বাঙালী মুসলমান তত্ত্বের সমস্যা

এবাদুর রহমান, ফরহাদ মজহার এনাদের বাঙালী মুসলমান আইডেন্টিটি তৈরির যে হেগেলিয়ান প্রচেষ্টা, এটা এক আধ্যাত্মিক প্রকল্প। পিনাকী ভট্টাচার্যের দুইটা ভিডিওতেও দেখলাম তিনিও গাইস্ট বা মহাজীবনের কথা বলেছেন।

এইগুলার সমস্যা হইতেছে, এই অনুমানগুলা আসলে বাস্তব সমাজে নাই। হেগেল যেভাবে দেখছিলেন ইতিহাস এক টেলিওলজিক্যাল র‍্যাশনাল প্রসেসে আগাইতেছে, ডায়লেকটিকসের মধ্য দিয়া, যার ড্রাইভিং ফোর্স গাইস্ট, যেইটার লক্ষ্য পূর্ণ ফ্রিডম এবং সেলফ কনশাসনেসে পৌঁছানো, এরকম কিছু নাই সমাজে।

এইটা ধর্মরে সরাইয়া আবার ধার্মিক ভাবেই সমাজ ও ইতিহাসরে ব্যাখ্যা করার এক প্রকল্প ছিল। গাইস্ট খ্রিস্টান থিওলজি দ্বারা প্রভাবিত। খ্রিস্টানিটির প্রভাব যখন কমে যাইতে থাকলো, তখন বড় বড় দার্শনিকেরা খ্রিস্টানিটির বাইরে গিয়া জীবন ও জগতরে ব্যাখ্যা দিতে চাইছিলেন, সেটারই এক অংশ এই গাইস্ট।

গাইস্ট সব কিছুরে ধারণ করে ফেলতে চায়, সভ্যতার স্পিরিট হিশেবে। এবাদুর রহমানের ভিডিওতে দেখলাম, তিনি বলতেছেন বাঙালী মুসলমানের গাইস্ট ১৯৪৭ এ একবার জাগ্রত হইছিল, ২০২৪ এ একবার, ইত্যাদি, এরকম কথাবার্তা।

তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এপ্রোচ হইল, হিস্টরি থেকে কিছু জিনিশরে পিক করে, ওইগুলারে গাইস্টের জাগরণ হিশেবে ধরে, ভবিষ্যতের যাত্রা তৈরি করতে চাওয়া, ওইটারে গাইস্টের বা এই সমাজের স্পিরিটের যাত্রা বলে।

এই ধরণের চিন্তা খারাপ কারণ, একে তো ঐরকম কোন গাইস্ট নাই। দুই, এটা ডিটারমিনিস্টিক, তিন, এই তথাকথিত গাইস্ট বা মহাজীবনের যাত্রাপথে বিশ্বাস করাইয়া মানুষরে “নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই” এর দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে, মানুষ রাস্তায় গিয়া প্রাণ দিবে।

এবং, বাঙালী মুসলমান আইডেন্টিটি নির্মাণ করতে হইলে ইতিহাসে যাইতে হবে, পিছন খুঁড়ে উপাদান সংগ্রহ করে, ন্যারেটিভ তৈরি করে জাতীয়তাবাদী আইডেন্টিটি নির্মাণ করতে হবে, যেইটা হবে কৃত্রিম ও অকাজের। এর দ্বারা সমাজের কোন উপকার হবে না লং রানে।

এই সময়ে আমাদের আইডেন্টিটি নির্মিত হবে এই বিদ্যমান বাস্তবতার পাওয়ার স্ট্রাগলরে কেন্দ্র করে। আমাদের সামনে যেসব সমস্যা আছে বাস্তবে, যেমন ৬০ লাখ ইয়াং লোকের চাকরী নাই, শিক্ষার অবস্থা খারাপ, শিক্ষিত অনেক লোকের স্কিল নাই, অনেক মানুষ দরিদ্র আছেন এখনো, স্বাস্থ্যব্যবস্থা খারাপ; এইসবরে সমাধান করতে করতে আমাদের আইডেন্টিটি বর্ধিত হবে, বর্জিত হবে। আইডেন্টিটি কোন স্থির জিনিশ না, এবং কোন একক জিনিশ না। সময়ের সাথে সাথে এটা চেইঞ্জ হয়, অনেক কিছু গৃহীত হয় এবং বর্জিত হয়।

ইতিহাস থেকে খুইজা, রি ইনভেন্ট করার প্রক্রিয়া একটা ফিক্সড আইডেন্টিটি নির্মাণের দিকে যায়। যা এক পর্যায়ে অপ্রসিভ, ও ফ্যাসিস্ট প্রবণতার দিকে নিয়ে যাবার জোর সম্ভাবনা রাখে।

এছাড়া, ইতিহাসের সকল কালপর্বে মানুষ একই ভাবে জীবন ও জগতরে দেখেন নাই, একই জিনিশ নিয়া একই ভাবে ভাবেন নাই। আমাদের ভাবনা কখনো আমাদের একার না। অন্য অনেক কিছুর সাথে সম্পর্কিত করে আমরা ভাবি। ওই সময়ের সমাজ, মানুষ, প্রযুক্তি, মিডিয়া আমাদের প্রভাবিত করে। যেমন, শিল্প বিপ্লবের পরে জন্মানো মানুষেরা যেভাবে ভেবেছেন, যেই সত্য উপলব্ধি করেছেন, তার সাথে হান্টার গেদারার সমাজের লোকদের সত্য ও চিন্তার মিল হবে না।

কোন এক কালপর্বে, কোন এক সমাজের আবিষ্কৃত, উপলব্ধিতে আসা সত্য, ওই ওই সমাজের ও কালের জন্য সত্য।

ডিসেম্বর ১২, ২০২৪


ফন্ট বড় করুন-+=