বাদশা আলমগীর, তাহার কুমার এবং মৌলবী বিষয়ে

বাদশা আলমগীর, কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলবী দিল্লীর। শিক্ষকের মর্যাদা নিয়ে এই কবিতা পড়ানি হয়। কবি কাজী কাদের নেওয়াজ। এই কবিতার কাহিনী হচ্ছে বাদশা আলমগীর একদিন গিয়া দেখেন তার ছেলে পানি ঢালতেছে শিক্ষকের পায়ে। পরে তিনি শিক্ষকরে ডাকাইয়া নিলেন। শিক্ষক তো ভয়ে অস্থির। বাদশা আলমগীর জিজ্ঞাস করলেন, কি বিষয় মৌলবী? আমার পোলা আপনার কাছ থেকে আদব কায়দা কিছু শিখতেছে বলে তো মনে হয় না।

মৌলবী ডরাইয়া বললেন, হুজুর আমার ভুল হইয়া গেছে।

বাদশা বললেন, থামেন আপনে। পোলা আপনার পা হাত দিয়া ধইয়া দেয় নাই কেন?

মৌলবী তখন খুশি এবং অবাক হইয়া গেলেন। বাদশারে ঘোষনা দিলেন মহান উদার হিসাবে।

Badsha alomgir

এই মহান উদার বাদশা আলমগীর হইলেন মোগল সম্রাট শাজাহানের সন্তান আওরঙ্গজেব। যিনি তার বাপ শাহজাহানরে বন্দি কইরা রাখছিলেন দীর্ঘদিন। তাই ইরানের তৎকালীন সাফাবিদ রাজা সমালোচনা করছিলেন আওরঙ্গজেবের।  এবং মক্কার শরীফ তাকে একজন  আইনগত ভাবে মুসলিম মানতে চান নাই। কারণ বাপরে বন্দি করে রাখা তখনকার সমাজে খুবই বড় অন্যায় ছিল।

আওরঙ্গজেব তার তিন ভাইরে মারছিলেন। বড় ভাই দারারে মাইরা তার মাথা সিল্কের কাপড়ে মুড়াইয়া বাপ শাজাহানের কাছে পাঠাইয়া দিছিলেন, এমনো কেউ কেউ বলেন। তবে এই জিনিস বর্তমানের বিচারে খারাপ মনে হইলেও, কোনও ঐতিহাসিকদের মতে এইটাই ছিল মুঘলদের নিয়ম। তাদের রাজত্বে বড় ছেলে সিংহাসনের উত্তরাধিকার পাইত না। ছেলেরা যুদ্ধ করত এবং যে জিতত সেই রাজত্ব পাইত। এই নিয়ম ছিল যাতে যোগ্য ছেলে রাজত্ব পায় এবং সাম্রাজ্য টিকাইয়া রাখতে পারে। পারসিয়ান একটা কথা আছে, ইয়া তখন ইয়া তাবুত, অর্থ সিংহাসন অথবা কবর।

কবিতায় যে কাহিনীর বর্ননা আছে তা সত্য কি মিথ্যা জানি না। তবে কবিতার মেসেজে শ্রদ্ধারে ভুল ভাবে উপস্থাপন করা হইছে। কাউকে শ্রদ্ধা করার অর্থ এই না গায়ে গতরে খাইটা তার উপকার বা কাজ কইরা যাওয়া। শ্রদ্ধা সম্পূর্ন ভিন্ন ব্যাপার, আত্মিক। শিক্ষকের প্রতি সম্মান থাকার অর্থ এইটা না যে তার পা ধইয়া দেয়া, বাজার কইরা দেয়া।

মর্যাদারে বিশেষায়িত করতে গিয়া এখানে প্রথমত শ্রদ্ধা সম্পর্কে ভুল মেসেজ উৎপন্ন হয়।

দুই, শিক্ষাগুরু বলতে যদি গুরুকে বুঝানো হয় তাইলে ব্যাপারটা ভিন্ন। গুরু আর শিক্ষক ভিন্ন জিনিস। তাদের মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য বিদ্যমান। আগে গুরুদের বাড়িতে থাইকা ছাত্ররা পড়ত। গুরুর সাথে খাইত, থাকত। গুরু তাদের পড়াইয়া টাকাও নিতেন না। এই গুরুরা মাঝে মাঝে গুরুদক্ষিণা চাইতেন। ছাত্ররা তা দিতেন। এইসব গুরুদের জন্য কাজ করা, পা ধইয়া দেয়া, বাজার করা ইত্যাদি যৌক্তকভাবে ঠিক আছে। কিন্তু বাদশা আলমগীরের ছেলের শিক্ষক একজন দিল্লীর মৌলবী, তিনি মনুসংহিতার গুরু না। শিক্ষকরে গুরু বলা মানে গুরুদের অমার্যাদা করা।

 


আলমগীরের আরেকটা বদনাম হিন্দু মন্দির ভাঙ্গা বিষয়ে। আজকে ভারতে যে হিন্দুত্ববাদ, তারা বলে মুঘলদের হিন্দু নির্যাতনের কথা। বলতে গিয়ে তারা আলমগীরের ইতিহাস আনে। এ ইতিহাস যে একেবারে মিথ্যা এমন নয়।

 

পারসিয়ান দার্শনিক দারিউশ শায়েজান (Dariush Shayegan) এভাবে বলেনঃ

ছবিঃ ইরানের অন্যতম বড় একজন দার্শনিক দারিউশ শায়েজান।

“আমি দেখে অবাক হয়েছি যে মুঘলদের (অবশ্যই তারা খুবই বুদ্ধিমান লোক ছিল) ৬০ টি হিন্দু সংস্কৃত বই পার্সিতে অনুবাদ হয়েছিল। ভগবত গীতা, মহাভারত, রামায়াণ, যোগ শাস্ত্র, সবই অনুবাদ হয়েছিল। দারা শিকোহ নিজেই ৫০ টি উপনিষদ পার্সিতে অনুবাদ করেন।

তিনি বেনারসের শাসক ছিলেন। দারা শিকোহ চেয়েছিলেন হিন্দু মুসলমানকে এক করতে, যাতে তারা শান্তিতে বাস করতে পারে। এজন্য দেখবেন আকবর বিয়ে করেছিল হিন্দু পরিবারে। তারা খুবই বুদ্ধিমান ছিল এদিক দিয়ে, কিন্তু আলমগীরের সময়েই সব বদলে গেল।

দারা শিকোহ জিতলে, আপনাদের দেশভাগ দেখতে হত না। আলমগীর করলো কি, বেনারসের মসজিদ বানানোর সাহস দেখাল…মানে, আপনি ভাবতে পারেন ভ্যাটিক্যানে মসজিদ বানানোর কথা? এটা ছিল বড় মূর্খতা।”