ন্যারেটিভ ফ্যালাসিঃ সাফল্যের গল্প থেকে সাবধান

নাসিম তালেব

যখন আমরা কোন আত্মজীবনী বা কারো সম্পর্কে কোন লেখা পড়ি তখন ফ্যাক্টগুলা নিয়া একটা গল্প বানাইয়া ফেলি। গল্পের প্রতি মানুষের আকর্ষন আদিকালের, এর মাধ্যমেই সে ভ্রান্ত ধারনায় পৌছায় যে সে কোন ঘটনা বুঝতে পারছে।

রাইতে বট গাছের তলায় তারাভরা আসমানের নিচে বইসা এক বৃদ্ধ গল্প বইলা মুগ্ধ করতেন জনতারে। এরপর নানাভাবে গল্প বলার ধরণ পাল্টাইছে। লেখার যে বর্ননা থাকে সেটার সূত্রগুলা নিয়া আমরা গল্প বানাই। যেই সূত্রগুলা থাকে সেগুলা নিয়া আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। এবং প্যারাডক্স হইল, যখন আমাদের কাছে কোন ঘটনা নিয়া কম ফ্যাক্ট থাকে তখন গল্প বানানি আমাদের পক্ষে সহজ হইয়া উঠে।

এই যে অতীতের ঘটনারে গল্প বানাইয়া বুঝার ভ্রান্তি, তার মাধ্যমে দুনিয়া এবং ভবিষ্যতরে বুঝার চেষ্টা একে দার্শনিক নাসিম তালেব নাম দিয়েছেন ন্যারেটিভ ফ্যালাসি। বর্ননাগত বিভ্রান্তি। দুনিয়ার ঘটনারে বুঝার তীব্র আকাঙ্খা থেকেই এর উৎপত্তি। এর মাধ্যমে সাহস, অধ্যাবসায়, পরিশ্রম, প্রতিভা, বোকামি ইত্যাদি নির্দিষ্ট কিছু বিষয়রেই আমরা কোন ফলাফলের কারণ হিশাবে ধইরা নিয়া বইসা থাকি এবং ভাগ্যরে কম গুরুত্ব দেই বা দেইই না।

ঐ বিশেষ ফলাফলের বাইরে আরো যে নানাকিছু ঘটার সম্ভাবনা ছিল তা আমাদের বুঝে আসে না। এইভাবে আমরা নিজেদের বোকা বানাই এবং আমাদের ভবিষ্যত নিয়া ভুল ধারনায় বইসা থাকি।

নাসিম তালেব
ছবিঃ নাসিম তালেব

 

পত্র পত্রিকায় দেখা যায় কোন লোক গরিব ছিল। কিন্তু নিজের চেষ্টায় পরিশ্রম কইরা, অন্যদের সাহায্য ছাড়াই সে বিরাট অর্থনৈতিক উন্নয়ন করে ফেলেছে। তার কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় বিশ্বাস এবং অসাধারণ গুণপনার জন্য সে আজ ধনী লোক।

অথবা স্টিভ জবস বা মার্ক জুকারবার্গ বা এলন মাস্কের কাহিনী যদি পড়েন তাইলে দেখবেন বই, পত্র পত্রিকায় তাদের সুপারম্যান হিশাবে উপস্থাপন করা হয়।

ইউনিভার্সিটি থেকে বাইর হইয়া দুইটা ছেলে গ্যারেজে বইয়া বানাইল গুগল কোম্পানি। কয়বছরের মধ্যে সেই কোম্পানি আমেরিকান স্টকে গিয়া উঠল, আর আল্লার কী লীলা! স্টকে তারা আমেরিকান অন্যতম সেরা দামী কোম্পানি হইয়া দাঁড়াইল।

লোকদের অনুপ্রেরণা দিতে এমন গল্প বলা হয়। এই ধরনের গল্প যারা লেখেন তারা এই ভাইবা আনন্দে থাকেন যে কী গুগলরে সাকসেসফুল করছে তা তারা বুঝেন। তারা পাঠকদেরও সেইমত পরামর্শ দেন। পাঠকেরাও পড়তে পড়তে নিজেরা গল্প বানাইয়া গুগলের সাকসেস বুঝেন। এবং অনুপ্রেরনা নেন। বাট বুলশিট হইল, এরা কেউই গুগলের মত সাকসেসফুল হইতে পারেন না। একইভাবে কাজ কইরা গেলেও না। কারণ সাকসেসের গুরুত্বপূর্ন ফ্যাক্টর লাক মহাশয়, ক্যামনে আসেন যান, স্বয়ং মহাত্মা লালনও বুঝতে পারতেন না।

নোবেল বিজয়ী সাইকোলজিস্ট ড্যানিয়েল কাহনেম্যান থিংকিং ফাস্ট এন্ড স্লো’তে বলেন, “কোন ব্যাখ্যার আসল পরীক্ষা হইল সে ব্যাখ্যা ভবিষ্যতে যা হইছে তারে পূর্বে প্রেডিক্ট করতে পারে কি না। গুগলের বিরাট সাকসেসের পিছনে যত গল্প আছে এর একটাও এই পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয় না।”

ড্যানিয়েল কাহনেম্যান
ছবিঃ ড্যানিয়েল কাহনেম্যান

যেমন গুগলের গল্পে আছে তারা এক মিলিয়নের কম দামে বিক্রি করতে চাইছিল কোম্পানি। কিন্তু ইয়াহু নেয় নাই। কিন্তু তখন কি বুজুর্গরা বা কেউ ভাবতে পারছিলেন গুগল এত বড় সাকসেস পাইবে? বা ইয়াহুর এই না কিনাই কি তারে এত বড় সাকসেস আইনা দিছে?

গুগলের গল্পে অবশ্যই তার কর্তাদের স্কিল এর ভূমিকা আছে, কিন্তু যেইভাবে লাক বা ভাগ্যের ভূমিকারে তাদের সাকসেসের গল্পে নাই করে দেয়া হয় বিষয়টা এমন না। ভাগ্যের ভূমিকা আরো বেশী ছিল। আর যেইখানে ভাগ্যের ভূমিকা আছে সেইখান থেকে শেখার সুযোগ অল্প।

বিরাট সাকসেসের পিছনে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় অবস্থান গুরুত্বপূর্ন। এর জন্য ভাইটাল ফ্যাক্টর হইলেন লাক।

বিরাট সাকসেসের পিছনে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় অবস্থান গুরুত্বপূর্ন। এর জন্য ভাইটাল ফ্যাক্টর হইলেন লাক। Share on X

ভ্রান্তভাবে সাকসেসরে বুঝা আমাদের নানাবিদ বড় ক্ষতির মুখামুখি করে। যেমন, জুয়া খেলায় একটা কথা আছে বিগেনারস লাক। মানে পয়লা দানে আপনি লাভ করবেন। এইটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়। কিন্তু ঐ বিগেনার প্রথমে ভাগ্যের সহায়তায় জিইতা পরে আবার খেলে, আবার খেলে, এইভাবে সে হারতে হারতে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

চার্লি মাঙ্গারের একটা কথা আছে, ভাইবেন না অতীতের মত হবে ফিউচার।

মিস্টার তারেক তার বন্ধু মিস্টার আব্দুল মজিদের লগে পার্টনারশীপে গিয়া একটা টায়ারের ব্যবশা করলেন। এতে তার লাভ হইল।

পরের বছর মিস্টার তারেক ভাবলেন বন্ধুরে লইয়া বড় পুঁজিতে ছাগলের ব্যবসা করবেন। শুরু করলেন। এতে মিস্টার তারেকের লস হইল, বন্ধুর লগে ফাইট হইল। এইভাবে অনেক বিজনেসম্যান লসের দেখা পান, বড় লস।

কারো সাথে একটা জিনিস ক্লিক করার অর্থ এই না যে প্রতিটা জিনিস ক্লিক করবে তার সাথে।

টায়ারের ব্যবসা সফল হওয়ার পিছনে অন্যকিছুর সাথে ভাগ্য, সেই সময়ের অবস্থা ইত্যাদির ভূমিকা ছিল। এইগুলা আমলে নিয়া যদি মিস্টার তারেক তার সাফল্যের কারণ অনুসন্ধান করতে বইতেন তাহলে প্রকৃত চিত্র পাইতেন তার টায়ারের ব্যবশার সাকসেসের। তখন তিনি তার পরের ব্যবশার সিদ্ধান্ত আরো ভাইবা নিতেন, যেইসব ল্যাকিংস আছে তার সেইগুলাও কাটাইয়া উঠতে পারতেন।

কোন বড় ঘটনা ঘটার পরে অনেকে বলে আমি জানতাম এইরকম ঘটবে। এইটা আরেক বুলশিট। কোন কিছু জানার অর্থ হইল তা একই সাথে আমরা জানি এইটা সত্য এবং দেখাইতে পারি তা সত্য। একইসাথে ট্রু এবং নোএবল। কিন্তু ভবিষ্যতে কোন ঘটনা ঘটবে এইটা আমরা ভাবলেও তা দেখাইতে পারব না, কারন তা তো ঘটে নাই। ফলে এইটা “জানা” হয় না।

ড্যানিয়েল কাহনেম্যান বলেন, মূল বিভ্রান্তিটা হল আমরা বিশ্বাস করি আমরা অতীতকে বুঝি যা এই ধারণা তৈয়ার করে যে ভবিষ্যত হবে জানার যোগ্য কিন্তু আসলে অতীত আমরা যতটুকু বুঝি বলে বিশ্বাস করি তার চেয়ে কম বুঝি।

 

 


এই লেখা মানসিক নকশার অন্তর্ভূক্ত।