মধ্যযুগের বাংলা কবিতা ও বাঙালীর সৌন্দর্যশাস্ত্র বুঝার চেষ্টা

বাংলা লোকগানে মাঝে মাঝে এমন কিছু লাইন পাইতাম বা পাই, যেসবের গভীরতা দেখে বিস্ময় অনুভব করি। এগুলা শুনে ভাবতাম যে এদের উৎস কী? এইসব লোক কবিরা বা বাউলেরা যেইভাবে কথাটা বলছেন ঐভাবে তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত কবিরাও বলতে পারেন না? কী এনাদের ভাবের উত্তরাধিকার?

bangla-kobita

মধ্যযুগের বাংলা কবিতার সাথে পরিচিত হইয়া আমার মনে হইছে, বাউল-লোককবিদের জ্ঞান ও গানের কথার উত্তরাধীকারে দাঁড়াইয়া আছেন বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগের কবিরা। তাদের ভাব, ভাষা ও চিন্তা। এইসবই জনমানুষের গান ও কবিতা। এইগুলা মানুষ অন্তরে ধারন করতেন, এখনো গ্রাম গঞ্জের মানুষ ধারন করে রাখেন।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যদি কয়েক লাইনে বলতে হয় তাহলে তা এই, প্রথমে চর্যাপদ। যা প্রাচীন যুগের সাহিত্য। এরপরে মধ্যযুগ। ১২০১ থেকে ১৮০০। এই সময়ে হইছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, রচয়িতা বড়ু চন্ডীদাস। বৈষ্ণব পদাবলী, লিখেছেন দ্বিজ চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস, জ্ঞান দাস এনারা। এরপরে মঙ্গলকাব্য। মঙ্গলকাব্য বিভিন্ন দেব দেবীর পূজা প্রচলন বিষয়ে কাব্য। কথিত আছে এক মঙ্গলবার হইতে আরেক মঙ্গলবার পর্যন্ত স্থায়ী হইত কাব্যের বর্ননা। কবিরা বলে যাইতেন, শ্রোতারা শুনতেন। মঙ্গলকাব্যের মধ্যে আছে মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ইত্যাদি। মঙ্গলকাব্যের প্রসিদ্ধ কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর এনারা। চৈতন্যদেবের জীবনী হইছে। এরপরে অনুবাদ সাহিত্যের বিকাশ, রামায়ন-মহাভারতের অনুবাদ। মুসলিম সাহিত্যিকদের প্রণয়োপাখ্যান-অনুবাদ। কবিগান, লোকসাহিত্য। এরপরে আধুনিক যুগ। আধুনিক যুগের শুরু উনিশ শতকের শুরুতে, ঈশ্বরচন্দ্র-রামমোহন-মধুসূদন দত্ত এনাদের থেকে শুরু করে, বর্তমানে চলতেছে।

মধ্যযুগের কবিতা নিয়া এই “মধ্যযুগের শ্রেষ্ট বাংলা কবিতা” বইটা দারুণ। দারুণ এই কারণে যে স্বল্প পরিসরে ঐ সময়ের কবিতা সম্পর্কে এখানে ধারণা পাওয়া যায়। ঐ সময় ও তার সাহিত্য বর্তমান সময় ও তার সাহিত্যের গতিপথ বুঝার জন্য দরকারী, দরকারী বর্তমানে নয়া সাহিত্য সৃষ্টির জন্যও। কারণ মানুষ বা মানুষ সংস্লিষ্ট সব তার ইতিহাসের নির্মান।

bangla-kobita2

বইয়ের শুরুতে নাতিদীর্ঘ ভূমিকা আছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য নিয়ে। এরপরে বৈষ্ণব কবিতা, ব্রজবুলী বৈষ্ণব কবিতা, বাউল কবিতা, শাক্ত পদাবলী, ময়মনসিংহ গীতিকা এবং মঙ্গলকাব্য থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ দেয়া হয়েছে। বইয়ের পরিসর মাত্র ৬২ পৃষ্ঠা। প্রকাশক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

 

বাঙালীর সৌন্দর্যের ধারনায় প্রবেশ

সৌন্দর্যশাস্ত্র বা এস্থেটিকস হচ্ছে ফিলসফির একটা শাখা যা সুন্দরের ধারণা, টেইস্ট বা রুচি, কোন শিল্পকর্ম বা বস্তুর সৌন্দর্যের বিচার এইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাঙালীর সৌন্দর্যের ধারণা নিয়ে চিন্তা আমার মাথায় আসে সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা লেখা পড়ে। সেইখানে তিনি লেখছিলেন, এই অঞ্চলের মানুষ ইংরাজ আগমনের পূর্বে ফর্সা বা শাদা রঙকে এতো আকাঙ্খিত মনে করত না। তাই এখানকার দুই ধর্মীয় মহাপুরুষ শ্রীরাম ও কৃষ্ণ, কারো গায়ের রঙই শাদা নয়। উপরন্তু, যখন ইউরোপীয়ানরা আসতে লাগল এই অঞ্চলে তখন এখানকার মানুষ অবাক হইয়া জিজ্ঞেস করতো, তোমাদের গায়ে ধবল কেন?

মধ্যযুগের কবিতায় চন্ডীদাস রাধার রূপ বর্ননা করতে গিয়া লিখেছেন গোরোচনা গোরী। এর অর্থ লেখা আছে এমন, গোরোচনা- উজ্জ্বল পীতবর্ণ আর গোরী – গৌরবর্ণা, ফর্সা মেয়ে।

পীতবর্ন হচ্ছে হলুদ বর্ন

উজ্জ্বল হলুদ বর্ণ হলে তা ফর্সা হয় কি? দুই বর্ণ তো ভিন্ন। মনে হয় প্রথমে গৌরবর্ণ দিয়ে উজ্জ্বল পীত বা হলুদ বর্ণই বুঝানো হতো, পরবর্তীতে ইউরোপিয়ানদের আগমনের পরে গৌর বর্ণের আরেক অর্থ ফর্সা হয়েছে।

ফর্সা বলতে যা বুঝায়, ফেয়ার এন্ড লাভলীর বিজ্ঞাপনে আমরা দেখে থাকি। এটা পীতবর্ন বা গোরা নয়। কিন্তু অভিধানে গোরা অর্থে ফর্সাও লেখা হয়েছে। এটি বিভ্রান্তিকর।

রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভোলগা থেকে গঙ্গা বইতে যে আদি মানুষদের দিয়ে শুরু করেছিলেন ইতিহাস, এদের গায়ের রঙ ছিলো এইরকম, উজ্জ্বল পীত বা দুধে আলতা। দুধে আলতা এই টার্ম আমাদের এখানে সৌন্দর্য হিশাবে প্রচলিত আছে এবং ছিল। তাকে অবশ্য হটিয়ে দিচ্ছে ফেয়ার এন্ড লাভলীর ফর্সা। উজ্জ্বল পীতকে যদি দুধে আলতা বলা যায়, তাহলে এই সৌন্দর্যের ধারনার রুট অনেক গভীর বলেই মনে হয়। তখন আর্য তত্ত্বের দিকে তাকাতে হবে।

যাইহোক, চন্ডীদাসের বর্ননায় রাধার রূপ পড়া যাক –

bangla-kobita3 bangla-kobita4bangla-kobita5