বিশ্বসাহিত্য বিষয়ে

ধারণা হিসেবে বিশ্বসাহিত্য

আমরা এখন বিশ্বসাহিত্য বলতে যা বুঝি ১৮ বা ১৯ শতকের আগে এমন কোন কনসেপ্টই ছিল না। গ্যেটে নামে জর্মন এক বড় লেখক আছেন, আপনারা জেনে থাকবেন। তিনি জন্মেছিলেন – ২৮ আগস্ট ১৭৪৯ সালে, এবং গত হন ২২ মার্চ, ১৮৩২ সালে।

গ্যেটে, ছবিসূত্রঃ গুগল আর্ট।

এই বুদ্ধিমান ভদ্রলোক তার আগেকার সময়ে লেখা, এবং পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে লিখিত হওয়া গ্রন্থসমূহের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পারস্যের কবিতা থেকে চীনা লেখকদের বই ইত্যাদি পড়তে পড়তেই গ্যেটে বুঝতে পারেন সারা বিশ্বের সাহিত্যের এক মিলমিশ হচ্ছে।

ইয়োহান পিটার একারম্যানের সাথে এক আলোচনায়, গ্যেটেই প্রথম বিশ্বসাহিত্য শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। একেবারে ঠিকঠাক করে বলতে গেলে বিশ্বসাহিত্যের জন্ম ১৮২৭ সালের জানুয়ারী মাসের ৩১ তারিখ বিকেল বেলায়।

বিশ্বসাহিত্যের জন্ম প্রক্রিয়া ছিল আড়ম্বরহীন। কথকদ্বয়ও এই শব্দে তেমন কোন বিশেষ গুরুত্ব দেন নি সেই কথোপকথনে। শব্দটির ধরাধামে আগমনের ক্ষেত্রে তরুণ ইয়োহান পিটার একারম্যানের ভূমিকা আছে। একে সক্রেটিসীয় ভাবে বললে বলা যায় ধাত্রী ভূমিকা। কথা বলতে বলতে একজনের ভেতর থেকে কিছু বের করে নিয়ে আসা, সক্রেটিস যা করতেন। তবে সক্রেটিস যেমন না জানার ভান করে কথা বলতেন, পিটার এমন করেন নি অবশ্যই গ্যেটের সাথে। কারণ পিটার আসলেই জানতেন না।

খুবই দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। গরিবের ছেলে, নিজের প্রতিভা ও অন্যের সাহায্যে আইন বিষয়ে পড়াশোনার এক সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু কাল হলো তার সাহিত্য শিল্প অনুরাগ। তিনি আইন বিষয়ে লেখাপড়ার চাইতে এগুলিতে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়লেন। এর মাঝে এক বন্ধুর মারফতে গ্যেটের কবিতার সাথে পরিচয়। গ্যেটে পড়ে আইন পড়া ছেড়ে দিলেন, বা অন্য কথায় ছেড়ে দিলেন সম্ভাবনাময় এক মধ্যবিত্ত জীবন। গ্যেটেকে মানলেন গুরু, লিখে ফেললেন তার কবিতা নিয়ে এক বইয়ের পাণ্ডুলিপি। পাণ্ডুলিপি গ্যেটের কাছে পৌঁছানোর জন্য ভেইমার শহরে যাওয়া দরকার, যেখানে মহান গ্যেটের আবাস। কিন্তু পিটারের হাতে টাকা নেই। অগত্যা পা ভরসা করেই তিনি রওনা হন এবং পায়ে হেঁটে ভেইমারে চলে আসেন, গ্যেটের আবাসস্থলে। গ্যেটে তখন বৃদ্ধ, আশি উর্ধ্ব বয়স, অবস্থান করছেন খ্যাতির শীর্ষে। তিনি তরুণ পিটারের পান্ডুলিপি পড়ে চমৎকৃত হন। পিটার এক জায়গায় কিছুদিন সেক্রেটারির কাজ করেছিলেন, সেই কাজের প্রশংসাপত্রও তিনি দিয়েছিলেন গ্যেটেকে। গ্যেটে তখন এমন একজন লোকই খুঁজছিলেন তার সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেবার জন্য এবং পিটারকে রেখে দেন তার একরকম সহকারী হিসেবে। পিটার গুরুর সান্নিধ্য, এবং তার সাথে সাথে তৎকালীন অনেক বড় সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে আসতে পেরে ধন্য ছিলেন। যদিও গ্যেটে তাঁকে তেমন টাকা পয়সাও দেন নি, বা অন্য চাকরি নিতেও নিরুৎসাহীত করতেন; এমনকি তার বিবাহ করাতেও অমত দিতেন!

এক্ষণে আমার জিউস ও তার শিষ্যের কাহিনীটি মনে পড়ে। জিউস, মাউন্ট অলিম্পাসের দেবতাকূলের রাজা, মহাশক্তিধর। একবার তিনি দুনিয়াতে ঘুরছিলেন এবং তথায় গ্যানিমেড নামক এক সুন্দর বালককে দেখতে পান। তার সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং ঈগলের রূপ ধারণ করে তাকে ধরে নিয়ে যান মাউন্ট অলিম্পাসে। সেখানে বালকটি জিউসের সেবা ও পাত্র বহনকারীর কাজ করত। জিউস তাকে সেই বয়সেই আটকে রাখেন। তাকে অমরত্ব দান করেন।

ঈগলের রূপ ধরে জিউস ধরে নিয়ে যাচ্ছেন গেইনেমেডকে, ছবিসূত্রঃ উইকিমিডিয়া

এই গল্পটি গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। গুরু ব্যক্তিটি কোন তরুণের মধ্যে নিজের তরুণকালের ছায়া দেখতে পেয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হন। নিজের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থেকে তাকে শেখাতে যান, এবং এর মাধ্যমে তিনি যেন নিজেকেই আবার আরেকটু ভালোভাবে নির্মাণের আনন্দ পান। কিন্তু জিউসের মত গুরুরা অন্যরকম, তারা শিষ্যকে আর বাড়তে দেন না। নিজেদের আনন্দের জন্য তারা শিষ্যকে ঐ অবস্থাতেই আটকে রাখেন। এবং শিষ্য তখন আর গুরুর ছায়া থেকে বের হতে পারেন না।

মহান গ্যেটের মধ্যেই এই তৎপরতা হয়ত অল্প ছিল, অবচেতনে হয়ত। তবে পিটার এতে আহত হন নি, যেহেতু গ্যেটের বিশালতা ছিল আসলেই বিশাল, ফলে তার কাছ থেকে জানার ও নেয়ার সুযোগ ছিল প্রচুর। এই সুযোগ পিটার ভালোভাবে কাজে লাগান। তিনি গ্যেটের সাথে তার কথাবার্তা সংরক্ষণ করতে শুরু করেন। তারা প্রায়ই কথা বলতে বসতেন।

পিটার একারম্যান, ছবিসূত্রঃ উইকিমিডিয়া

এমনই একদিন গ্যেটে কথা বলছিলেন তার পড়া চীনা উপন্যাস নিয়ে।

চমকে ওঠেন পিটার। চীনা আবার উপন্যাস হয় কী করে!

গ্যেটে বিব্রত হন। তিনি বলেন চীনদেশের উপন্যাস আছে, এবং তা ভালো।

পিটারের বিস্ময় কাটে না। তিনি আবার নিশ্চিত হতে চান।

বিরক্ত হন গ্যেটে শিষ্যের মূর্খতা দেখে। অবশ্যই পিটারের পড়ালেখা কম ছিল। চাইনিজ উপন্যাস হতে পারে তার জানা ছিল না। তার কম জানাজনিত সুপিরিয়রিটি বোধ ছিল যে কেবল তার চেনা ভাষাগুলিতে হয়ত উপন্যাস হয়, বাকিরা ওসব পারে না।

গ্যেটে তখন শিষ্যকে বুঝাতে গিয়ে বিশ্বসাহিত্য শব্দটির অবতারণা করেন। তাদের কথোপকথন ছিল জর্মন ভাষায়, এবং গ্যেটে বিশ্বসাহিত্যের জর্মন প্রতিশব্দই ব্যবহার করেছিলেন।

বিশ্বসাহিত্য শব্দটির সাথে বিশ্ববাজার জড়িত। গ্যেটে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন কারণ প্রথমবারের মত তিনি এবং অন্য মানুষেরা এমন এক পৃথিবীতে বসবাস করতে শুরু করেছিল যেখানে ছিল সাহিত্যের জন্য একটি বিশ্ববাজার। আরবের, ভারতের বা চীন ইত্যাদি দেশের লেখকদের বই পড়তে পারছিলেন গ্যেটে, তার লেখাও পড়তে পারছিল অন্যরা।

আমাদের এখানে বিশ্বসাহিত্যের কনসেপ্ট যেমন

আমাদের যে বিশ্বসাহিত্য কনসেপ্ট আছে তা অবশ্য একটু ভিন্ন। বিশ্ববাজার উদ্ভূত বিশ্বসাহিত্যকে আমাদের এখানে ধরা হয় বিশ্বমান নির্ভর একরকম সাহিত্য। এই বিশ্বমানটা কী বস্তু তা জটিল বিষয়। বিশ্বসাহিত্যের এই কনসেপ্ট অবশ্যই ভ্রান্ত।

যেহেতু বিশ্ববাজারই বিশ্বসাহিত্যের মাতা ও পিতা তাই বিশ্ববাজারে বিক্রি হওয়া বইগুলি বিশ্বসাহিত্যের অংশ। মান টানের কোন বালাই নাই। বিশ্বসাহিত্য হতে গেলে নির্দিষ্ট মানে হতে হবে, ওরহান পামুকের বই বিশ্বসাহিত্যের অংশ আর ড্যান ব্রাউনের বই বিশ্বসাহিত্য হতে পারে না, এমন চিন্তা ভুল।

পামুকের বই ক্লাসিক সাহিত্য হতে পারে, ড্যান ব্রাউনের বই বা ই এল জেমসের এডাল্ট সিরিজ ফিফটি শেডস অব গ্রে পপুলার ফিকশন হতে পারে, কিন্তু তারা সবই বিশ্বসাহিত্য। বরং বিশ্বসাহিত্য হওয়ার দৌড়ে থ্রিলারগুলি এগিয়ে থাকে। ড্যান ব্রাউনের বই বাংলায় অনুবাদ হতে প্রকাশের পর কয়েক সপ্তাহ লেগেছে মাত্র। আবার কোন এক সময়ের পপুলার সাহিত্য অন্য সময়ে গিয়ে ক্লাসিক হয়ে উঠতে পারে, যেমন শেক্সপিয়র।

যে বই বিশ্ববাজারে যেতে পারে না, সে বই বিশ্বসাহিত্যের অংশ নয়। যেমন, বাংলাদেশী প্রায় সব লেখকদের বই, যেসব ইংরাজিতে অনুবাদ হয় না। এগুলি যতই ভালো হউক, যতই মানে টুইটুম্বুর থাকুক না কেন, এসব বিশ্বসাহিত্যের অংশ নয়। এদের স্বান্তনাসরূপ সম্ভাবনাময় বিশ্বসাহিত্য নাম দেয়া যায়। অর্থাৎ, কোন একদিন যদি ইংরাজিতে অনুবাদ হয় তখন তা বিশ্বসাহিত্য হতে পারে। কিন্তু আমি বিশ্বের নাগরিক, আমি বই লিখেছি তাই এটি বিশ্বসাহিত্য এমন নয়। কারণ কনসেপ্ট হিসেবে এক বিশ্বের অস্তিত্ব নিজেই দার্শনিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। কেন ও কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ তা আমি এখানে বলতে পারব না, কারণ সেই সুযোগ নেই। তবে আগ্রহীরা জর্মন দার্শনিক মার্কাস গ্যাব্রিয়েলের বই ও লেকচার দেখতে পারেন, যার লিংক এই লেখার শেষাংশে আমি যুক্ত করে দেব।

এখন আবার বিশ্বমানের কথায় আসি। দুনিয়ার সব জায়গায় মানুষের মান সংশ্লিষ্ট ধারণা এক হয় না।

কারণ তাদের সাংস্কৃতির বৈচিত্র থাকে, জীবন ধারণে বৈচিত্র থাকে, অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় মস্তিষ্ক সক্ষমতায়ও ভিন্নতা থাকে। নিউরোসাইন্টিস্ট রবার্ট সাপোলস্কির কাজে, বা সমাজ বিজ্ঞানের এ পর্যন্ত করা দীর্ঘতম গবেষণা আমাদের এই তথ্যই দেয় বৈজ্ঞানিকভাবে। এছাড়া মানুষের থাকে নানা ধরনের কগনিটিভ বায়াস, যা তাদের চিন্তা কাঠামো তৈরি করে।

ফলে এক এলাকার মান দিয়ে অন্য এলাকার শিল্প বস্তুর মান নির্ধারণ করতে গেলে সমস্যা রয়ে যায়। এইজন্যই ভারতের শিল্পকে ইউরোপিয়ানরা বুঝতে পারে নি ও আর্ট নয় ক্রাফট হিসেবে মূল্যায়ন করেছে তাদের মানদণ্ডে। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সৈয়দ নিজার তার ভারতশিল্পে উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা বইয়ের প্রথমাংশে, ফলে এক্ষণে বিস্তারিত আলাপ আর না করি, আগ্রহীরা বইটি দেখতে পারেন।

এখন আমাদের দেশের একটা বই বিশ্বসাহিত্য হতে গেলে বিশ্ববাজারে তাকে যেতে হবে, এইজন্য বড় কোন ভাষায় তার অনুবাদ হওয়া দরকার পড়ে। সাধারণভাবে ইংরাজি ভাষা। ইংরাজিতে অনুবাদ হয়ে গেল, সেই অনুবাদ আবার পোক্ত ইংরাজি হতে হবে। বাংলা বই ভালো ইংরাজিতে অনুবাদ হয় না এমন কথা সুনীলের মুখেও আপনারা শুনতে পারেন ইউটিউবের বদৌলতে।

ইংরাজিতে অনুবাদ হয়ে গেলেই হয় না, ইউরোপিয়ানদের বিবেচনায় এর মান ভালো হলেই তা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে তাদের। বড় পত্রিকার, প্যারিস রিভিউ, নিউ ইয়র্কার, ইত্যাদির।

এই কারণে বাংলায় বসে তথাকথিত বিশ্বমানের তথা পশ্চিমা মানের লেখার চেষ্টা করতে পারেন কোন লেখক। ঐ মানে যাওয়ার জন্য, স্বীকৃতির জন্য। এই লেখা তাই কৃত্রিম হবার সম্ভাবনা (বা আশঙ্কা) থাকে, এবং আমরা এখানে জিউস ও গ্যানিমেডের কাহিনীটা আবার স্মরণ করতে পারি।

জিউস গ্যানিমেডকে তার পাত্রবাহক করে রাখেন, এবং আবার অমর করে রাখেন। অমরত্ব পেলেও সে কিন্তু জিউসের পাত্রবাহকই রয়ে যাবে। এখন তথাকথিত বিশ্বমান এবং ভুল বিশ্বসাহিত্য কনসেপ্টের বলি লেখকটিরও এই দশা হওয়া স্বাভাবিক। জিউস এখানে পশ্চিমা মানদণ্ডদারী এস্টাবলিশমেন্ট, আর পাত্রবাহক গ্যানিমেড কারা আর বলব কি?

সাম্প্রতিককালে বিশ্বসাহিত্যে বাংলাদেশের কোন লেখকের গল্পটি আলোচিত হয়েছে? তাহমিমা আনাম নামক একজন লেখিকার একটি গল্প। এটি ইংরাজি ভাষায় রচিত, এবং ও হেনরি পুরস্কার পেয়েছে। এটি পড়লে এবং বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় শ্রেনীর কোন সাহিত্যিকের গল্পও যদি পড়া থাকে তাহলে তুলনা করলে বাংলাটাকে এগিয়ে রাখতে হবে সাহিত্য মানের দিক থেকে।

পশ্চিমা স্বীকৃতি মানেই বিরাট সাহিত্য মান এই বিচারেই আলোচনা তৈরী করতে সক্ষম হয় এরকম গল্প। আনন্দ গদগদ হয়ে এটার বাংলা অনুবাদও হয়েছে দ্রুত। বিশ্বসাহিত্য কনসেপ্টকে ভুল বুঝে, বিশ্বমানের ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে এক উপনিবেশীয় বিভ্রান্তিতে আটকে থাকার ফল এসব।

বাংলাসাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার জয়ী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম বলা হয়। কিন্তু নোবেল পুরস্কারের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যায় লেখা আছে, “because of his profoundly sensitive, fresh and beautiful verse, by which, with consummate skill, he has made his poetic thought, expressed in his own English words, a part of the literature of the West”.

অর্থাৎ, ইংরাজিতে তার কবিতা লেখার জন্যই, পশ্চিমা সাহিত্যের অংশ হিসেবে তিনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলা সাহিত্য এখনো নোবেল পুরস্কার পায় নি, যেমন রাশান সাহিত্য পেয়েছে, স্প্যানিশ সাহিত্য ইত্যাদি পেয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বসাহিত্যের একজন বড় লেখক। আজ ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখেও দেখতে পাচ্ছি নোবেল পুরস্কারের সাইটে, সবচাইতে জনপ্রিয় সাহিত্য নোবেল জয়ীর দশজনের তালিকার দ্বিতীয় নামটি তার। সুতরাং, আমার কথাটি তাকে, তার প্রতিভা ও অর্জনকে ছোট করার জন্য নয়, বাস্তবতাটা দেখার জন্য।

আমাদের মানদণ্ডমূলক বিশ্বসাহিত্য কনসেপ্টের আরো সমস্যা

আমরা বাজারভিত্তিক না ধরে মানদণ্ডধারী যে বিশ্বসাহিত্য কনসেপ্টের বিভ্রান্তিতে থাকি তা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। উপনিবেশিত মননের এই ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স উদ্ভূত চিন্তা এমন এক পরিবেশ তৈরি করছে যেখানে ইংরাজিতে লেখা ও তাদের মানে যাওয়াই লক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এবং তৈরী করা হচ্ছে এক আগ্রহী, অল্পবুদ্ধি গেনিমেডদের সাহিত্য সমাজ। আগ্রহী গ্যানিমেড অর্থাৎ যারা স্বইচ্ছায় জিউসের পাত্রবাহক হতে চান, অমরত্বের বিনিময়ে।

এর জন্য বাংলা ভাষা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা বৈজ্ঞানিকভাবে দেখতে আমরা বিজ্ঞানী এবং পৃথিবীর একজন বড় বুদ্ধিজীবী জ্যারেড ডায়মন্ডের কথা স্মরণ করতে পারি, যা তিনি লিখেছেন তার বই থার্ড শিম্পাঞ্জিতে। কথাটার অনুবাদ এইঃ

“সাংস্কৃতিক বৈচিত্র দেখা যায় ভাষার বৈচিত্রের মধ্যে। কিন্তু প্রচুর প্রচুর ভাষা আমরা হারিয়ে ফেলেছি।  ইউরোপে এখন আছে প্রায় পঞ্চাশটি ভাষা। এদের বেশিরভাগ ইন্দো ইউরোপিয়ান নামের একটি ভাষা পরিবারেরই সদস্য। অন্যদিকে, নিউ গায়ানার আয়তন ইউরোপের দশ ভাগের একভাগ, জনসংখ্যায় ইউরোপের শতভাগের এক ভাগ, কিন্তু ওখানে ভাষা আছে শত শত। এদের অনেকগুলিই নিউ গায়ানা বা পৃথিবীর অন্য এলাকার ভাষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নিউ গায়ানার একটি ভাষায় গড়ে প্রায় কয়েক হাজার লোক কথা বলেন,  যারা প্রায় দশমাইলের ভেতরে পরস্পরের কাছাকাছি বসবাস করেন।

“পৃথিবী আসলে এরকমই ছিল। প্রতিটি একাকী ট্রাইবের ছিল আলাদা ভাষা। কৃষির উন্নতির সাথে সাথে এ অবস্থা বদলে যেতে শুরু করল, কিছু দল বড় হতে থাকল শক্তিতে, ক্ষমতায় আর তাদের ভাষা ছড়িয়ে দিতে লাগল বিস্তৃত এলাকায়। মাত্র ছয় হাজার বছর আগে ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষা পরিবার বিস্তৃত হতে শুরু করে, এবং বাড়তে বাড়তে ইউরোপের প্রায় সব ক’টি প্রধান ভাষার উৎসে পরিণত হয়। একই জিনিস গত কয়েক হাজার বছরে হয়েছে আফ্রিকায়, সেখানে বানতু ভাষা পরিবার বিস্তৃত হয়ে আফ্রিকা, দক্ষিণ সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন অন্য ভাষাগুলিকে গ্রাস করে ফেলেছে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়, শত শত ইন্ডিয়ান ভাষা গত কয়েক শতাব্দিতে বিলুপ্ত হয়েছে।”

এই ভাষা হারানো কি ভালো জিনিস, কারণ কম ভাষা হলে তো যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুবিধা? হয়ত, কিন্তু এটা খারাপ জিনিস অন্য আরো অনেক দিক থেকে। ভাষাগুলি গঠনগত ও শব্দ ভাণ্ডারের দিক থেকে আলাদা হয়। তারা আলাদা হয় অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে, এবং ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের দিক থেকে। একেক ভাষা একেক ভাবে আমাদের চিন্তাকে আকৃতি দেয়, মানস কাঠামো গড়ে তুলে। কোথাও কোন “সবচাইতে সেরা” ভাষা নেই। প্রকৃতপক্ষে, ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য বেশি উপযুক্ত। যখন কোন ভাষা হারিয়ে যায় তখন আমরা আসলে যারা এই ভাষায় কথা বলত তাদের এই পৃথিবীকে দেখার এক ইউনিক জানলা হারিয়ে ফেলি।”

ভাষাভিত্তিক আগ্রাসন অনেক বড় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। যা অবশ্য বাংলা ভাষাতেও চলছিল তথাকথিত প্রমিত ভাষার কনসেপ্ট দিয়ে বাংলা ভাষাকে ছাঁটাই করার জন্য, যা একটি ইউরোপিয়ান প্রকল্প। কিন্তু তা কার্যকর হয় নি, হবেও না, কারণ ঐতিহাসিকভাবে ভাবে বাংলার জনপদ, লোকসকল ও ভাষায় প্রাণবন্ততা খুবই ব্যাপক। চরিত্রগত ভাবে এমন বৈশিষ্ট্য এসেছে ভূ-প্রকৃতির কারণে, এখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়, জমি খুবই উর্বর। বন্যা, দুর্বিপাক, দুর্যোগে এরা পড়ে যায়, কিন্তু আবার উঠে দাঁড়ায়, ও শেষতক টিকে থাকে বসুধা বক্ষে। ফলে এর বৈচিত্রময় ভাষাকেও এলিটিস্ট পন্থায় শাসন করে অথর্ব বানিয়ে ফেলা সম্ভব নয়।

এক্ষণে কেনিয়ান লেখক এনগুগি ওয়া থিয়ং এর কথা স্মরণ করা যায়, যিনি ভাষাজনিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বুঝতে পারেন ও ইংরাজি ভাষায় সাহিত্য করা বন্ধ করে নিজ ভাষা গিকিউতে সাহিত্য করা শুরু করেন।

আলিফ লায়লা, আলাদিন, অনুবাদ ও অন্যান্য

আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা বা আরব্য রজনীর গল্প সারা বিশ্বে সবচাইতে প্রচলিত গল্পদের মধ্যে পড়ে। আলিফ লায়লার গল্পগুলির মূল যদিও আরব না, ভারত এবং ইরানের মূলত। এবং আরবে এই গল্পগুলি খুব উচ্চমানের সাহিত্য হিসাবে কখনোই স্বীকৃত ছিল না। কিন্তু এই গল্পগুলি আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের গল্প উপন্যাস তথা কাহিনীর একরকম আদিরূপ। কারণ এখানে প্রতিটি পর্বের পরে একটা ক্লিফ হ্যাংগার রাখা হতো, যাতে শ্রোতারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে পরে কী ঘটে তা শুনতে।

ফার্দিনান্দ কেলারের আঁকা শেহেরজাদ ও সুলতান শাহরিয়ার, ছবিসূত্রঃ উইকিমিডিয়া।

আলিফ লায়লার গল্প কথক শেহেরজাদ এটা করত যাতে অত্যাচারী রাজা গল্পের পরবর্তী অংশ শোনার জন্য তাকে খুন না করে। রাজা শাহরিয়ার একদিন দেখলেন যে তার প্রথম স্ত্রী তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তখন সে ঠিক করে প্রতিদিন একজন নতুন কুমারীকে বিয়ে করবে, এবং পরদিন তাকে খুন করে ফেলবে।

আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল শেহেরজাদের, তা হচ্ছে, গল্পের মাধ্যমে রাজাকে শিক্ষিত করে তোলা, যাতে সে তার অত্যাচারী স্বভাব বর্জন করে ভালো মানুষ হয়ে উঠতে পারে। এটা সাহিত্যের আরেকটা উদ্দেশ্য। গল্প কেবল বিনোদনের জন্য নয়। প্রাচীনকালে, অর্থাৎ কৃষিভিত্তিক সমাজ উদ্ভবের পূর্বে মানুষ যখন জঙ্গলে শিকার-সংগ্রহ সমাজে ছিল তখনো মানুষ গল্প বলত। নৃতাত্ত্বিকেরা গবেষণায় দেখেছেন যে এইসব গল্প বলা হতো মানুষদের বিভিন্ন রীতিনীতি শিক্ষা দেবার জন্য, যাতে তারা সহযোগিতামূলক এক সমাজ গড়ে তুলতে পারে। কৃষিভিত্তিক সমাজের উদ্ভবের পর গল্পের ধরণ বদলে যায় কারণ তখন সমাজ ও সমাজের লোকদের মধ্যেকার সামাজিক সম্পর্কও বদলে গেছে।

যাইহোক, আলিফ লায়লার যেসব অনুবাদ হয়েছে প্রথম থেকেই ইউরোপিয়ান বিভিন্ন ভাষায়, তাতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন, ইংরাজিতে অনুবাদের সময় এডওয়ার্ড লেইন যৌন অংশগুলি বাদ দিয়েছিলেন, কারণ তার কাছে এগুলি ছিল অনৈতিক। আবার রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন এই যৌন অংশগুলির প্রতিই বেশি আগ্রহী হয়ে অনুবাদ করেন, এবং আরো যৌনময় করে তুলেন। কারণ ভিক্টোরিয়ান যৌনতার ধারণার বিরোধী ছিলেন তিনি। বইয়ের তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ কথা যোগ করে দেন তার অনুবাদ সম্পর্কে। তিনি লিখেন যে আমরা যদি ঐ লোকগুলির ভাষা ও সংস্কৃতি ঠিকঠাক না জানি তাহলে কীভাবে ওদের উপনিবেশে পরিণত করব।

এই ধরনের উপনিবেশবাদী মনোভাব ইউরোপের যে আগে ছিল, এখন নেই, এমন নয়। ডিজনির আলাদিন ফিল্মের দিকে দেখলে তা স্পষ্ট হয়।

ডিজনি ১৯৯২ সালে আলাদিন নামে যে এনিমেশন ফিল্মটি বানায়, তা আলিফ লায়লার গল্পের ওপরেই ভর করে। কিন্তু ফিল্মটি দেখলে দেখা যায়, নায়ক নায়িকা দেহাকৃতি পশ্চিমাদের মত, ভাষার একসেন্ট পশ্চিমা অর্থাৎ এংলো আমেরিকান কিন্তু ফিল্মের বাকিরা অদ্ভুত মুখাকৃতির, রঙ কালো, লোভী, ভিলেন, ও তাদের মুখে আরব একসেন্ট।

আলাদিন এনিমেশন ফিল্ম, ছবিসূত্রঃ Digitalspy.com

এমনকী ফিল্ম শুরুর গানের এক লাইন ছিল এমন, আরব সম্পর্কে বলছে Where they cut off your ear if they don’t like your face, পরে আমেরিকান-আরব এন্টি ডিসক্রিমিনেশন কমিটির তীব্র প্রতিবাদের মুখে ফিল্ম কর্তৃপক্ষ লিরিক পরিবর্তন করে।

১৯৯২ সালে এসে পশ্চিমের তৈরি আলাদিন এনিমেশন ফিল্ম নির্মাতাদের যে মানসিকতা দেখায়, তা ফ্রান্সিস বার্টনের উপনিবেশবাদী চিন্তার সাথে মিলে যায়। ওরিয়েন্টালিস্ট স্টেরিওটাইপ যা আছে, যেমন মধ্যপ্রাচ্য-এশিয়া অনুন্নত, অসভ্য ইত্যাদি, এবং পশ্চিম যে নিজেকে ভাবে বেশি সভ্য, এই সুপিরিয়রিটির প্রভাব বার্টনে যেমন ছিল, এখনো বর্তমান আছে।

অনুবাদের বায়াস, এবং আঞ্চলিকতার এই সমস্যার যেহেতু মানুষের মধ্যে আছে, সেখানে একেবারে খাঁটি ও বায়াসমুক্ত অনুবাদ প্রায় অসম্ভব।

তাছাড়া, আরো সমস্যা হয় যখন একজন লেখক গ্লোবাল ওডিয়েন্সকে সামনে রেখে লেখেন তার বই। বাংলাদেশের একজন লেখক পশ্চিমা ওডিয়েন্সকে টার্গেট করে লিখলে, তাদের মান, চাহিদা ও রুচিমত লেখার প্রবণতা তার মধ্যে দেখা যেতে পারে।

আরেক সমস্যা পাঠ নিয়ে। যেই পাঠ একজন লেখকের চিন্তার জগত তৈরি করে। নাইজেরিয়ান লেখিকা চিমামান্দা এনগোজি আদিচি এক টেড লেকচারে এই সমস্যা সুন্দরভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। তিনি বলেছেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি ইংরাজি বই পড়তেন খুব। সেই সময়েই লেখা শুরু করেন। কিন্তু তার গল্পের চরিত্রগুলি হতে থাকে ইংরাজি ইংরাজি। তার আবহাওয়া নিয়ে কথা বলত, জিঞ্জার বিয়ার খেত। তিনি তখন ঘুনাক্ষরেও ভাবেন নি তার দেশের কালো চামড়ার লোকেরাও সাহিত্যে আসতে পারে। তিনি ভাবতেন সাহিত্যে আসে কেবল শাদারাই। পরে চিনুয়া আচেবে পড়ে তার ধারণার বদল হয়। তিনি নিজের ও নিজেদের গল্প লিখতে শুরু করেন।

মানভিত্তিক বিশ্বসাহিত্যের ধারণা এমন এক সমস্যা তৈরি করতে পারে লেখকদের মনে, যে উচ্চমান কেবল পশ্চিমের মানদণ্ডেই হয়।

 

আগ্রহীদের জন্য সংযুক্তিঃ

১। রবার্ট সাপোলস্কির লেকচার তার বই বিহেভ নিয়ে

২। সমাজবিজ্ঞানের রিসার্চের নিউজ

৩। হেলেন পিয়ারসনের টেড টক 

৪। সুনীলের বক্তব্য 

৫। দার্শনিক মার্কাস গ্যাব্রিয়েলের লেকচার

৭। জ্যারেড ডায়মন্ডের বই 

৮। সৈয়দ নিজারের বই – ভারতশিল্পে উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা। ফেব্রুয়ারী ২০১৭তে প্রকাশ করেছে চৈতন্য প্রকাশন।

৯। সব নোবেল সাহিত্য জয়ী

১০। চিমামান্দার টেড লেকচার

১১। আলাদিন বিতর্ক 

১২। আমরা কেন গল্প বলি, নৃতাত্ত্বিক গবেষণা 

লেখাটির ড্রাফট পড়ে বানান ঠিক করতে সহায়তা করেছেন কবি তানিম কবির। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা রইল।

লেখাটি বুনন নামের সাহিত্য পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ২০১৮সংখ্যায় প্রকাশিত। তারা সেখানে রেফারেন্স লিংক বাদ দিয়েছে, তাই এখানে রেফারেন্স বা সংযুক্তি লিংকসহ প্রকাশ করলাম।