাবিত করে তাকে নিপুনভাবে ব্যবহার করা হয়। সত্যিকারভাবে কী হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীর সাধারণ মানুষেরা তা জানে না, এই কথার সমর্থন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বুদ্ধিজীবিদের একজন নোম চমস্কির কথায় পাওয়া যায়।

চমস্কি

সাধারণত একজন মানুষের তিনটি জীবন থাকে। পাবলিক লাইফ, প্রাইভেট লাইফ এবং সিক্রেট লাইফ। ট্রুমান শো’তে ট্রুমান বুরবাঙ্কের এই তিন জীবনই সরাসরি সম্প্রচারিত হয় টেলিভিশনে। এজন্য লাখ লাখ লোক তা আগ্রহ নিয়ে দেখে। কারণ অন্য মানুষের এই তিন জীবনের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ আছে।

ট্রুমানের প্রাইভেট লাইফ এবং সিক্রেট লাইফ প্রকাশ করার যে অনৈতিক কাজ, সেটা কর্পোরেট সংস্থা ভালোভাবেই সম্পন্ন করে।

একই ব্যাপার ঘটছে আধুনিক পৃথিবীতে। একটু ভিন্নভাবে। ফেসবুক তথা নানাবিদ সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের নানা তথ্য চলে যাচ্ছে বড় কর্পোরেট সংস্থাদের কাছে। ফেসবুক, গুগল, টুইটার এরা তথ্য দিচ্ছে এক্সিকম, এনএসএকে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আছে জন বেলামি ফস্টার এবং রবার্ট ম্যাকেনজির নজরদারির পুঁজিবাদ প্রবন্ধে। আগ্রহীরা দেখতে পারেন।

ট্র্যাপওয়ার ইত্যাদি নজরদারীর সফটওয়ারের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ এবং এইসব তথ্য কীভাবে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তা নিয়ে ডকুমেন্টারী ফিল্ম হ্যাকারস ওয়ারস দেখা যেতে পারে। এই ডকুমেন্টারীতে হয়ত বেশী বেশী দেখিয়েছে হ্যাকটিভিস্টদের হিরোইজম তথাপি নজরদারী বুঝার জন্য এর গুরুত্ব আছে।

যাইহোক, বুরবাঙ্ক ট্রুমানে ফিরে আসা যাক। তার তথ্যাবলী যেভাবে সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ে তেমনি আধুনিক দুনিয়ায় মানুষদের তথ্য চলে যাচ্ছে বড় কর্পোরেট সংস্থাদের কাছে।

বিভিন্নভাবে মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করা হয় তার তথ্য প্রকাশ করতে। যেমন, ফেসবুকের একটা সাধারণ ব্যাপার ছবি আপলোড বা স্ট্যাটাস পোস্ট। সেখানে অপশন আছে তিনটা। পাবলিক, কাস্টম, অনলি মি। ফেসবুক তার ইউজারদের বলছে, “পাবলিক করে দেন তাহলে বেশী লোক দেখতে পারবে। পাবলিক দিতে চান না? তাহলে কাস্টম করে দিন। কিছু বন্ধুদের অন্তত দেখান। তাও দিবেন না? তাহলে অনলি মি করে রেখে দিন না? কেউ দেখতে পাবে না। আপনার জন্যই থাকল।”

অর্থাৎ পোস্ট করার চিন্তা মাথায় চলে আসলে তা যেকোনভাবে যেন কার্যকর হয় সে ব্যাপারে ফেসবুক অতি যত্নশীল।

এটি একটি বিষয়। এছাড়া আরো নানাভাবে তারা ব্যবহারকারীদের তথ্য প্রদানে উদ্ভুদ্ধ করে থাকে প্রতিনিয়ত।

গুগলে সার্চ দিলে গুগল যে এডগুলো দেখায় বা বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গুগলের যে এডগুলো থাকে সেগুলোও ব্যবহারকারীর সার্চ আগ্রহের উপর ভিত্তি করে এখন দেখানো হয়। যেমন, কেউ “ফিলোসফিক টি শার্ট” লিখে সার্চ দিল। তার এই তথ্য রেখে পরবর্তীতে বিজ্ঞাপনে ফিলোসফিক টি শার্টের বিজ্ঞাপন দেখানো হবে। একই ব্যাপার ফেসবুক সাইডবার এডের ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে।

সামনে হয়ত এমন হবে যে কেউ যা ভাবছে তা ধরে নিয়ে সে অনুযায়ী বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হবে। হলে সেটা কর্পোরেট জগতের জন্য বৈপ্লবিক হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

ট্রুমান শো এর শুরুর দিকে ট্রুমান বুরবাঙ্ক তার প্রিয় বন্ধুর সাথে গল্প করে সে একদিন ফিজি দ্বীপপুঞ্জে চলে যাবে। তার মধ্যে এক ধরনের অভিযাত্রীসুলভ চিন্তা দেখা যায়। বুঝতে পারা যায় সে তার প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবন যাপনের বাইরে বড় কিছুর স্বপ্ন দেখে।

কিন্তু পুরো ফিল্মে দেখা যায় ট্রুমানের এই প্রবণতাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে টেলিভিশন নেটওয়ার্ক। কারণ এই প্রবণতা ট্রুমানকে সত্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে তাদের ভয় ছিল। ট্রুমানের মধ্যে এই প্রবণতার উৎপত্তি হল কীভাবে, যেখানে তার সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে? এর উত্তরে প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিক সক্রেটিসকে স্মরণ করতে হবে। তার মত ছিল আইডিয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, তার ভেতরেই থাকে। প্লেটোও এই মতের ছিলেন।

এটা একটা আশাব্যঞ্জক চিন্তা, যা বুঝায় মানুষকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সে তার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে যেকোন সময় নিয়ন্ত্রন ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারে।

ট্রুমানের জীবন যাপনে যেসব বিভিন্ন পণ্য সে ব্যবহার করে, এগুলো বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন। এভাবেই মূলত কোম্পানিগুলো ট্রুমান শো’তে বিজ্ঞাপন দেয়। এখানে একজন লোকের জীবনকে ব্যবহার করে তারা তাদের পন্যের প্রচার চালাচ্ছে। কর্পোরেট পুঁজিবাদের যুগে এমন অনেক চিত্র অবশ্যই পাওয়া যাবে যেখানে মানুষকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে পণ্যের বিজ্ঞাপণের জন্য। যেখানে মানুষের দুঃখ সুখের চাইতে প্রচারণাটাই মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে কর্পোরেট দানের সংস্কৃতি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হতে পারে। যেখানে মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে পণ্যের, প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির বিজ্ঞাপণ করা হয়।

যে বাস্তবতা আমাদের সামনে আছে আমরা সেটাই গ্রহণ করি। ট্রুমান বুরবাঙ্কও সেটা গ্রহণ করেছিল। আমাদের বাস্তবতা সত্য না মিথ্যা তা নিয়েও ভিন্ন চিন্তা রয়েছে। এ ব্যাপারে এক্সিজটেনজ ফিল্মের আলোচনায় সিমুলেশন হাইপোথসিস দিয়ে ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।

হঠাৎ করে আমরা যদি বুঝতে পারি আমাদের জীবন যাপন তথা বাস্তবতা মিথ্যা তখন আমাদের প্রতিক্রিয়া কী রকম হবে? এটা বুঝতে প্লেটোর এলিগরি কেভের কথা বলা যেতে পারে। তার মতে আমরা অর্থাৎ মানুষেরা একটা গুহায় বন্দি কিছু লোকের মত। যাদের হাত পা বাঁধা, মাথা ঘুরানোর উপায় নেই। পিছনে আছে আগুন, আগুনের সামনে কিছু লোক পুতুল ধরে রেখেছে বা পুতুল নাড়াচ্ছে। আমরা আমাদের সামনের দেয়ালে সেই পুতুলদের ছায়া দেখে নানা কিছু ভাবছি।

platoscave

সত্যিকার বাস্তুবতা সম্পর্কে বন্দিদের কোন ধারণা নেই।

এদের মধ্যে একজন বন্দি যদি মুক্ত হয় এবং তাকে পেছনে তাকিয়ে সত্য দেখতে বাধ্য করা হয় তাহলে তার চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। সে অন্য বন্দিদের তার দেখা সত্য সম্পর্কে বললে অন্যরা গ্রহণ করবে না। তীব্রভাবে প্রতিবাদ করবে কারণ সেই সত্য তাদের বহুদিনের বিশ্বাসে আঘাত হানে। তাদের এই প্রতিবাদের একটি রূপক দৃশ্য আছে দে লীভ ফিল্মে। দে লীভ ফিল্মের নায়ক জন নাডা। সে কিছু সানগ্লাস খুঁজে পায়। যা দিয়ে যেকোন জিনিসের পিছনের সত্যিকার মেসেজ দেখা যায়।

সে তখন সানগ্লাসের মাধ্যমে দেখতে পারে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে এলিয়েনরা।

একটি দৃশ্যে জন নাডা তার বন্ধুকে এই সানগ্লাস পরাতে যায়। কিন্তু তার বন্ধু তীব্রভাবে বাঁধা দেয়। তাদের মধ্যে একটি মারাত্মক সংঘর্ষ হয়ে যায়।

অর্থাৎ সানগ্লাস পরে সত্যটা দেখতে সহজে রাজী হয় নি তার বন্ধু। সত্যের মুখোমুখি হতে গেলে এটি মানুষের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া।

নীচা (নীৎসে) এ কারনে হয়ত বলেছেন, “মাঝে মাঝে মানুষ সত্যটা জানতে চায় না কারণ তারা চায় না তাদের বিভ্রান্তির বিনাশ হোক।”

সাধারণের জন্য সত্য অস্বস্থিকর, বিব্রতকর এবং কঠিন। সফোক্লিসের ইদিপাসে আছে,

“How dreadful knowledge of the truth can be
When there’s no help in truth!”

এটা বলা হয়েছে যখন ইদিপাস সত্যটা জানতে পারল। তাকে বার বার নিষেধ করা হয়েছিল যে তুমি সেটা জানতে যেও না। কারণ সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু ইদিপাসের দারুণ কৌতুহল ছিল। সে সত্য জানতে যায় এবং জানতে পারে তার বাবাকে সে খুন করেছে আর জোকাস্ত্রা তার মা।

সে দুঃখে জর্জরীত হয়ে পড়ে। নিজের চোখ অন্ধ করে ফেলে। জোকাস্ত্রা আত্মহত্যা করেন। এবং এক মর্মান্তিক পরিণতি বরন করতে হয় তাদের।

ট্রুমান শো’তেও এই কঠিন সত্যের উল্লেখ করে সাবধান বানী আছে। বুরবাঙ্ক ট্রুমান এক সময় বুঝতে পারে তার চারপাশের বাস্তবতা মিথ্যা। তখন সে পালাতে চেষ্টা করে। বহু চেষ্টার পর সে সী হেভেন আইল্যান্ডের শেষ দরজায় গিয়ে উপস্থিত হয়। অর্থাৎ সে ইচ্ছে করলে বাইরের বাস্তবতায় যেতে পারে। তখন শো এর নির্মাতা ক্রিস্টফের সাথে তার কথোপকথন হয়। ক্রিস্টফ ট্রুমানকে বলে,

“আমি তোমার জন্য যে পৃথিবী তৈরী করেছি তার চেয়ে বেশী সত্য বাইরে নেই। একই মিথ্যা, একই প্রতারনা ওখানেও। কিন্তু আমার পৃথিবীতে তোমার ভয়ের কিছু নেই।”

কিন্তু ট্রুমান বুরবাঙ্ক ক্রিস্টফের এই কথায় তার জন্য নিরাপদ কিন্তু মিথ্যা বাস্তবতায় ফিরে যায় না। সে দরজার অন্য পাশে চলে যায়। যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে অন্য বাস্তবতা।

ট্রুমানের এই যাওয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের জয়গান। অনিরাপদ জেনেও আরামদায়ক অবস্থান ছেড়ে সত্যের মুখোমুখি হওয়া। যেভাবে ভয়াবহ জেনেও ইদিপাস জানতে চেয়েছিল সত্য। সত্যের প্রতি মানুষের যে জন্মগত আকাঙ্খা তারই বহিঃপ্রকাশ ট্রুমানের সী হেভেন থেকে গমন।

ট্রুমান শো একটি আশাবাদী ফিল্ম। বুরবাঙ্ক ট্রুমান যখন জানতে পারল তার চারপাশ মিথ্যা তখন সে হতাশ হয়ে পড়ে নি বা একেবারে ভেঙে পড়ে নি। তার মধ্যে কাজ করে নি ফ্রয়েডিয় কিংবা অস্তিত্ববাদী হতাশা। মারিও বাভার জাল্লো, দ্য গার্ল হু নিউ টু মাচ এর অনুকরণে সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে বলা যায় দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ। তিনি তার একটি স্বাক্ষাতকারে তার অমরত্বের আকাঙ্খা আছে কী না প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন –

“সত্যি বলতে না। মানুষের যাবতীয় আচরণের পেছনের স্বার্থপর উদ্দেশ্যগুলো যখন একজন জেনে ফেলে , তখন তার এসবের ভেতর আর ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় না।”

মানুষের মনের খবর, ধরা যাক সত্য বা সত্যের কাছাকাছি কিছু জেনে ফ্রয়েডের এই প্রতিক্রিয়া। স্বভাবতই হতাশাবাদী। ট্রুমান বুরবাঙ্কের সত্য জানার পর এমন প্রতিক্রিয়া হয় না, সে আশাবাদী হয়ে পালানোর চেষ্টা করে মিথ্যার বেড়াজাল থেকে। এই পালানো সী হেভেন তথা কর্পোরেট সেই টেলিভিশন নেটওয়ার্কের প্রতি তার আশাবাদী বিদ্রোহ।

আশা করা যাক, যে বাস্তবতায় সে গমন করেছে তার মিথ্যাত্ব তাকে হতাশ করবে না।