রাখাল গ্রামে জঙ্গলের পাশে গরু চড়াইত। একদিন সে চিৎকার করল, আঘ আইছে, বাঘ আইছে। লাঠিসোটা নিয়ে গ্রামবাসী গেলেন। গিয়া তারে জিজ্ঞেস করলেন, বাঘ কই? রাখাল হাসে। গ্রামবাসী ঘরে ফিরে এলেন।
তারপরের দিন একই ঘটনা ঘটল। রাখাল চিল্লায়, বাঘ! বাঘ! গ্রামবাসী লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়ে গেলেন। গিয়া দেখলেন বাঘ নাই। রাখালরে জিজ্ঞেস করলেন, বাঘ কই? রাখাল হাসে।
বিরক্ত গ্রামবাসী ঘরে ফিরে এলেন।
পরদিন আবার রাখাল চিৎকার দিল, বাঘ আইছে, বাঘ আইছে।
এইবার গ্রামবাসী আর বের হইলেন না। তারা আর বিশ্বাস করলেন না রাখালের কথা। সেদিন সত্যি সত্যি বাঘ এসেছিল। ফলে বাঘ রাখালকে খেয়ে চলে গেল। বাঘ যাবার পরে গ্রামবাসী এসে দেখলেন রাখাল আর নাই।
ধারনা করি, এরপরে তারা তাদের ছেলেমেয়েদের এই মিথ্যাবাদী রাখালের গল্প বলে মিথ্যা বলা থেকে বিরত রাখতে চাইতেন।
এই গল্প আমরা পড়েছি। বহুল প্রচলিত এই নীতি গল্পের নীতিকথা, মিথ্যাবাদীর পরিণতি বা মজা করিয়া মিথ্যা বলিলে খারাপ ফল ভোগ করিতে হয়।
এমনই আমরা জেনে এসেছি বা আমাদের জানানো হয়েছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম, খুব সম্ভবত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (হাইস্কুলেও হইতে পারে) ইংরাজি পাঠ্যপুস্তকে গল্পখানা ছিল। পাঠপুস্তক ছাড়াও গুরুজনদের মুখে মুখে এই গল্প শোনা যাইত, কারণ এটি মিথ্যা বলার ভয়াবহতা তুলে ধরে।
এবার রাখালের জায়গায় নিজেরে রেখে কল্পণা করা যাক একটু। একটা গ্রামে একজন রাখাল বালক জঙ্গলের পাশে একা একা গরু রাখালি করে। জঙ্গলে বাঘ আছে। যেকোন সময় তা আসতে পারে। বাঘের ভয় কি তার মধ্যে কাজ করবে না? অবশ্যই করবে।
এই ভয় থেকেই মূলত মানুষের সঙ্গ পাওয়ার জন্য সে বাঘ বাঘ বলে চিল্লাইত।
যে গ্রামের লোকজন একলা একটা শিশুকে এভাবে জঙ্গলের পাশে গরু রাখালির কাজ দেয় বুঝতে হবে সেই গ্রামের সমাজে ন্যায়বিচারের অভাব এবং অসাম্য প্রবল। কারণ এভাবে একটি শিশুকে বিপজ্জনক কাজে লাগানো, যেখানে তার প্রাণ হারানোর সম্ভাবনা আছে, দৃশ্যত অন্যায়।
বালকটি প্রথমদিন চিৎকার দিল। গ্রামবাসীরা আসল এবং চলে গেল। দ্বিতীয়দিনও বালক চিৎকার দিল। গ্রামবাসীরা আসল এবং চলে গেল। এই দুই দিনে গ্রামবাসীদের একজনও বুঝতে পারে নাই রাখাল বালকের বেদনা। রাখাল বালক কেন এইভাবে মিথ্যা বলে তাদের ডেকে আনে, সেটা ভাবতে চায় নাই কেউ। কারণ তারা স্বার্থপর, তারাই এই ছেলেকে এমন বিপজ্জনক কাজে লাগাইছে। তারা লাঠি নিয়া বাঘ মারতে আইছে তাদের “রাখাল”কে বাঁচানোর জন্য, ছেলেটির প্রতি তাদের মমতা থাকলে, তাদের মধ্যে মানবিক অনুভূতির প্রাবল্য থাকলে তারা বালকটিকে বুঝতে চেষ্টা করত। তারা সেটা করে নাই। উলটো তাকে মিথ্যাবাদী মনে করেছে। এছাড়াও গ্রামবাসীদের ছুটে আসার পিছনে রয়েছে বাঘ হত্যা করার উৎসাহ। বাঘ তাদের জন্যও এক সমস্যা। ফলে বাঘ হত্যা করতে পারলে তারাও নিশ্চিন্ত হতে পারত।
গরীব একটি কিশোর ছেলেকে জঙ্গলের কাছে রাখালির কাজ দেয়া কি তাদের বাঘকে ডেকে আনার ফাঁদ? এই প্রশ্নও তোলা যেতে পারে।
স্কুলে আমাদের যখন এই গল্প পড়ানো হইত তখন আমাদের বয়সও এই রাখাল বালকের মতোই। আমাদের মতো একজন বালক রাখালি করে, মিথ্যা বলে, মারা যায় বাঘের কবলে। আমাদের তার মিথ্যাটাই দেখানো হলো, তার বাস্তবতাটা দেখানো হলো না। গ্রামের লোকেরা যেমন তাদের সন্তানদের এই গল্প পড়াইয়া মিথ্যা না বলার সবক দিত তেমনি আমাদেরও দেয়া হইল। তখন প্রশ্ন জাগে ঐ গ্রামের সমাজ কি আমাদেরই সমাজ?
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে রাখাল তার সমস্যার কথা গ্রামবাসীকে বলল না কেন? কেন সে হাসল যখন তারা জিজ্ঞাসা করেছিল, হোয়ার ইজ দ্য টাইগার?
রাখাল বালকের হাসা তার সমস্যার গভীরতাকে নির্দেশ করে। গ্রামের এত সব গণ্যমান্য লোকেদের সামনে সে এত ভয়ানক একটি কাজ করছে, বাঘের মুখের সামনে রাখালি, কেউ তারে সেই কাজ থেকে ফিরান নাই। এমন কাজ কোন রাখাল ইচ্ছা করে করবে না, ফলে ধারনা করা যায় গ্রামের প্রভাবশালীদের গরুই রাখালি করে রাখাল বালক।
যেহেতু তারাই তারে এই কাজে লাগাইছে তাই তাদেরকে নিজের ভয় পাওয়ার সমস্যার কথা বললে তারা এটা মানবে না। উপরন্তু হয়ত এতে কিছু শাস্তিও পেতে হবে। ফলে রাখাল বালকের হাসা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
সে হয়ত ভেবেছিল এইভাবে ওদের ডেকে ডেকেই সে তার ভয় দূর করবে এবং বাঘের কবল থেকেও বাঁচবে। কিন্তু বোকা বালক বুঝে নাই সমাজের লোকেরা তারে নিয়া অত ভাবিত নয়, দুই দিন তার ডাকে বাঘ মারা কিংবা তারে বাঁচানোর জন্য আসতে পারে তারা কিন্তু তৃতীয় দিন আসার মত ধৈর্য তাদের নাই।
কেউ বলতে পারেন, বালক মিথ্যা না বললে বাঁচতে পারত অন্তত। কারণ সে যদি প্রথম দুই দিন মিথ্যা না বলত তাহলে সত্যি সত্যি বাঘ আসার দিনে ডাকলে মানুষ তো আসতই।
এখানে বুঝতে হবে রাখালের বয়স কত। ঐ বয়সী একটা ছেলে বুঝে যা ধরেছে তাই সে করেছে তার ভয় দূর করার জন্য। আর দ্বিতীয় কথা হলো, মানুষ আসলেও সে যে অক্ষত থাকত তা বলা যায় না। কারণ লাটিসোটা নিয়ে আসতে আসতে বাঘ তারে অর্ধেক খেয়ে ফেলত। মরতে তাকে হইতই। মানুষেরা এসে বাঘটারে মারতে পারত হয়ত। কিন্তু রাখালের প্রাণ যাইত অথবা সে মারাত্মকভাবে জখম হইত।
আসলে মিথ্যাবাদী রাখালের এই মিথ্যা, তার মিথ্যা বলে মজা করা একটা অন্যায় সমাজের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ। প্রতাপশালী, মানবতাবোধহীন সমাজের বিরুদ্ধে দূর্বলের প্রতিবাদ।
রাখাল বালকের এই মিথ্যা, মহান মিথ্যা। এই মিথ্যার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে দূর্বল ও শোষিতদের আর্তনাদ, প্রবল অন্যায়কারীদের প্রতি তীব্র বিদ্রুপ।
এই গল্পকে সত্য বলা এবং মিথ্যা না বলার নীতিগল্প হিসেবে পড়ানো হলে তা একটি অন্যায় সমাজের পক্ষে যায়। নিশ্চয়ই সদা সত্য কথা বলার চাইতে ন্যায়পরায়ণতা বড় গুণ। ন্যায়পরায়ণতা হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। সদা সত্য কথা বলারা ঐ গ্রামবাসীর মতোও হতে পারে। যারা অন্যায়ভাবে একটা গরীব বালককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে নিজেদের অপরাধ ঢাকতে বালকটিকে মিথ্যাবাদি হিসেবে পরিচিত করায়।