বাংলার লোকজনের ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক সাইকোলজি

প্রাচীন বাংলা বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত ছিল। তাদের একক কোন রাজনৈতিক স্বত্বা ছিল না। ৫০০ থেকে ১১৫০ সাল পর্যন্ত একেকটা রাজবংশ মাত্র ৮০ বছরে টিকেছে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী এলাকায় বড় বড় সাম্রাজ্য তৈরি হইছে। যেমন আসামে ওহম শাসকেরা ছয়শ বছরের শক্তিশালী সাম্রাজ্য তৈরি করে। বিহারে পাল নন্দ গুপ্ত মৌর্য সাম্রাজ্য হইছে। দক্ষিণ ভারতে পল্লব ও সাম্রাজ্য। কিন্তু প্রাচীন বাংলায় এরকম কিছু হয় নাই। বাংলা ছিল বিচ্ছিন্ন, স্ববিরোধী, এবং ক্ষুদ্র রাজ্যগুলার ফাইটিং এর মধ্যে।

বাংলাদেশের গ্রামগুলা সংঘবদ্ধ গ্রাম ছিল না, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য গ্রামদের মত। সংঘবদ্ধ গ্রাম বলতে যেসব গ্রামে এক ধরণের প্রশাসনিক কাঠামো আছে, গ্রাম সরকার ইত্যাদি। এক ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্র। এইরকম গ্রাম হইত যখন মানুষের সংঘবদ্ধ থাকাটা জরুরি ছিল অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। যেমন বন্য প্রাণীর আক্রমণ, বহিঃশত্রুর আক্রমণ, পানির অপর্যাপ্ততা, উর্বর জমির অপর্যাপ্ততা। বাংলায় এই সমস্যাগুলার কোনটাই তীব্র ভাবে ছিল না। ফলে সংঘবদ্ধ বা কর্পোরেট গ্রাম এখানে তৈরি হয় নাই, হইছে উন্মুক্ত ও বিচ্ছিন্ন গ্রাম, যেগুলা ছাড়াছাড়া ভাবে এক সামাজিক সত্ত্বা কেবল, কোন রাজনৈতিক সত্ত্বা নয়।

ফলে এইখানকার মানুষ সহযোগিতায় কম বিশ্বাসী। ব্যক্তি স্বার্থ বেশী প্রাধান্য দেয়। উত্তর ভারতে কোন ব্যক্তির জন্য একঘরে করা বা পাঁচের বাদ এর অর্থ ছিল মৃত্যু, কারণ সে যাবে কই, পানি পাওয়া সহজ না। অন্যদিকে বাংলার গ্রামে একঘরে করা, বা সমাজচ্যুত করার শাস্তি ছিল কেবলই সামাজিক, লাইফ থ্রেটেনিং না। সে অন্য জায়গায় গিয়া জমি খুইড়া পুকুর বানাইয়া, সেই মাঠি দিয়া আয়াসেই ভিটা তুলতে পারত। অসহযোগিতার শাস্তি এইখানে মারাত্মক কিছু ছিল না। এই কারণে মানুষেরা হইছে স্বাধীনচেতা, নানা ধরনের ধর্মমতের আখড়া হইছিল এই অঞ্চল, কোন কট্টরপন্থা মানে নাই। আকবর আলি খান সবিস্তারে এইগুলা আলোচনা করে গেছেন।

কোন সংঘবদ্ধ সামাজিক স্ট্র্যাকচার না থাকায় একক রাজ্য হয় নাই, এবং কোন সাম্রাজ্যও আগ্রহ নিয়া দখল করতে চায় নাই, কারণ দখল করা টাফ, আর করলেও ট্যাক্স কালেকশনে অসুবিধা। স্থায়ীভাবে তৃণমূল শক্তিশালী সংঘটন আগে থেকেই বিরাজমান থাকলে একটা ট্যাক্স কালেকশনের পদ্বতি অলওয়েজই বিরাজমান থাকে, যেটা সাম্রাজ্যের রাজা ব্যবহার করতে পারেন।

ইতিহাস থেকে আমাদের মুক্ত হওয়া কঠিন, যদি আমরা ওইটারে বুঝার চেষ্টা না করি, এবং পারস্পারিক অসহযোগিতার ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেই।

১৯৭১ সালে যত মানুষ মারা গেছে, যত ক্ষতি হইছে, এতো রক্তের বিনিময়ে আধুনিক কালে কোন বড় জনসংখ্যার দেশের জন্ম হয় নাই। কিন্তু তিন বছরও মধ্যে আমাদের লোকজন ঐক্য টিকাইয়া রাখতে পারেন নাই।

ঘটনার পরিক্রমায় আজ শেখ মুজিব ভিলেন, কিন্তু উনিই আছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরির বড় লিডার। আয়রনিক্যালি আজ দেখলাম কিছু ছাত্ররা নাহিদ ইসলামের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতেছে, আমার ভাই রক্ত দিছে নাহিদ দেয় নাই। একই লজিক, যেই লজিকে বলা হয় মুজিব রক্ত দেন নাই, যুদ্ধ করেন নাই। লিডার যদি রক্ত দিয়া দেয় আর মইরা যায়, তাইলে জিতবি কেমনে, এইটা বুঝে না। সময় লিডার বানায়, মানুষ লিডার বানায়, ওই ব্যক্তির গুণাবলি থাকে অবশ্যই, এবং বলা যায় সময়ের প্রয়োজনেই তিনি সময়ের সন্তান হিশেবে সবার আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হন। তারে কেন্দ্র কইরাই আগাইতে হয়।

তিন মাস পরে তুমি কোশ্চেন করতে শুরু করলা, আর্মিরে ডাকতে লাগলা, তিন বছর পরে তো ফ্যামিলিশুদ্ধা মাইরা ফেলবা। একই জিনিশের মঞ্চায়ন হবে, যেইটা হয়ত হাজার বছর ধরে হইয়া আসছে এই বঙ্গভূমিতে।

সেই প্রাচীন জেনেটিক ভূত এই দেশের মানুষদের এখনো চালাইতেছে। বিচ্ছিন্নতা, ব্যক্তি স্বার্থ, সন্দেহ, অবিশ্বাস, অসহযোগিতার ভূত।