বাংলা ফিল্মে আগে দেখা যাইত গ্রামের বা শহরের ছোট এক ফ্যামিলি। মা বাপ বোন আর দুই ভাই। বড় ভাই ছোট খাট কাজটাজ করে। আর বাপ ধরেন গিয়া প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক।
ছোট ভাই শহরে যায় পড়ালেখা করতে। সেখানে চাকরী পায়। বড়লোকের মেয়ে (রীনা খান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিনয় করতেন এই চরিত্রে) বিয়ে করে। তারপর তার সেই বউ পরিবারে আইসা বিশৃঙ্খলা তৈরী করে। সে সকালে ঘুম থেকে উঠে না, মায়ের লগে খারাপ ব্যবহার করে, বোনরে ঝাড়ি দেয়, বন্ধুদের নিয়া দরজা বন্ধ কইরা নাচানাচি করে। শ্বাশুড়ি যখন জিগান যে বউ তুমি পর পুরুষের লগে দরজা বন্ধ কইরা ডান্স দেও কেন?
সে তখন রাইগা যায়। শ্বাশুড়িরে বাজে কথা বলে। জামাইর কাছে শ্বাশুড়ির ব্যাপারে নালিশ দেয়। জামাই বউয়ের কথা বিশ্বাস কইরা মায়ের বিরুদ্ধে কথা কইতে থাকেন। মা তখন কান্দেন। বাপ অবাক হন। বড় ভাই কিছু কইতে গিয়াও কন না। ইত্যাদি মানে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা আর কী!
একপর্যায়ে ছোট ভাই তখন বাপ মা ভাই বোন ছাইড়া বউ নিয়া চলে যায় শহরে। গিয়া শশুরের বড় ফ্যাক্টরীতে কাজ নেয়। গাড়ি বাড়ি নারীর মালিক হয়।
আর এদিকে বড় ভাই, মা, বাপ ছোট ভাইয়ের বাড়িতে একসময় আসে এবং আইসা পর্যাপ্ত সম্মান পায় না। তারা দেখতে পায় ছোটভাই আর ছোটভাই নাই। সে টাকার ঝলকানি দেইখা হইয়া গেছে অন্য কেউ। সে ভুইলা গেছে তারা ছোটকালে গাইছিল গান।
একসময় বড় ভাই অপমানিত হইয়া রিকশা কিংবা ট্যাক্সি চালানো শুরু করে। আর তারা সবাই গিয়া উঠে এক বস্তিতে।
এইরকম অনেক গল্প আছে। প্রচুর বলা যায়। কিন্তু এরকম গল্প কেন হইত? বা কেন পাবলিক খাইত এরকম গল্প?
এরকম ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছিল সেইকালে। মানে দেশে তখন নতুন হাওয়া লাগা শুরু হইছে আধুনিকতার। আর যেই শিক্ষা ব্যবস্থা তাতে নিজের রুটের প্রতি মমতা এখনো ছাত্র-ছাত্রীদের জন্মায় কী না সন্দেহ। সবাই এইটা ভাবতে থাকে যে আমারে আধুনিক হইতে হবে। আর আধুনিক হইতে হলে বরন করে নিতে হবে ওয়েস্টার্ন কালচার। নিজের কালচার সম্পর্কে ভালো করে না জানলে এর শক্তি কী বুঝা সম্ভব? আর সেই বুঝ না আসলে কী করে আসবে আত্মসম্মান এবং নিজের রুটরে স্বীকার করে নেয়ার মত কনফিডেন্স?
আমাদের নায়কের ছোট ভাই যাকে আমরা বলতাম সাইড নায়ক তার সেই কনফিডেন্স ছিল না। তিনি আধুনিকতা, আধুনিক জীবন যাপনের ফাঁদে পইড়া গিয়া ভুলে গেলেন মা’রে, বাপরে, বড় ভাইরে, বইনরে। কোন কোন ফিল্মে এও দেখা যাইত যে বাপ অনেকদিন পর পোলারে খাওয়াইতে টিফিন লইয়া গেছেন পোলার অফিসে। টিফিন খুইলা খাবার পরিবেশন করতে গেছেন। এইসময়ে পোলার অফিসে আরেক লোক আইসা বলল, ভাই আপনার চাকরটা তো খুব ভালো। এইরকম ভালো চাকর কই পাওয়া যায়?
তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে ট্যা ট্যা ট্যা করুণ সুর বাইজা উঠে। ক্যামেরা যায় বাপের বেদনার্ত মুখের দিকে। আরেকবার যায় পোলার বিব্রত মুখের দিকে। পোলা কিছু কয় না। কইতে পারে না, ‘এইটা চাকর না, এইটা আমার বাপ’।
এই না কইতে পারা হচ্ছে নিজের লজ্জার জন্য। কীসের লজ্জা আমাদের সাইড নায়কের?
বাপ যে অতি সাধারন গরীব লোক তা তিনি জানাইতে চান না কাউরে। তিনি ধনী শ্বশুর ও ধনী বউ নিয়াই গর্বিত। তিনি এখন হাই সোসাইটির লোক। ক্যামনে তিনি বলেন এই চাষা কিংবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক তার পিতা?
আমাদের সাইড নায়কের ভিতরে এক দ্বন্দ্ব কাজ করে। যে তিনি কী করবেন? তার মাথার একটা অংশ বলে প্রতিবাদ কইরা সব আধুনিকতার বাপরে বাপ বলতে সবার সম্মুখে। আরেকটা অংশ বলে, না এটা বলা যাবে না। এইটা বললে সবাই বুঝে যাবে আমি গরীবের পোলা। কমে যাইতে পারে আমার সম্মান।
এই সম্মান কমে যাওয়ার ভয় তার মধ্যে ক্রিয়া করে। ফিল্মে আমরা দেখি আমাদের সাইড নায়ক পরাজিত হন নিজের ভয়ের কাছে। পরাজিত হন আধুনিকতার চাকচিক্যের মোহমায়ার কাছে।
আমি বলি যে এই আমাদের আধুনিক মানুষদের মধ্যে কী সাইড নায়কের দ্বন্দ্ব ক্রিয়া করে না? মানে যারা নিজের রুটরে অস্বীকার করতে চান তাদের মধ্যে? সব কিছু বলছি না আক্ষরিক অর্থে। অর্থাৎ সব সময় যে তার বাপ মা অথবা ভাই হতে হবে এমন না। যখন তিনি নিজের মূলভূমির কৃষ্টি কালচাররে এড়াইয়া গিয়া ভীনদেশী পালকে গা ডাকেন তখনকার কথা বলতেছি। তখন কী তার মধ্যে ক্রিয়া করে না এই দ্বন্দ্ব? এই আধুনিকতার দ্বন্দ্ব, সম্মান হারিয়ে যাওয়ার ভয়?
এখানে এইটা বলা হচ্ছে না যে ভীনদেশী কালচার ইত্যাদি খারাপ। এরকম কথা যারা বলেন তাদের সাথে আমার কথা মিলানোর কোন সুযোগ নাই। আমি বলতেছি সম্মান হারানোর ভয়ে নিজের রুট লুকানোর প্রবণতারে নিয়া। কারন আমার ধারনা এটা মানুষের কনফিডেন্স লেভেল কমাইয়া দেয়। এবং তারে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে অসচেতন কইরা তুলে।
টোটাল ফিল্মের গল্পে আমরা দেখতে পাই একটা পরিবারের সাথে আধুনিকতার দ্বন্দ্ব এবং এট লাস্ট একটা হ্যাপী এন্ডিং হয়। যেখানে বাপ-মা-বড় ভাই সাইড নায়ক ছোট ভাই এবং পরিবারে অশান্তি আনয়নকারী তার বউকে মাফ করে দেন।
কিছু কিছু ফিল্মের গল্পে ছোট ভাইয়ের জায়গায় থাকতেন বড় ভাই। অর্থাৎ তিনি আধুনিক হইয়া বড়লোকের মাইয়ারে বিয়া করেন। তার বউ পরিবারে অশান্তি আনেন। আর তার ছোট ভাই অর্থাৎ আমাদের নায়ক একসময় স্বর্নালঙ্কার চুরির দায়ে গৃহ হইতে বিতারিত হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ছোট ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন ইলিয়াস কাঞ্চন। যিনি এখন নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন করেন।
যাইহোক, সব শেষে একটা হ্যাপী এন্ডিং হইত। কারণ দর্শকদের হতাশ করার রিস্ক কোন পরিচালক সহজে নিতে চান না। তারা চান দর্শকেরা হ্যাপী থাকুক।
এইসব ফিল্মের ক্ষেত্রে সেই আধুনিক হইতে যাওয়া বা আধুনিক হওয়া ভাইটি কি একটা দেশে পুঁজিবাদের আগ্রাসনের প্রতীক? আর ভাইয়ের ধনীর মাইয়া বউ কী বিদেশী শক্তি যারা দেশে পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটায়, পলিটিশিয়ানদের ঘুষ টুশ দিয়া দেশের জনগণ ও রাষ্ট্র সম্পদের জন্য ক্ষতিকর আইন তৈরী করায় নিজের লাভের জন্য? এইরকম রূপকে কী ভাবা যায়?
ভাবা যায় কী বুর্জোয়া পুঁজিবাদ এবং এর আধুনিকতার মায়াজালে আবদ্ধ হয়েই আমাদের সাইড নায়ক নিজের বাপ-ভাই-মায়ের সাথে বিদ্যমান বন্ধন ছিন্ন করতে পারছিলেন?
জনাব মার্ক্স তার কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে বুর্জোয়া শ্রেনী আর পুঁজিবাদের ব্যাপারে বলেছিলেন যে এরা যেভাবে সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক, প্রকৃতি-শোভন সম্পর্কগুলো ভেঙ্গে দিয়েছে, তা ইতিহাসের দিক থেকে একরকম বৈপ্লবিকই বলা যায়। মানুষের সেসব বন্ধন ও সম্পর্কগুলো ভেঙ্গে দিয়েছে তৈরী করেছে স্বার্থের বন্ধন। টাকার বন্ধন।
আমাদের সাইড নায়কের মধ্যে আমরা সেটা দেখতে পাই। পুঁজিবাদ কীভাবে তার উপর ক্রিয়া করে পারিবারিক বন্ধনগুলো ভেঙ্গে দেয়।
দেশ কী আমাদের সেই সাইড নায়ক? যে পুঁজিবাদের মায়াতে পড়ে গেছে। তাকে উৎসাহ দিচ্ছে, কূটচাল দিচ্ছে, বিভিন্ন ভ্রান্ত মায়া (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ডেভলাপমেন্ট, ডিজিটালাইজেশন ইত্যাদি) উপস্থাপন করে ভুল স্বপ্ন দেখাচ্ছে ভীনদেশী রাষ্ট্র। অবশ্যই তাদের নিজেদের লাভের জন্য।
তাই হয়ত দেখা যায় ভবন ধ্বসে শ্রমিকের মৃত্যুর মিছিলের পরও মূনাফালোভীদের কর্মকান্ড থামানো যাচ্ছে না, নিশ্চিত করা যাচ্ছে না শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী এবং নিরাপত্তা। চা শ্রমিক, পোষাক শ্রমিক, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের শ্রমিক সব শ্রমিকদেরই নানাভাবে বঞ্চিত করে ফুলে ফেঁপে উঠছে মূনাফালোভীরা। কিন্তু দেশ নির্বিকার, শ্রমিকের চিতা থেকে ধরাচ্ছে চার্মিনার।
আমাদের দেশ আমাদের সেইসব ফিল্মের সাইড নায়কের পথে হাটতে শুরু করেছে পুঁজিবাদের চাকচিক্যের মায়াতে পড়ে? ফিল্মের পরিবার যেভাবে ভুগেছিল দেশের জনগনকেও কী সেভাবে ভুগতে হবে বা ভুগছে? কোন পরিবর্তন কী আসবে? আমাদের সাইড নায়কের মত দেশ কী বুঝতে পারবেন ভুল পথে হাটছেন তিনি? আমরা কী কোন হ্যাপী এন্ডিং এ যেতে পারবো শেষ পর্যন্ত? মানে সেইরকম পরিচালক-কাহিনীকার কেউ কি আছেন দেশের পেছনে?