মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » ধুলোর মত মূল্য নিয়ে বেঁচেও তুমি বাঁচবে না

ধুলোর মত মূল্য নিয়ে বেঁচেও তুমি বাঁচবে না

আজকের প্রশ্নোত্তরে একটা প্রশ্ন ছিল,

জীবনে একটা বড় গোলের পরিবর্তে ছোট ছোট গোল থাকার ব্যাপারটা কীভাবে দেখেন? উদ্দেশ্যহীনতা কী আসলে আত্মিক-মানসিক প্রশান্তি দেয় নাকি ইন দ্য এন্ড ক্ষতিই করে?

—-

ছোট ছোট গোল থাকাই বেটার, কারণ তখন এইগুলা এচিভের মাধ্যমে মোটিভেশন ধরে রাখা সম্ভব হয়। দেখবেন কিছু লোক এমনিতে অলস, কিন্তু সারাদিন গেইম খেলে। এই গেইমগুলা সহজ না, কঠিন। অনেক মনোযোগ দিতে হয়, খেলার স্কিল অর্জন করতে হয় খেলতে খেলতে। এই কাজে তারা মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। কারণ গেইম ছোট ছোট লেভেল দিয়ে ডিজাইন করা হয়, এক ধাপ পার হইলেই পুরস্কার আসে।

গেইম যারা ডিজাইন করে এরা মানব সাইকোলজি সবচাইতে ভালো বুঝে। ছোট ছোট লক্ষ্য রেখে সেট করা গেইমের মত ডিজাইন করা হয় লাইফের লক্ষ্যরে।

উদ্দেশ্যহীনতা দিন শেষে ক্ষতি করে। মানুষের হতাশার বেশিরভাগ কারণ কোন উদ্দেশ্য না থাকা, উদ্দেশ্য না থাকলে মিনিংও থাকে না। শুরুতে মনে হয় আরাম আর আরাম, কিন্তু কিছুদিন পরে অস্তিত্বরেই অর্থহীন মনে হবে, গুরুত্বহীন মনে হবে। এইজন্য পশ্চিমে অনেক লোক রিটায়ার করার পর হতাশায় ভুগেন। কারণ হঠাত করেই তিনি উঠেন গুরুত্বহীন, যেন তার সব প্রয়োজন ফুরাইছে।

আমি স্কুলে পড়া শেখার পরেই বড় ক্লাসের কিছু বই পড়ছিলাম। বইগুলা ছিল আমার মামার। ঐ বাংলা বইয়ের অনেক কিছুই মনে আছে। যেমন, রানারের ছবি, যেই রানারের স্মৃতির প্রতি সম্মানার্থে আমার কিছু গল্পে তার আগমন হয়। এটা সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার রানার। আরেকটা গল্প আছিল, এক ছেলে এক দোকানে কাজ করে, মালিক তার সাথে খারাপ আচরণ করে। সে ভয়ে কিছু বলতে পারে না। একদিন ঝড়ের সময় মালিক তারে পান আনতে পাঠায়। সে ঝড়ের মধ্যে যায় পান আনতে। বইয়ে এই ছবি ছিল। ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করতে করতে তার ভেতরে সাহস চলে আসে। সে পরে মালিকের কাজ ছেড়ে দেয় বা প্রতিবাদ করে। তার সাহস দেখে মালিক অবাক হয়ে যায়, বুঝতে পারে না কীভাবে সে চেইঞ্জ হইল। একই কথা জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির লেখাতে আছে, তিনি লেখেন এইরকম, যে ব্যক্তি ঝড়ের মধ্যে প্রবেশ করে আর যে বেড় হইয়া আসে দুইজন এক না। ভাবার্থে এইরকমই একটা কথা। দুইটার মূলকথা একই, এডভার্সিটি মানুষরে শক্ত করে, যেইটারে এন্টি দার্শনিক ফ্রেডরিক নীতশে বলেন সহজে, যেইটা তোমারে মারতে পারে না এইটা তোমারে স্ট্রংগার বানায়।

ঐ বাংলা বইয়ে এক কবিতা পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গেছিল কিছুটা, এখনো মনে আছে, লাইন ছিল এমন,

শুকনো পাতার মতন থেকে
ধুলোর মত মূল্য নিয়ে
বেঁচেও তুমি বাঁচবে না।
­
তোমার জীবন তোমার হাতে,
ব্যস্ত হবে দিনে রাতে,
সকল সময় শুধুই চলা-
তা না হলে বাঁচবে না।

এটা এখনো নিজেরে বলি অসচেতনে, এর রিদমটা ভালো লাগে।

মিনিং এর দিক থেকেও কবিতাটা সুন্দর। আমাদের সময়ে এটা আর পাঠ্যপুস্তকে ছিল না, বাদ দিয়া দিছে। রানারও ছিল না। রানার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুন্দর গাইছেন। ওই ঝড়ের গল্পটাও ছিল না।

আজ সার্চ দিয়া পাইলাম, এটা সৈয়দ আলী আহসানের কবিতা। তার আত্মজীবনী পড়ছিলাম কয়েক বছর আগে। জীবনের শিলান্যাস নাম। বইতে সফেদ দাড়িসহ এই জাতীয় অধ্যাপক, কবি ও সমালোচকের ছবি ছিল। অবশ্যই বৃদ্ধ বয়েসের ছবি, কিন্তু আত্মজীবনী তো শুরু হইছে ইয়াং কাল থেকে। বইয়ের শুরুর দিকে একটা অদ্ভুত কাহিনী তিনি লেখছেন, মনে হয় না এইরকম কোন কাহিনী এইভাবে শুরুতেই কোন আত্মজীবনীতে আর পাইছি। তিনি তার বন্ধুর বাসায় কয়মাস ছিল মেট্রিক পরীক্ষা দেবার পরে। বন্ধুর বাবা বড় সরকারী কর্মকর্তা, আর ছিলেন ভদ্রলোকের তৃতীয় স্ত্রী, বন্ধুর সৎ মা, তাদের প্রকাণ্ড বাড়ি। সৎ মা অনেক দাসী চারপাশে নিয়া থাকতেন সর্বদা।

দুপুরে সব নির্জন হইয়া যাইত। কিন্তু শোনা যাইত নূপুরের শব্দ। একদিন ইয়াং আলী আহসান, ও তার বন্ধু দেখতে গেলেন কাহিনী কী, তারা লুকাইয়া সন্তর্পণে নূপুরের শব্দ লক্ষ্য করে গেলেন, যাইতে যাইতে হাসি ও হাততালির শব্দও পাইলেন। তারা যে ঘর থেকে শব্দটা আসছিল তার জানালার পর্দা অল্প সরাইলেন।

ভেতরে অন্ধকারের মত ছিল তাই প্রথমে কিছু দেখা গেল না।

পরে দেখলেন, তার বন্ধুর মা বিছানায় বসে আছেন। তার সামনে তার কাজের মহিলা নগ্ন হয়ে কোমর দোলাচ্ছেন। আলী আহসান সুন্দর করে লেখছেন, তার কলসির মত পেছন দিকটা শুধু দুলছে, একবার ডানে একবার বায়ে। বলাবাহুল্য, এই দোলার সাথে সাথে নূপুরের শব্দ হচ্ছিল। আর বন্ধুর সৎ মা হাসিমুখে কিছুক্ষণ পরপর হাততালি দিচ্ছিলেন।

এই গল্পে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। যেমন, তখন অন্য দাসীরা তখন কোথায় ছিল।

আলী আহসান লেখছেন, তিনি আর তার বন্ধু ঐদিন অনেকক্ষণ দেখেন। নূপুরের শব্দ বন্ধ হইলে তারা ঘরে ফিরেন। ওইদিন ঘরে ফিরে তার বন্ধু বলে, কী মজা!

এবং এর পরে তার কাব্যিকতা দিয়ে দ্রুতই বিষয়টা শেষ করে দেন আলী আহসান। তিনি লেখেন, ওই ঘটনা তাকে কৈশোরের নিষ্পাপ দশা থেকে যৌবনের উন্মাদনায় পৌঁছে দিল।

আমার প্রশ্ন হলো, তারা কি পরের দিনগুলাতে নূপুরের শব্দ শুনে আর যান নাই? সেই গল্পগুলা কী।

অবশ্যই লেখকের তার আত্মজীবনীতে অনেক গল্প বাদ দিয়া লেখতে পারেন, তারে সকল সত্য বলে যাইতে হবে এমন কোন নিয়ম নাই। তাই আমার প্রশ্ন লেখকের সমালোচনায় না, বরং ওইখানে কিছু গল্প থাকতে পারে সেই সম্ভাবনায় দৃকপাত। আমার ইচ্ছা হইছিল একবার, এই বিষয়টা কোন গল্পে আনার।

বইটা ইন্টারেস্টিং। শুধু এই গল্পের এই কারণে না, আরো অনেক রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্যিক বিষয় আছে তার লেখায়।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং